বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম একটি নাম বুদ্ধদেব বসু।  দ্বিধাহীনচিত্তে আমি বলবো যে বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের এক অপরিহার্য শিল্পী। বুদ্ধদেব বসুর লেখার পদ্ধতি বাংলা সাহিত্য কে দিয়েছে এক বিস্ময়কর অনুভূতি ও আস্বাদ। তাঁর কবিতার সূক্ষাতিসূক্ষ ব্যঞ্জনা যে অনুরণন তোলে , তা পাঠকের মনে ম্যাজিকের মতো সরাসরি প্রবেশ করে। কারণ তিনি ছিলেন তাঁর হৃদয় তন্ত্রীতে এক সৃষ্টিশীল কবি। অন্য ভাষার কবিতাকে তিনি নিজস্ব সৃষ্টিকর্মে রূপান্তরিত করেছেন। যতবার তাঁর কবিতা পড়ি রোমাঞ্চিত বোধ করি।

বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়। জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৯০৮।মৃত্যু ১৮ মার্চ ১৯৭৪।
বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সচ্চিদানন্দ ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা শুরু।  ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন।  ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে  ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন।  ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি ২০২২ এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে।

তাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিক কবিতার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং 'আধুনিক' কবিতা লেখকদের পক্ষ সমর্থন করা। অনুবাদ কবিতার মধ্যে আছে সংস্কৃত শ্লোক , সুইডিশ কবিতা, রাশিয়ান কবিতা, মার্কিনি কবিতা, ইংরেজি কবিতা, ফরাসি কবিতা, চিনে কবিতা, জাপানি কবিতা, আরবি কবিতা।
কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি চেষ্টা করতেন ভাষার দ্বারা কিছু গড়ে তোলার। অনুবাদ করেছেন বোদলেয়ার, রিলকে,হোল্ডারলিন, ও কালিদাসের 'মেঘদূত' । সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন তা হলো রাশিয়ান কবি বরিস পাস্তেরনাকের 'জিভাগো' উপন্যাসের সঙ্গে সংযুক্ত কবিতা গুচ্ছের অনুবাদ।


দুনিয়া কাঁপানো উপন্যাস 'ডাক্তার জিভাগো' ও 'জিভাগো কবিতা গুচ্ছ' । উপন্যাসটির নাম শোনেন নি অথবা উপন্যাস টির ওপর বিখ্যাত চলচ্চিত্র টি দেখেন নি এ রকম ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া ভার। এই উপন্যাস ও পরিশিষ্টে মোট ২৪ খানা কবিতা গুচ্ছ দিয়ে যিনি এই উপন্যাসটির অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে আলপনা এঁকেছেন তাঁর নাম কে না জানে? রুশ সাহিত্যের বিখ্যাত কবি,ঔপন্যাসিক এবং অনুবাদক বরিস লেওনিডভিচ পাস্তেরনাক। তাঁর রচনার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় খুবই কম।তাঁর কারণ রুশ ভাষা না জানা। সেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো আমাদের নির্ভর করতে হয় অনুবাদের ওপর। আর এই স্বাদ বাংলা ভাষায় আমাদের মধ্যে এনে দিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে মীনাক্ষী বসু ও বিখ্যাত সাহিত্যিক মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় আর বাকি ২৪ টি কবিতার অনুবাদ করেছেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বইটির অনুবাদ করেন মীনাক্ষী । কবিতাগুলোর অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন বুদ্ধদেব বসু।উপন্যাসে যে-সব মানবিক অনুভূতির কথা ছড়িয়ে আছে তা পরিশিষ্টে সংযোজিত চব্বিশটি কবিতার মধ্যে আরও সুন্দরভাবে পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিচিত্রমুখী স্রষ্টার নাম করতে গেলে প্রথমেই এসে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর কথা। তাঁর মূল পরিচিতি কবি হিসেবেই। কিন্তু কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনি, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা— সাহিত্যের এই বিভিন্ন ধারায় সর্বতোমুখী অভিযানে বুদ্ধদেব অবশ্যই অনন্য। এর প্রত্যেকটি ধারায় তাঁর চেয়ে কৃতী স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু এতগুলি শাখায় প্রায় সমান দক্ষতা নিয়ে বিচরণ করার মতো ক্ষমতা রবীন্দ্র-পরবর্তী খুব কম লেখকের মধ্যেই লক্ষ করা গেছে। বস্তুত তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টাতেই সেদিন নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছেন ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশ-এর মতো কবি। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা চালিত না হয়ে শিল্পগুণকেই লেখার প্রকাশযোগ্যতার একমাত্র শর্ত বলে গণ্য করতেন তিনি।


জিভাগোর একটি কবিতার অনুবাদ - বুদ্ধদেব বসু
কবিতার নাম  "নোবেল প্রাইজ"

আমি যেন এক খাঁচায় বদ্ধ জন্তু।
স্বস্থ, স্বাধীন আলোকে আনন্দিত
আজো কোনোখানে রয়েছে মানুষ -কিন্তু
আমি পরিবৃত শিকারির পদশব্দে।


কিন্তু বলতো কি আমার দুষ্কৃতী?
আমি কি দস্যু? অথবা পিশুন ধূর্ত?
মাতৃভূমির রূপের পুণ্যস্মৃতি
জাগিয়ে , যে-আমি জগতে করেছি আর্ত?

কি কবিত্ব আর কি সুন্দর আত্মবিশ্লেষণ। যে উপন্যাস লিখে তিনি বিশ্ববিখ্যাত হলেন, যে উপনাস্যের জন্যে তিনি  পেলেন নোবেল পুরস্কার, তাকে কেন্দ্র করে চললো বিক্ষোভ ও আন্দোলন সারা সেভিয়েট দেশে ।  সরকারের প্রচন্ড চাপে শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ত ধীকৃত  হয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হলো নোবেল পুরস্কার। অপমান, অবজ্ঞা কঠিন হয়ে বাজলো তার হৃদয়ে ও মনে। সেই সময়ে তাঁর চরম বেদনা ক্ষরিত করলেন "নোবেল প্রাইজ" নামক কবিতায়

উপসংহার :-
বুদ্ধদেব বসু অবয়বে নয়, অনুভবে পেতেন কবিতাকে। তাঁর অসাধারণ কবিতাগুলি তাঁকে এক উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর কবিতা গুলোর মধ্যে পাই পাঠকদের সঙ্গে এক আত্মিক যোগাযোগ। কবিতা শিল্পের এবং কবির স্বাধীনতায় সবসময় বিশ্বাস করতেন তিনি।  কুড়ি  ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন। ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরী করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু’টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম।

ধন্যবাদ। .......
যারা আমার বাগানে বেড়াতে এলেন তাদের আগাম ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা, প্রীতি ও ভালোবাসা জানাই।