সুকুমার রায় এর লেখকজীবন মাত্র কয়েকটি বছরের। শেষের আড়াই বছর আবার শয্যাশায়ী ছিলেন দুরারোগ্য অসুখে। কিন্তু মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনে সুকুমার রায় যা দিয়ে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যকে, তা তুলনাহীন। তাঁর বিচিত্র শব্দ-ব্যবহার, লেখার লাইন, চরিত্রের নাম কী অক্লেশে আমাদের কথাবার্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
গোমড়ামুখো কারও পরিচয় দিতে গেলে ‘রামগরুড়ের ছানা’ বললেই যথেষ্ট। অদ্ভুত ধরনের জোড়াতালি দেওয়া ঘটনা দেখলে শুধু ‘বকচ্ছপ’ বা ‘হাঁসজারু’ বলেই থেমে যাওয়া যায়। ‘সাতদিনের ফাঁসি’ তো কবেই প্রবাদের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে। লাগসই জায়গায় যদি বলা যায় ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল’—ব্যস, আর কিছু ভেঙে বলার দরকার নেই।
এই ভাবেই বাঙালি জীবনের নানা স্তরে মিশে গেছেন স্বল্পায়ু লেখক সুকুমার রায়। ভুগছিলেন দুরারোগ্য কালাজ্বরে। কিন্তু অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী এই মানুষটি রোগশয্যাতেও তাঁর সৃষ্টিকর্ম থামাননি। নানা ধরনের লেখালেখির কাজ করে গিয়েছেন সমানে। সঙ্গে ছিল ছবি আঁকা। অসামান্য ‘আবোলতাবোল’ গ্রন্থের লে-আউট তাঁরই তৈরি। কিন্তু দুঃখের কথা, ছাপার হরফে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি।
তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্পর্শে অল্প দিনের জীবনে তিনি যা দিয়ে গিয়েছেন, তা তুলনাহীন ! তাঁর ছড়ায়,কবিতায়, গল্পে, নাটকে, ছবিতে আমরা আজও মজে আছি।
‘আবোলতাবোল’ বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেনঃ
‘ যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’
আজগুবি, উদ্ভট,অসম্ভব বস্তুর এমন শিল্পসম্মত ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত আর কখনোই হয়নি। শুধু এই বইটিতেই নয়, সুকুমার রায়ের সৃষ্টিশীল সব লেখারই মূলে আছে তাঁর উদ্ভাবিত ‘খেয়াল রস’।
লেখকের মৃত্যুর কয়েক বছর পরে তাঁর প্রথম গল্প-সংকলন ‘পাগলা দাশু’ প্রকাশিত হয়। সেই সংকলনের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
“সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে, তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র গতি, তাঁর ভাবসমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমত্কৃতি আনে ... বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গরসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরও কয়েকটি দেখা গিয়েছে, কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভায় যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে, তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না।”
সুকুমারের বৈশিষ্ট্য তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। তাঁর নিজস্বতা গড়ে উঠেছিল বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা ও আশেপাশের জগৎ থেকে।
পাত্র গঙ্গারামের গুণের শেষ নেই। তার উনিশটিবার ম্যাট্রিকে ফেল মারাটা কোনও ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত নয়, বিরল এক অধ্যবসায়ের পরাকাষ্ঠা। বাবুরাম সাপুড়ের কাণ্ডকারখানাও আমাদের মাতিয়ে রাখে। ‘ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা’ বললে আমরা অক্লেশে মেনে নিই, কুমড়োপটাশ নাচলে কী হয়—আমাদের আর অজানা নয়; বোম্বাগড়ের রাজা কেন ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্ব ভাজা বাঁধিয়ে রাখে—তা নিয়ে কেউ এখন আর প্রশ্ন তোলে না। কারণ সুকুমার রায় তাঁর আশ্চর্য লেখার গুণে বিচিত্র এই জগৎটিকে সত্যি করে তুলেছেন।
