সালটা ১৯৬২। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বয়স তখন তিরিশের কাছাকাছি। সবে কেরানিগিরির একটা চাকরি পেয়েছেন। বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন কলকাতার সার্কুলার রোডের কোনো এক বাস স্টপে। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর কবি কল্পনার এক  অজানা অনুভূতি সেই বাস স্টপে জন্ম দিলো নীরা'র।  আর বাঙালি পাঠকের কাছে সেই নীরা হয়ে উঠলো অত্যন্ত আদরের আর একান্ত আপন।  


বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
                                   স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।
......................................

বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,
                                   বাড়িতে আসবেন!’

রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।
‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্‌টের দরজায়।

বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।।

পাঠকের হৃদয়ে নীরা কে পৌঁছে দেবার জন্যে সুনীল অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন সারাটা জীবন তাঁর বিভিন্ন কবিতা ও গল্পের মাধ্যমে।
পাঠকের অবশ্যই জানা প্রয়োজন তাঁর সক্ষিপ্ত পরিচয়।

জন্ম ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪
মাদারীপুর মহকুমা, ফরিদপুর, মাদারীপুর জেলা, ঢাকা, বাংলাদেশ
মৃত্যু ২৩ অক্টোবর ২০১২ (বয়স ৭৮)
কলকাতা।
ছদ্মনাম: নীললোহিত, সনাতন পাঠক, এবং নীল উপাধ্যায়

সুনীলের মৃত্যুর সঙ্গে নীরার ও মৃত্যু হলো। প্রতিটি বাঙালি প্রেমিক ও কবির মনে বাস করে একজন নীরা। আর তার থেকে সৃষ্টি হয় কালজয়ী সব কবিতা।

সুনীল নিজেই বলেছেন।....

'একথা সঠিক নীরার সঙ্গে
পথে পথে আমি ঘুরিনি
আমায় একলা বিকেলবেলায়
নীরাকে পাইনি কখনো। '

আবার চলন্ত ট্রামের জানলা থেকে নীরাকে দেখলেন। ..........

"বৃষ্টির মধ্যে তুমি চৌরাস্তায়
ট্যাক্সি খোঁজাখুঁজি করছিলে নীরা
আমি তখন চলন্ত ট্রামের জানলায় '

ঠিক একইভাবে কবিগুরু দেখেছিলেন 'কমলা' কে তাঁর ক্যামেলিয়া কবিতায়।

'নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।'

আবার সুনীল উদ্বিগ্ন নীরার অসুখ হলে।

"নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে?
গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্য–ওরা জানে
নীরা আজ ভালো আছে!
অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে মুখে রটে যায়
নীরার খবর
বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়, নীরা আজ খুশি

কলকাতার সব লোক মৃদু হাস্যে জেনে নেয়, নীরা আজ বেড়াতে গিয়েছে।

আবার লিখলেন। .....

“এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি,নীরা
এ-কবিতা মধ্যরাতে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে
ঘুমের ভেতরে তুমি আচমকা জেগে উঠে
টিপয়ের জল খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে এক মুহূর্ত ভাববে
কে তোমার কথা মনে করছে এত রাত্রে...”

সুনীল নামক এই প্রেমিক পুরুষটি সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর নীরাকে।  নীললোহিত সৃষ্টি করেছেন এমন অনেক কবিতা যাদের সাথে আমরা নিজের অজান্তে মিশে যাই।

প্রিয় লেখকের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু কথা এখানে তুলে ধরলাম।

" মেয়েদের কাছে সুনীল ভারী প্রিয় –এ কথা সবাই জানে। মেয়েরা ওর জীবনে এসেছে।...

যদি অন্য কোনো নারীকে ওর ভালো লেগেও থাকে, ও আমাকে কখনো তার সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। আমি রাগ করেছি, কারো নাম করে প্রশ্ন করেছি ওকে। কিন্তু ও কখনো আমাকে কারো নাম বলেনি। আমি মানুষ, আমারও অভিমান হতো। অনেকভাবে আমি রাগ দেখিয়েছি, ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। আবার এ-ও জেনেছি যে, আমার প্রতি সুনীলের যে ভালোবাসা আছে, বিশ্বাস আছে, আমাদের যে সম্পর্ক আছে, তা নষ্ট হওয়ার নয়। সে ভালোবাসা অনেক কিছুর উপরে।"

সুনীল লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। তরুণ বয়সে পাশের বাড়ির একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে কিছুতেই তার ভালোবাসার কথা বলতে পারছিলেন না। অতঃপর সেই মেয়েটিকে নিয়ে একটি কবিতা লেখেন তিনি। মেয়েটিদের বাসায় দেশ পত্রিকা রাখা হতো। সুনীল তার কবিতাটি দেশ পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন এবং একদিন সেটা ছাপাও হয়। কিন্তু কবিতা ছাপা হলে কী হবে? মেয়েটি তখন কিছুতেই বিশ্বাস করেনি যে, এটি সুনীলের লেখা কবিতা। সে বলতো, এ নামের অন্য কেউ এ কবিতাটি লিখেছে।

নিজের লেখক হওয়ার বিষয়ে সুনীল তার একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি লেখক কিংবা কবি হওয়ার পেছনে ওই মেয়েটির কাছে ঋণী। সে কবিতা পছন্দ করতো বলেই আমি কবিতা লিখেছিলাম। সে যদি খেলাধূলা বা অন্যকিছু পছন্দ করতো তাহলে আমি হয়তো তা-ই হতে চাইতাম।’

তবে এ মেয়েটি-ই নীরা কি না এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কখনো কিছু বলেননি তিনি। তার কবিতার নীরাকে তিনি আড়ালেই রেখেছেন সারাজীবন।

উপসংহার :-
কবিতা ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। আর এই কবিতার হাত ধরেই পাঠক পেয়েছে সুনীলের নীরাকে।  
"এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
এ হাতে আমি কি কোনো পাপ করতে পারি? "

তার কাছে যেন নীরা নিজেই নীরার তুলনা।
"নীরা তোমায় দেখে হটাৎ নীরার কথা মনে পড়লো "

নীরাকে পেতে গিয়েও পাওয়া হয়না সুনীলের, প্রবল আহ্বানেও ডাকতে গিয়েও যেন কথা চাপা পড়ে যায়।

টিকা :
নারী আর রানী শব্দ দুটোকে উল্টেপাল্টেই নাকি প্রয়াত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর 'নীরা' নামের মেয়েটিকে গড়ে তুলেছিলেন। নারী ও রানী কোনোটাই একজন কেরানি বাঙালির জীবনে সহজলভ্য নয়। বেকার জীবনের স্বাদ আহ্লাদ, হতাশা ভালোবাসার স্বাধীনতা এই সদ্য চাকরির দশটা -পাঁচটা মুছে দিতে পারেনি। সেই সময়েই লেখা নীরাকে নিয়ে তার প্রথম কবিতা "বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় স্বপ্নে বহুক্ষণ"
পাঠকের কাছে এই কবিতাটি ক্রমে ক্রমে প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুনীলের কবিতার নানা অনুষঙ্গে পরের সুদীর্ঘ বছরগুলিতে মাঝে মাঝে নীরা ফিরে আসে , ২০১২ পর্যন্ত্য। পঞ্চাশ বছর ধরে সুনীল দেখেছেন যেভাবে নীরাকে ঠিক সে ভাবেই তিনি দেখালেন তাঁর প্রিয় পাঠকদের।

ভালোবাসায় ভালো থাকুন আপনারা সবাই আমার প্রিয় আসরের পাঠকেরা।