"টুনটুনির গল্প" দিয়ে শুরু, মাঝে "আবোলতাবোল", আর শেষ হলো 'ফেলুদা' তে, আর এভাবেই একনাগাড়ে তিনপুরুষের একটি বাংলা সাহিত্য প্রবাহ লাগাতার বয়ে গেছিলো ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ এর মাসুয়া গ্রাম থেকে বেলভিউ নার্সিং হোমে কলকাতায়, হাতে "অস্কার" এর মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিয়ে। অসাধারণ প্রতিভার শাখা প্রশাখা বিস্তার করে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কবিতা,মুদ্রণশিল্প ও চলচ্চিত্রের এক অমূল্য সম্পদ দিয়ে গেলেন
রায় পরিবারের এই তিন ত্রয়ী। এ যেন সেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী'র 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' এর "ভূতের রাজা" এসে আমাদের দিয়েছিলো "তিন বর" --- 'উপেন্দ্রকিশোর','সুকুমার রায় আর 'সত্যজিৎ রায়।
হ্যাঁ, শুরুটা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মের(১৮৬১) ঠিক তিন বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে। কিশোরগঞ্জের মাসুয়া গ্রামের আর জোড়াসাঁকো'র দুই অসাধারণ প্রতিভা - কবিগুরুর সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছিল নিবিড়ভাবে। বাংলার কৃষ্টিজগতে রায় পরিবারের সৃজনশীল অবদান সুদূরপ্রসারী। ছোট বেলায় উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির মনমাতানো গল্প পড়ে কে আত্মহারা হয়নি? রূপকথার গল্প আর সঙ্গে ছবিসহ সব সুন্দর সুন্দর চিত্রণ। সন্দেশ পত্রিকাতে নানারকম মজার মজার লেখা। এইসবের স্রষ্টা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী(১৮৬৩ -১৯১৫) ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা আর আমাদের অতি প্রিয় সুকুমার রায়ের পিতা। পরবর্তী পর্যায়ে পেলাম সুকুমার রায়ের 'আবোলতাবোল','হযবরল' ইত্যাদি । তারপরে পেলাম সুকুমার রায়ের পুত্র অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় কে 'ফেলুদা সমগ্র,,নানান গল্প আর অসাধারণ সব চলচিত্রের স্রষ্টা হিসেবে। তিন প্রজন্ম ধরে মুদ্রণ শিল্প, শিশু-সাহিত্য, চিত্রবিদ্যা ও ফটোগ্রাফি চর্চায় এঁরা তিনজনে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে অনাবিল আনন্দে মজিয়ে রেখে গেছেন।পাশাপাশি কবিতা ও সংগীতেও তিন প্রজন্মের পরম্পরা নদীর মতো প্রবাহিত হয়েছে। পৌত্র সত্যজিৎ রায় লিখেছেন যে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় আমরা পাই তাঁর লেখাতে,গানে,ছবিতে ও মুদ্রণের কাজে। পাখোয়াজ, বেহালা,হারমোনিয়াম,সেতার বাঁশি সবকিছুতে তিনি পারদর্শী ছিলেন।তাঁর রচিত 'বেহালা শিক্ষা, হারমোনিয়াম শিক্ষা প্রকাশিত হয় ১৯০৪ ও ১৯০৫ সালে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী এব দুজনের মধ্যে ঘনিষ্টতা ছিল প্রগাঢ়। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের স্বরলিপি প্রাশ্চাত্যের স্টাফ নোটেশনের নিয়মে সংকলিত করেন।
চলুন এবারে নিয়ে যাই আপনাদের পুত্র সুকুমার রায়ের কাছে। জন্ম কলকাতায় ৩০শে অক্টোবর ১৮৮৭ সালে।কালাজ্বরে মৃত্যু ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩ সালে ১০০ নং গড়পার রোড, কোলকাতাতে। মৃত্যুসজ্জাতে শুয়ে আবোলতাবোল এর প্রত্যেকটি কবিতার ছবিগুলো এঁকেছিলেন। কিন্তু আবোলতাবোল প্রকাশিত হবার আগেই তিনি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে আড়াই বছরের পুত্র সত্যজিৎ রায়কে আমাদের উপহার দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি যখন খুব অসুস্থ, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে যান।রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় অল্প নয়, কিন্তু আসন্ন মৃত্যুকে এমন স্থিরচিত্তে গ্রহণ করতে তিনি খুব কম মানুষকেই দেখেছেন।
আবোলতাবোল এর শেষ কবিতায় শেষ ছত্রে আছে ...
আদিমকালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম্
ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর
গানের পালা সঙ্গে মোর
হাসি ও গান চিরতরে শেষ হয়ে যাবার মুহূর্তের এই ছত্রগুলো সম্বন্ধে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন ....
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে উপস্থিত হয়ে এমন রসিকতা আর কোনো রসশ্রষ্ঠার পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এরপরে আমরা পেলাম বিশ্বনন্দিত এক সফল চলচিত্রকার কে, যার সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের অসাধারণ প্রয়োগ আমরা উপভোগ করেছি। জন্ম কলকাতায় ২ মে ১৯২১ সালে।সত্যজিৎ পরিচালনা করেছেন মোট ৩৭টি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে রয়েছে- অপুর সংসার, পরশপাথর, জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, চারুলতা, দেবী, মহানগর, অভিযান, কাপুরুষ, মহাপুরুষ, গুপী গাইন বাঘা বাইন, প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জনারণ্য, হীরক রাজার দেশ, গণশত্রু, আগন্তুক, শাখা-প্রশাখা, সোনার কেল্লা, জয়বাবা ফেলুনাথ প্রভৃতি।
তার পরিচালিত অশনিসংকেত সিনেমায় বাংলাদেশের অভিনেত্রী ববিতা অভিনয় করেন। তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ডের ডিলিট পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্স সরকার সত্যজিৎ রায়কে সেদেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। সত্যজিৎ রায় নির্মিত প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কারটি।
এছাড়াও তিনি পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
অবশেষে সেই বিখ্যাত চলচিত্র 'রোমান হলিডে'র সুন্দরী রাজকুমারী 'এন্ড্রু হ্যাপ্বার্ন' সুদূর আমেরিকা থেকে উড়ে এলেন বেলভিউ নার্সিং হোম এ অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকা সত্যজিৎ রায়ের জন্যে 'অস্কার' পুরস্কার টি হাতে নিয়ে।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই দিকপাল ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার :
শিল্পের একই ধারায় পর পর তিন পুরুষের সৃষ্টির স্ফুরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আমার মনে হয়না আর আছে।এইভাবেই বয়ে গিয়েছে সাহিত্য প্রবাহ ওপর বাংলা থেকে এপার বাংলা অর্থাৎ কিশোরগঞ্জ থেকে কলকাতা।
টিকা :
তোমরা তিনজনেই মহারাজা
তোমাদের করি সেলাম।
আসরের সব কবিকে জানাই আমার অন্তরের প্রীতি ও শুভেচ্ছা।