পাড়ার মাঝখানে এক পুরনো পুকুর,
পাড়ের কোল থেকে ঝরে পড়া শেওলা—
আমার গায়ে লেগে থাকে সেই শেওলা,
যেন জন্ম থেকে পরিয়ে দেওয়া এক অদৃশ্য চিহ্ন।
বাবা বলতেন, "ওটা মুছে ফেলো,"
কিন্তু চিহ্ন তো মুছতে পারি না,
ওটা রয়ে যায় পুকুরের পানির মতো,
প্রতিদিন কাঁপে, প্রতিদিন স্থির হয়।

গলি থেকে ফেরে লাল-হলুদ শালপাতার থালা,
যা পূজোর পর ফেলে দেওয়া হয়।
আমার মধ্যেও জমা হয় ফেলে দেওয়া কথা,
যা কেউ শুনতে চায় না,
পুকুরের তলায় পড়ে থাকা কাদা যেমন,
যেমন ঝুলে থাকা ধানের আঁটি থেকে ঝরে পড়া শুকনো মাটি।

বইয়ের পাতায় লেখা "আমরা সবাই এক,"
কিন্তু প্রতিদিন শুনি ভিন্ন এক ভাষা।
আমার কণ্ঠের শব্দ ভেঙে যায়,
ঠাকুরঘরে প্রদীপ যেমন নিভে যায় বাতাসে।
ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডারে
বছরের পর বছর দেখি শুধু তারিখের মৃত্যু।

মাঠের শেষে পুরনো বটগাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে,
যার নিচে বসেছিলাম একবার,
বন্ধুদের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম,
কিন্তু হঠাৎই কেউ বলে উঠল—
"তুই তো হিন্দু!"
বটগাছটা যেন আরো গভীর হয়ে যায়,
তার শিকড় মাটির নিচে টেনে নেয় আমার শ্বাস।

প্রতিদিন সকালে মায়ের শঙ্খধ্বনি শুনি,
তাতে কোনো বিভেদ নেই, কোনো ঘৃণা নেই।
তবু বাইরে বেরোলে পায়ের তলায় পড়ে থাকে
ভাঙা কাঁচের টুকরো, যা কেটে দেয় পায়ের তলা।
আমার শরীরে রক্তের চিহ্ন পড়ে,
ঠিক যেমন দেশজুড়ে রয়ে গেছে চিহ্ন,
যা কেউ মোছেনি, কেউ মুছবে না।

হিন্দু হওয়ার দাগ
আমার অস্তিত্বের কালো ছাপ,
সর্বদা মনে করি,
আমি বাংলার এক অপরাধী।
জন্মের সাথে জন্মেছে এই পাপবোঝা,
এই দেশের অভিশপ্ত সন্তান, আমি।