কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন দক্ষ কবি যাকিছু সুক্ষভাবে তুলে ধরেন কবিতায়, সেসবের মধ্যে চিত্রকল্প অন্যতম। উত্তরাধুনিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো চিত্রকল্প।কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার শরীর জুড়ে উপমার চেয়ে চিত্রকল্পের সমাহার বেশি। আগে কবিতায় চিত্রকল্পের জন্য কবি ছুটে যেতেন গ্রামে। আর এখন কবিতার চিত্রকল্প হয়ে গেছে নগরকেন্দ্রিক। তাই বাগানের ফুলকে কবি আনেন ড্রয়িংরুমে। সময়ের দাবিকে মেনে নিতে হবে। জীবনধারা যেমন সময়ের আবর্তনে ভাঙে ও গড়ে, ঠিক একইভাবে কবিতা নির্মাণ ভাঙে ও গড়ে।আর তাই থেকে সৃষ্টি হলো আধুনিক কবিতা।কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায় সেই কবিতা নির্মাণও সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন।বাংলা কবিতা এক সময় তার দেহকে সাজানোর জন্য আশ্রয় নিত চিরাচারিত সবুজের কাছে। সভ্যতার ক্রমশ উন্নয়নের ফলে কবিতা যদিওবা হয়েছে নগরকেন্দ্রিক, কিন্তু তাই বলে তার লাবণ্য এতুটুকু কমে যায়নি। ভাবুন, গোলাপের বাগান আর ড্রয়িংরুমের দৃশ্যাবলি কেমন। শহরের ড্রয়িংরুমগুলো সাজানো হয় অনেকটা কৃত্রিম বাগানের আদলে। বিভিন্ন ধরনের টবে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফুল। এখানে কৃত্রিমতাই সম্বল। কিন্তু গ্রামের বাগানের যে দৃশ্যাবলি তা শান্তি দায়ক, স্বস্তিদায়ক। চিত্রকল্প কবিতাকে রসোত্তীর্ণ ও লাবণ্যময় করে গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
একটু উদাহরণ দিই.............
শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতার এক দিকপাল। এই কবির কবিতায় ফুটে ওঠে নগর জীবনের জীবন জটিলতা, হতাশা, ক্লেদ-ক্লান্তি, দুঃখ-বেদনা ও বিচিত্র জীবন-যন্ত্রণার দিকগুলো চিত্রকল্পের মাধ্যমে;
‘রুটির দোকান ঘেঁষে তিনটি বালক সন্তর্পণে
দাঁড়াল শীতের ভোরে, জড়সড়। তিন জোড়া চোখ
বাদামি রুটির দীপ্তি নিলো মেখে গোপন ঈর্ষায়।
রুটিকে মায়ের স্তন ভেবে তারা, তিনটি বালক
তৃষিত আত্মাকে সঁপে সংযত লোভের দোলনায়,
অধিক ঘনিষ্ঠ হলো তন্দুরের তাপের আশায়'
মুহূর্তে এক অন্যরকম মুগ্ধতায় কবির কবিতা চিনিয়ে দেয় তার বাক্য-বিন্যাসের দক্ষতা, শব্দ, উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণের দক্ষতা।
আধুনিক বোধের কারণে বাংলা কবিতার যে বিকাশমান ধারা ক্রমশ অসামান্য হয়ে উঠছে, সেসবের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো চিত্রকল্প।নিত্যনতুন করে ভাবতে হয় কবিকে ।
কবি আবিদ আজাদের কবিতার চিত্রকল্প অসাধারণ ;
‘মেঘের আলমারি ভরে তুমি মগ্ন সারা দিনমান
বিদ্যুৎ চমকগুলো সাজিয়ে রেখেছে থরে থরে।’
কবির এই যে চমক জাগানো বর্ণনা সত্যিই আমাদের চোখ ও মন বাস্তবিক বিদ্যুতের মতো চমকে ওঠে। এখানেই একজন কবির সার্থকতা।কবিতায় কবির উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাকে বৈচিত্র্য দানের প্রয়োজনেই চিত্রকল্পের জন্ম৷
জীবনানন্দ .............
' চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য'
রবীন্দ্রনাথ .........
অাঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে
অাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি
পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা
অনাঘ্রাতা পূজার ফুল দুটি৷
তাই চিত্রকল্প কবিতার একটি মৌলিক উপাদান৷ সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত ৷ কবিতার চিত্রকল্প ঝাপসা হলে, তা পড়ে উপমার সমুদ্রে খেই হারিয়ে ফেলেন পাঠক৷ তখন কবিতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় দুর্বোধ্য কবিতা হিসেবে ৷ যদিও কেউ কেউ নিজেকে ছান্দসিক কবি ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভে আটখানা হন৷ একজন কবি চোখ খোলা রেখে অনেক কিছু দেখতে পায়৷ আবার চোখ বন্ধ করেও অনেক কিছু দেখতে পায়৷ একথা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি৷ কিন্তু হৃদয়ের চোখের আয়নায় দাঁড়াতে পারি কজন? কবিতার কল্পচিত্র সব সময়ই বিশ্বজনীন এবং সার্বজনীন|