"আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন
আমি স্রষ্টা-সুদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন"
কি অপূর্ব শব্দের ঝংকার!!
যেন রবিশঙ্করের আশাবরী রাগে সেতারের সুরের মুর্ছনায় কবিতায় প্রান সঞ্চারিত হলো। কোনো কবির সাহস আছে কি যিনি ভগবানের বক্ষে পদাঘাত করতে পারেন? হ্যাঁ পারেন একজন । তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল। একবার মুনিঋষিরা ভৃগু কে পাঠালেন ব্রহ্মা, শিব আর বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা জানবার জন্যে। বিষ্ণুর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখেন বিষ্ণু ঘুমাচ্ছেন। তখন তাকে জাগাতে তিনি তার বুকে লাথি মারেন। ঘুম ভেঙ্গে বিষ্ণু ভৃগুর এই ধৃষ্টতায় রাগান্বিত না হয়ে বিনয় প্রদর্শন করতে থাকলে, ভৃগু বিষ্ণুকে শ্রেষ্ঠ বলে মত দেন।
'বিদ্রোহী' কবিতার জন্ম ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কোনো এক গভীর রাতে লণ্ঠনের আলোয় একটি কাগজে পেন্সিলে লিখে। আঁতুরঘর এর ঠিকানা জানতে চান ? হ্যাঁ ৩/৪ সি তালতলা লেন, কলকাতা।
প্রথম শ্রোতা অবিভক্ত ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ।
তাঁর প্রধান সঙ্গী ও ৩/৪ সি তালতলা লেনের দোতলা বাড়িতে একতলার সহ ভাড়াটে কাজী নজরুল। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙতেই নজরুল তাঁকে এই 'বিদ্রোহী' কবিতাটি পড়ে শোনালেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামক সাপ্তাহিক কাগজে।
নজরুলের মানসিক অবস্থা তখন এমন ছিল যে শাসকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে ।বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে নজরুল ইসলাম কাল বৈশাখীর প্রলয়ংকর ঝড়ের মতো আকস্মিক আবির্ভাব। এ প্রতিভা ক্ষণপ্রভার মতো, এর প্রভাব বজ্রবিদ্যুতের মতো, এর ধ্বনি কখনো মন্দ্র, কখনো নির্ঘোষ।
ভারতের শৃঙ্খলমুক্তি সংগ্রামের তখন চলছে নবপর্যায় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯১৯-এ ইংরেজ জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যা করেছে সংখ্যাহীন নর-নারী-শিশু; ইংরেজের সেই বর্বরতার প্রতিবাদে আমাদের মহাকবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ঘৃণাভরে বর্জন করেছেন ইংরেজ দত্ত নাইট হুড্। ঠিক সেই সময়ে বাঙালির হাতে তুলে দিলেন ‘অগ্নি-বীণা’ কাজী নজরুল ইসলাম। রক্তে দোলা জাগানিয়া ‘বল বীর.. চীর উন্নত মম শির।'
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই তিনি বাঙালিকে চমকে দিয়েছিলেন, মাতিয়ে তুলেছিলেন।
বলতে গেলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশকাল থেকেই বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুলের ভাবোচ্ছ্বাসের তীব্র অভিব্যক্তি, শাসকদের বিরুদ্ধে কবির রোষাগ্নির দীপ্ত প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।কবিতাটিতে বিশ্বস্রষ্টার বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় রয়েছে।লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ ও সহানুভূতির জন্য এই কবিতায় তাদের পক্ষ নিয়ে সর্বপ্রকার নিপীড়নের অবসানের জন্য বিদ্রোহীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন কবি নজরুল। কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেন শরীরের রক্ত শুদ্ধ করে আওয়াজ তোলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহের দামামা বাজায় প্রতি মুহূর্তে।
"আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই; যাই চূর্ণি
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ
আমি আপনার তালে নেচে যাই আমি মুক্ত জীবনানন্দ"
কলকাতার তলতলা লেনের ৩/৪সি লেনের বাড়িটির কোন এক অন্ধকার ঘরে লন্ঠন জ্বালিয়ে কবি তাঁর চিন্তার ভ্রূণ কলমের কালির মধ্য দিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় ঢেলে গিয়েছিলেন, বর্ণমালায় একে একে গেঁথে গিয়েছিলেন সাড়া-জাগানো এই কবিতা।