কবিতা সর্বজনীন তখনি হতে পারে যখন কবিতার বাক্যবিন্যাস হবে সাধারণ, শব্দচয়ন হবে সাদামাটা, অথচ বক্তব্য হবে গভীর ও হৃদয়গ্রাহী।কবিতা'র আকর্ষণ করার ক্ষমতা থাকা চাই পাঠকদের। সঙ্গে অবশ্যই কিছু দার্শনিকতা থাকবে। ধরুন আপনি একটা প্রেমের কবিতা লিখছেন। সেই কবিতাটি ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানায় এমনভাবে উপস্থাপনা করলেন যে শৈল্পিক দক্ষতার কারণে ব্যক্তিগত প্রেমের কাহিনী হয়ে যাবে সর্বজনীন। শেষ বাক্যটি না পড়া অব্দি যে পাঠক কে ধরে রাখতে পারেন, সেখানেই হবে লেখক বা লেখিকার সর্বজনীন সার্থকতা। যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন......
"চক্ষে আমার তৃষ্ণা,
তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে"
সাধারণ শব্দচয়নে কত গভীরতা প্রকাশ পায় শুধু ওই দুলাইনেই।
দেখুন আরো একটা উদাহরণ দিই ............
কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় রচিত একটি বাস্তবভিত্তিক কবিতা পড়ুন।
কবিতাটির নাম "
"মুখোশ, মুখোশ শুধু"
মুখোশ, মুখোশ শুধু, চারিদিকে মুখোশের ভিড়;
আমাকে অস্থির
ক'রে তোলে, নিরুপায় হয়ে তুলি হাত
আকাশে,... খটখটে মেঘ-রোদ্দুরের অনির্বচনীয়
সুন্দর নির্মাণ করে চিরায়ত
আর এক পৃথিবী;
আমি চেয়ে থাকি নির্নিমেষ।
এখন মুখোশ যুদ্ধে কেউই পরে না ছদ্মবেশ,
স্বাভাবিক দেখে ভাবি- আড়ালে
নেকড়ের চোখ জ্বলে;
ধারালো নখের লক্ষ্য ঢেকেছে আস্তিনে।
আমি অক্ষরের যাদুবলে
মুখোশের আড়ালে যে মুখ, তাকে চিনে
নিতে গিয়ে দেখি, তাও
প্লাস্টিক সার্জারী করা, অন্য আগন্তুক।
ছেলেবেলাকার সেই চোখ-নাক-মসৃণ চিবুক
কিশোর, যুবক আজ নেই,
পণ্যভার বহনের ভারে ক্লিষ্ট প্রাণ
মানুষ হয়ে ছদ্মবেশী
যুগের অস্থির অভিনেতা
আজ সকলেই।
মুখ ও মুখোশে আজ ভেদ নেই, কোন ভেদ নেই।
দারুন দক্ষতার সঙ্গে কবি তুলে ধরলেন জীবনের অতি বাস্তবতা সুন্দর সহজ অথচ কাব্যিক শ্বব্দচয়নে । যে কোনো ধরণের পাঠক এই কবিতা পড়ে পাবে মনের তৃপ্তি।
আরো একটি .....
কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত রচিত
"কুটির"
ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারা বেলা কথা কয়,
কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দু'পার,
রূপসীর শাড়ি যেন তৈরি রূপার।
কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
পরনে খড়কে-ডুরে,
বেণী নাচে ঘুরে ঘুরে,
পায়ে পায়ে- 'রুনু ঝুনু' হালকা খাড়ুর,
কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।
কবিতাটিতে এমন কিছু কাব্যিকতা নেই অথচ যে কোনো বয়সের পাঠকের মনকে মাতিয়ে রাখে ।
তাই কবির কলমের দীপ্ত সূচনায় কবিতা-পাঠকের হৃদয় ছুঁতে পারাই কবিতার সার্থকতা ও সর্বজনীনতা।
সবাইকে জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা।