আসুন আজ সবাই মিলে একটু আড্ডার ছলে গল্প করি, আর কঠিন জীবনের ফাঁকে মনন বিকাশের দ্বারা
কর্মপ্রবাহের ধারাবাহিকতার মাঝে কবি ও কবিতা শিল্প নিয়ে রুচিশীল পাঠক তৈরির লক্ষে কবিতা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মিলন ঘটাতে সচেষ্ট হই।

আজকে আনছি দুনিয়া কাঁপানো উপন্যাস 'ডাক্তার জিভাগো' ও 'জিভাগো কবিতা গুচ্ছ' নিয়ে কিছু প্রতিবেদন।
উপন্যাসটির নাম শোনেন নি অথবা উপন্যাস টির ওপর বিখ্যাত চলচ্চিত্র টি দেখেন নি এ রকম ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া ভার। উপন্যাস টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বভাবতই বেশ কয়েকটি নাম এসে পড়ছে। অবশ্যই এই উপন্যাস ও পরিশিষ্টে মোট ২৪ খানা কবিতা গুচ্ছ দিয়ে যিনি এই উপন্যাসটির অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে আলপনা এঁকেছেন তাঁর নাম কে না জানে? রুশ সাহিত্যের বিখ্যাত কবি,ঔপন্যাসিক এবং অনুবাদক বরিস লেওনিডভিচ পাস্তেরনাক। তাঁর রচনার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় খুবই কম।তাঁর কারণ রুশ ভাষা না জানা। সেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো আমাদের নির্ভর করতে হয় অনুবাদের ওপর। আর এই স্বাদ বাংলা ভাষায় আমাদের মধ্যে এনে দিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে মীনাক্ষী বসু(দত্ত) ও বিখ্যাত সাহিত্যিক মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় আর বাকি ২৪ টি কবিতার অনুবাদ করেছেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বইটির অনুবাদ করেন মীনাক্ষী দত্ত। কবিতাগুলোর অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন বুদ্ধদেব বসু।উপন্যাসে যে-সব মানবিক অনুভূতির কথা ছড়িয়ে আছে তা পরিশিষ্টে সংযোজিত চব্বিশটি কবিতার মধ্যে আরও সুন্দরভাবে পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিচিত্রমুখী স্রষ্টার নাম করতে গেলে প্রথমেই এসে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর কথা। তাঁর মূল পরিচিতি কবি হিসেবেই। কিন্তু কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনি, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা— সাহিত্যের এই বিভিন্ন ধারায় সর্বতোমুখী অভিযানে বুদ্ধদেব অবশ্যই অনন্য। এর প্রত্যেকটি ধারায় তাঁর চেয়ে কৃতী স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু এতগুলি শাখায় প্রায় সমান দক্ষতা নিয়ে বিচরণ করার মতো ক্ষমতা রবীন্দ্র-পরবর্তী খুব কম লেখকের মধ্যেই লক্ষ করা গেছে। বস্তুত তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টাতেই সেদিন নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছেন ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশ-এর মতো কবি। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা চালিত না হয়ে শিল্পগুণকেই লেখার প্রকাশযোগ্যতার একমাত্র শর্ত বলে গণ্য করতেন তিনি।
প্রথমেই বলেছি এটা একটা গল্পের ছলে আড্ডার আলোচনা, তাই ডাক্তার জিভাগো'র অনুবন্ধী দের আমি এই আলোচনায় আনবো।  

তাই আসুন একটু পরিচয় করিয়ে দিই মীনাক্ষী দত্তের স্বামী জ্যোতির্ময় দত্ত'র সঙ্গে। জ্যোতির্ময় দত্ত (জন্ম ১৯৩৬) হলেন লেখক, কবি, সাংবাদিক এবং প্রবন্ধকার। তাঁর ২ টি কাব্যগ্রন্থ, একটি ছোট গল্প গ্রন্থ, প্রবন্ধ সঙ্কলন এবং একাধিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। স্টেটসম্যান পত্রিকায় তিনি সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৬-১৯৬৮ সনে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
সঙ্গে শুনুন মীনাক্ষীর এক স্মৃতি-আলেখ্য গল্প:-
জ্যোতির্ময় দত্ত একবার ডিঙিনৌকোয় সাগরপাড়ি দেন। ফিরে এসেই লেগে পড়েন গঙ্গাবক্ষে একটি ভাসমান রেস্তোরাঁ তৈরিতে। সে-রেস্তোরাঁর নাম দেন 'কনটিকি'। সেকালে খুব নাম করেছিল কলকাতার এই নতুন জিনিসটি।  কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভিড় লেগেই থাকত সেখানে। যার কেন্দ্রে ছিলেন  শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যাঁকে ছাড়া ভাবাও যেত না কনটিকিকে।স্বভাবতই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর কথাও এসে পরে।  এই সব স্বনামধন্য সাহিত্যিকরা মিলে ওখান থেকে এক পত্রিকা বার করলেন নাম "মরুপথিক" । একটি সংখ্যা তে মীনাক্ষী দত্তের একটি স্মৃতিচারণ আপনাদের শোনাই। "সে সন্ধ্যায় ঝড় উঠেছিল, নৌকার মোটা বনাতের পর্দা ভেদ করে আসছিলো হাওয়া ও জলের ছাট। নৌকা প্রায় কাত হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় গেয়ে চলেছে একটার পর একটা গান।উপস্থিত প্রায় জনা পঁচিশ অভ্যাগত, কিন্তু কেওই ভয় পাননি। শক্তির সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল সুনীল।"

চলুন এবারে বড়ো গল্পটাকে ছোট করে বলার চেষ্টা করি। এবারে সরাসরি চলে যাবো মহীরুহ কবি বরিস পাস্তেরনাক এর ডাক্তার জিভাগো নিয়ে আলোচনায়। মস্কো শহরে ১৮৯০ সালে এই মহাকবির জন্ম। হটাৎ একটা কথা মনে জাগলো। আমাদের মহীরুহ কবি নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে আর কবিগুরুর জন্ম ১৮৬১ সালে। ফ্রান্সের মহাকবি বোদলেয়ারের জন্ম ১৮২১ সালে, মাস্টারপিস টি এস এলিয়টের জন্ম ১৮৮৮ সালে ইত্যাদি।লক্ষ করে দেখুন যত জিনিয়াস কবিদের জন্ম এই একই শতাব্দীতে। যাক, এবারে আসি আসল কথায়। ডাক্তার জিভাগোর অসম্ভব ভালো অনুবাদ করেছেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব তনয়া মীনাক্ষী।
ডাক্তার জিভাগোর দুটি মূল চরিত্র। ডাক্তার জিভাগোর বিবাহিত স্ত্রী টোনিয়া আর নার্স লারা। স্ত্রী টোনিয়াকে অবশ্যই ভালোবেসে ছিলেন জিভাগো। কিন্তু তাঁর জীবনে কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো এসেছিলো নার্স লারা। কিন্তু লারা তো বিবাহিত। তাঁর স্বামীর জানিনা কেন মনে হয়েছিল লারার ভালোবাসা বড্ড বেশি মহৎ, তাই তিনি ছিলেন অনেক দূরে বিচ্ছিন্ন স্বেচ্ছায়।জিভাগোর মানসলোক যে ভাষায় জীবনের অর্থ খোঁজে সে কবিতা।
বাংলা অনুবাদের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরলাম:-

লারার প্রতি জিভাগো তাঁর সর্বগ্রাসী ভালোবাসা জানাতে যে ভাষা বলে উঠেছে..........  
১)"আমার হিংসে হয় লারার চুলের বুরুষটিকে,তোমার গায়ের ঘামের বিন্দুটিকে, যে বাতাসে তুমি শ্বাস নাও তাঁর বীজাণুগুলো,যা তোমার রক্তে মিশে তাকে বিষাক্ত করে তুলতে পারে সেগুলোকেও হিংসে হয় আমার।"

২)  জিভাগোর স্ত্রী টোনিয়া হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।সদ্য তাদের একটি সন্তান জন্মেছে।মা ও বাচ্চার সংক্রামণের ভয়ে এখন কাছে যাওয়া যাবেনা। জিভাগোর কবিমন কি ভাবছে?
"  এক ভেলা যেন টোনিয়া,মৃত্যুর নদীর ওপর দিয়ে এক অজানা দেশ থেকে জীবনের মহাদেশে দেশান্তরী আত্মা বহন করে নিয়ে এসে বন্দরে বিশ্রাম নিচ্ছে। এইমাত্র নামলো ওই আত্মাদের একজন; শূন্যগর্ভ জাহাজ নোঙ্গর বেঁধে বিশ্রাম নিচ্ছে। তাঁর পরিশ্রান্ত মাস্তুল আর গলুই,তাঁর সমস্ত সত্তা এখন বিশ্রান্ত,আর তাঁর স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুছে গেছে সেই অন্য তীরের ছবি,সে ভুলে গেছে তার নদী পার হওয়া,তার তীরে এসে নোঙ্গর বাঁধার কথা ভি যে দেশে সে তার পতাকা উড়িয়ে এলো ,সে দেশে আর কেও যায়নি , তাই এখন তার সঙ্গে কথা বলার ভাষা কেও জানেনা।"    

এমনি কবিত্ব আর এমনি আত্মবিশ্লেষণ।
যে উপন্যাস লিখে তিনি বিশ্ববিখ্যাত হলেন, যে উপনাস্যের জন্যে তিনি  পেলেন নোবেল পুরস্কার, তাকে কেন্দ্র করে চললো বিক্ষোভ ও আন্দোলন সারা সেভিয়েট দেশে ।  সরকারের প্রচন্ড চাপে শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ত ধীকৃত  হয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হলো নোবেল পুরস্কার। অপমান, অবজ্ঞা কঠিন হয়ে বাজলো তার হৃদয়ে ও মনে। সেই সময়ে তাঁর চরম বেদনা ক্ষরিত করলেন "নোবেল প্রাইজ" নামক কবিতায়।

আমি যেন এক খাঁচায় বদ্ধ জন্তু।
স্বস্থ, স্বাধীন আলোকে আনন্দিত
আজো কোনোখানে রয়েছে মানুষ -কিন্তু
আমি পরিবৃত শিকারির পদশব্দে।

কিন্তু বলতো কি আমার দুষ্কৃতী?
আমি কি দস্যু? অথবা পিশুন ধূর্ত?
মাতৃভূমির রূপের পুণ্যস্মৃতি
জাগিয়ে , যে-আমি জগতে করেছি আর্ত?
(অনুবাদ - বুদ্ধদেব বসু)

তবু সেভিয়েতন্ত্রের বিরুদ্ধতাকে প্রশমিত করা অসম্ভব হলো। সেভিয়েট সাহিত্য সংঘ থেকে বিতাড়িত হলেন তিনি। যে উপন্যাস রাশিয়ার কেও পড়তে পেলো না সেটিই হয়ে উঠলো তাঁর কলঙ্কচিহ্ন,তাঁর নিন্দনীয়তার নিদর্শন। এই দুঃশীলতার প্রতিবাদে বহু কণ্ঠ ধ্বনিত হলো অন্যান্য দেশে ও মহাদেশে ।  বহু প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও মনীষী তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমবেদনা জানালেন।কবি পাস্তেরনাকের পক্ষে এ যে কত বড়ো বেদনা আশাকরি কবি হিসেবে এখানে কাওকে আলাদা করে বলে দিতে হবেনা।
এই অদ্ভুত এক সংকট ও পরিস্থিতি থেকে অবশেষে তিনি মুক্তি পেলেন ঈশ্বরের মৃত্যু করুণা পেয়ে। ৩০শে মে ,১৯৬০ সালে ফুসফুসের ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগভোগের পর এমন একটি জীবনের অবসান হলো, যার সাধুতা, সৃষ্টিশীলতা, মনুষ্যত্বের একটি উদাহরণ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পেরেডিলকিনো গ্রামে, যেখানে তিনি কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ কুড়িবছর, সেখানেই এই মহীরুহ কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর বাড়ির জানালা থেকে দেখা যেত একটি কবরখানা, তাঁর মধ্যে অবস্থিত একটি নীলবর্ণ গির্জার ক্রুশচিহ্ন অনবরত তাঁর চোখে পড়তো; সেখানেই যেন তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় সে ইচ্ছা তিনি অনেকবার প্রকাশ করেছিলেন। ভাবতে ভালো লাগে যে কবির এই অন্তিম আকাঙ্খা অপূর্ণ থাকেনি । পাস্তেরনাক শেষ জীবনে যীশু কে আবিষ্কার করেন। এক পত্রিকায় তাঁর মুখের একটি প্রকাশিত লেখা থেকে জানা যায় যে তিনি বলেছিলেন "খ্রিস্ট এসেছিলেন আমার কাছে ।  তাঁকে না পেলে এ যুগের যন্ত্রনা আমি সহ্য করতে পারতাম না।

উপসংহার।:-
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আরাম্ভকালে,যখন রুশ মনীষীরা একটি মুক্তির হাওয়া অনুভব করছিলেন, তখনই 'ডাক্তার জিভাগো' লেখার পরিকল্পনা তাঁর মাথায় আসে। পরবর্তী দারুণ দুঃসময়ে প্রকাশের আশা প্রায় না রেখে, নিজের নির্জনতার মাঝে এই উপন্যাস টি রচনা করেন। জিভাগোতে আছে বিপ্লবের রাজনীতির কথা, অবিশ্বাসের রাজনীতি, বিশ্বাসঘাতকতা ,আশা আর আশাভঙ্গ । আছে তাতে ভালোবাসা, দায়িত্ব,দর্শন এবং অসম্ভব কিছু মনস্তত্ব। এ সবের কেন্দ্রে লুকিয়ে আছে তাঁর কবিসত্ত্বা। সময় আর রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট কিছু মানুষ। পাস্তেরনাক নিজে একজন কবি, তাই জিভাগো কবি। কবি সব কিছু ফাঁকি দিতে পারেন কবিতাকে নয়। পাস্তেরনায়েকের নিয়তি তাঁকে সত্তর বছর ধরে সৃষ্টিশীল রেখেছিলো।

ধন্যবাদ .....
আমার এই আগাছা ভরা লেখার বাগানে যদি কেও ভুল করে ঢুকে পড়েন, দু-একটা বনফুল পেতেও পারেন।
তাই যারা আমার বাগানে বেড়াতে এলেন তাদের আগাম ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা, প্রীতি ও ভালোবাসা জানাই।

এই আলোচনা লিখতে গিয়ে দুটি বইয়ের সাহায্য নিয়েছি
১) 'ডাক্তার জিভাগো'--মীনাক্ষী দত্ত ও মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়
২) দেশ-দেশান্তরের কবিতা - অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু      

টিকা :
বিশ্বাস করুন বা নাই করুন বইটি প্রকাশের পরে দুই দশকে মোট প্রায় পাঁচ মিলিয়ন পাঠক বইটি কিনেছিলেন।
আসুন আমরা সবাই মিলে এই মহাকবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কবিগুরুর সুরে সুর মিলিয়ে বলি .....  

এই          ক্লান্ত ধরার শ্যামলাঞ্চল-আসনে

     তোমায়     করি গো নমস্কার।

এই          স্তব্ধ তারার মৌনমন্ত্রভাষণে

     তোমায়     করি গো নমস্কার।

এই          কর্ম-অন্তে নিভৃত পান্থশালাতে

     তোমায়     করি গো নমস্কার।

এই          গন্ধগহন-সন্ধ্যাকুসুম-মালাতে

     তোমায়     করি গো নমস্কার।