শব্দের আশ্চর্য মহিমার কথা একাধিকবার শুনিয়েছেন সুকুমার। এমনকী বিচিত্র এই জগতে গাছের ফুল ফোটার সময় ভয়ংকর সব শব্দ উঠে থাকে। নিছক শব্দ নয়, ‘শব্দকল্পদ্রুম’। ‘ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খট্কা--/ ফুল ফোটে ? তাই বল! আমি ভাবি পট্কা।’ যে জগতে ফুল ফোটা আর পটকা ফাটার শব্দের মধ্যে বিন্দুমাত্র তফাত নেই, সেই জগতে বাড়ির নাম ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ হলে সে বাড়ি তো পড়ে যাবেই।
নেড়ার গানও দিব্যি মানানসই এখানে। ‘লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ’—এর মধ্যে তো কণামাত্রও অসঙ্গতি নেই। কিন্তু বিচারক প্যাঁচা এই প্রতিভাবান নেড়াকেই সাজা দিয়েছিল। সেই সাজাটিও জব্বর ! ‘তিন মাসের জেল আর সাত দিনের ফাঁসি।’
তিন মাসের জেল নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, কিন্তু সাত দিনের ফাঁসি ! কথায় বলে—হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। সুতরাং মেনে নেওয়া যেতে পারে যে হুকুম পালন করা হয়েছিল। কী ভাবে সেটা কেউ জানে না, এবং বোধহয় জানতেও চায় না।
উদ্ভট চেহারার একটা হ্যাংলা প্রাণীর নাম দিয়েছিলেন ‘হ্যাংলাথেরিয়াম’। অত্যন্ত বিরক্ত, গোমড়া চেহারার একটা প্রাণীর নাম দেওয়া হল ‘গোমড়াথেরিয়াম’। আজব চেহারার এক ল্যাংড়া জন্তুর নাম রাখা হল ‘ল্যাংড়াথেরিয়াম’। বিদ্ঘুটে আকৃতির একটা প্রাণী প্রাণপণে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই, তার লাগসই নামটিও ঠিক করে ফেলেছিলেন প্রফেসর—‘চিল্লানোসরাস’। চরিত্রের বিচিত্র সব নামকরণ করার ঝোঁকটি উত্তরাধিকারসূত্রে সত্যজিৎও পেয়েছিলেন।
‘আবোলতাবোল’ বইটির পাতায় পাতায় মজাদার জীবন্ত ছবির ছড়াছড়ি। বইয়ের পাতায় এরা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এদের মধ্যে আছে হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কাঠবুড়ো, কুমড়োপটাশ, বোম্বাগড়ের রাজা, রামগরুড়ের ছানা, ট্যাঁশ গরু,পালোয়ান ইত্যাদি।
সংযোজন :-সুকুমার রায়ের কিছু অজানা তথ্য
(১ )মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা ---- "নদী"
(২) প্রায় নয়টায় তিনি "টিক্, টিক্, টং" যা সত্যিই সুপরিচিত নার্সারি কবিতা "Hickory, Dickory, ডক" এর একটি অনুবাদ লিখেছিলেন.
(৩)তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসেবে যখন অধ্যয়নরত তখন একটি ক্লাব গঠন করেন | নাম দেন 'ছাইপাঁশ ক্লাব'
(৪)তিনি পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন.
(৫) তিনি ফটোগ্রাফি এবং মুদ্রণ এ উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান.
(৬)অনেকের জানা নেই যে হাস্যরস কর্তা ফটোগ্রাফির ওস্তাদ.ছিলেন | তিনি 17 বছর বয়সে ফোটোগ্রাফি শ্রেষ্ঠত্ব জন্য 'বয় ওন পেপার' মেরিট পুরস্কার, 1904 সালে তিনি সহচরী ক্যালকুলেটর পরিকল্পিত প্রক্রিয়া কাজ করার সময় ক্যামেরা স্থাপনে সাহায্য করার জন্য. 'রয়েল আলোকচিত্র সোসাইটির ফেলো' হয়ে ওঠেন |
টিকা :
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস "রাজশ্রী" র প্রধান দুটি চরিত্র 'তাতা' ও 'হাসি ' | উনি তাই সুকুমার রায় কে ডাকতেন 'তাতা ' আর তার বোনকে ডাকতেন 'হাসি '