এখানে সম্মানিত পাঠকগণের জন্য কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রদত্ত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সম্বন্ধীয় একটি আলোচনা কোনরকম কাটছাট ছাড়াই তুলে ধরা হলো। আলোচনাটি যদিও একটু দীর্ঘ বটে, তথাপি আমার অনুরোধ রইলো, একটু ধৈর্য সহকারে কষ্ট করে পড়লেই - অক্ষরবৃত্ত ছন্দটি অনায়াসেই গিলে নেওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক সম্বন্ধে দু’টি কথা যা না বললেই নয়: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী – একজন ভারতীয় বাঙালি কবি। জন্ম – ১৯ অক্টোবর, ১৯২৪। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভুত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম। “উলঙ্গ রাজা” তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্হ। এই কাব্যগ্রন্হ লেখার জন্য তিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
আলোচনাটি লেখকের জবানিতেই উপস্থাপন করা হলোঃ
আপনারা ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছেন যে, বাংলা কবিতার ছন্দ মোটামুটি তিন রকমের। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত। শুধু যে তাদের নামই আপনারা জেনেছেন তা নয়, চেহারাও দেখেছেন। কিন্তু সে-দেখা নেহাতই এক লহমার। তার উপরে নির্ভর করে কি আর কবিতা লিখতে বসে যাওয়া যায়? তা ছাড়া আমরা সেকেলে মানুষ। আমরা পাত্রী দেখতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মেয়ের দাঁত উঁচু কি না, খড়ম-পা কি না, হাত কাঠি-কাঠি কি না, খোঁপা খুলে দিলে চুলের ঢাল কোমর ছাড়িয়ে নীচে নামে কি না, হাসলে পরে মুক্তো না ঝরুক, গালে টোল পড়ে কি না, সব দিকে আমাদের নজর থাকত। এমনকি, “একবার হাঁটো তো মা’, বলে এক বারের জায়গায় পাঁচবার হাঁটিয়ে নিয়ে তার চলনের ভঙ্গিটিও আমরা দেখে নিতাম। সুতরাং ছন্দকেই বা আমরা অল্পে ছাড়ব কেন? আসুন, সেকালে যেভাবে পাত্রী দেখা হত, ছন্দকেও সেইভাবে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখা যাক।
প্রথমেই দেখব অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে। শুধু যে দেখব তা নয়, তার কুলশীলমান, গোত্ৰমেল ইত্যাদিরও একটু-আধটু খোঁজ নেব। এসব ব্যাপারে অল্পে তুষ্ট হওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।
নাম আছে। যথা, অক্ষরমাত্রিক, বর্ণমাত্রিক ইত্যাদি। অক্ষরবৃত্ত নামটা শ্ৰী প্ৰবোধচন্দ্র সেনের দেওয়া। তা ছাড়া তিনি একে যৌগিক ছন্দও বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ একে কখনও বলেছেন সাধু ছন্দ, কখনও বলেছেন পয়ারজাতীয়। আর শ্ৰী অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় একে বলেন তানপ্রধান ছন্দ। শ্ৰী প্ৰবোধচন্দ্র সেনও মনে করেন যে, অক্ষরবৃত্ত নামের মধ্যে এই ছন্দের চরিত্র-পরিচয় ঠিক ধরা পড়েনি। সেই কারণেই পরবর্তীকালে অক্ষরবৃত্ত নামটি তিনি বর্জন করেছেন এবং এর নতুন নাম দিয়েছেন মিশ্রকলাবৃত্ত। কিন্তু নামাবলি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। নামের মূল্য নামমাত্র। আর তা ছাড়া, মহাকবি শেকসপিয়ার তো বলেই দিয়েছেন, গোলাপকে যে-নামেই ডাকো, তার গন্ধের তাতে তারতম্য ঘটবে না। সব ব্যাপারেই তা-ই। আর তাই, অন্যান্য নামের গণ্ডগোলে না ঢুকে আপাতত ওই অক্ষরবৃত্ত নামটাই ব্যবহার করা যাক; তাতে কাজের অনেক সুবিধে হবে।
এখানে বলে রাখি, বয়সের বিচারে অক্ষরবৃত্ত খুবই বনেদি ছন্দ। রবীন্দ্রনাথের আগে পর্যন্ত, এমনকি রবীন্দ্ৰকাব্যেরও সূচনাপর্বে, বাংলা কবিতা প্রধানত অক্ষরবৃত্তেই লেখা হয়েছে। কিন্তু এর থেকে আবার এমন কথা কেউ যেন ভেবে না বসেন যে, অক্ষরবৃত্ত নেহাতই সাবেক-কালের ছন্দ, একালে আর তার চলন কিংবা কদর নেই। না, তা নয়। বরং সত্যি বলতে কী, হাল আমলের কবিতায় দেখছি অক্ষরবৃত্ত আবার নতুন করে আসর জাঁকিয়ে বসেছে।
অক্ষরবৃত্তের লক্ষণ কী? লক্ষণ মোটামুটি এই যে, এ-ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ, তত মাত্রা। অর্থাৎ কিনা প্রতিটি অক্ষরই এখানে একটি মাত্রার মর্যাদা পেয়ে থাকে। দৃষ্টান্ত দিচ্ছি:
১) গোলোক বৈকুণ্ঠপুরী সবার উপর
২) দ্যাখো চারু যুগ্মভুবু ললাট প্রসর
৩) শ্যামল সুন্দর প্রভু কমললোচন
৪) গুণ হৈয়া দোষ হৈল বিদ্যার বিদ্যায়
৫) নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন
৬) পোড়া প্রণয়ের বুঝি জরামৃত্যু নাই
৭) কঁপে তারা কঁপে উরু, গুরুগুরু করি
৮) চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির
৯) ওষ্ঠ্যাধরে বিম্বফল লজ্জা নাহি পায়
১০) বঙ্গভূমি পদে দলে তুরস্ক সোয়ার।
বাংলা কাব্যের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে, দশ-দশটি পঙক্তি তুলে নিয়ে আনলাম। এদের প্রত্যেকের ছন্দ অক্ষরবৃত্ত। প্রত্যেক পঙক্তিতে অক্ষরের সংখ্যাও যেমন চোদ্দো, মাত্রার সংখ্যাও তেমনি চোদ্দো। তার মানে এই নয় যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতার এক-একটি পঙক্তিতে ঠিক চোদ্দোটা অক্ষরই থাকতে হবে। না, তা নয়। তবে, অক্ষরের সংখ্যা বাড়লে কিংবা কমে গেলে মাত্রার সংখ্যাও সেই সঙ্গে বাড়বে কিংবা কমে যাবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, পঙক্তির মাপ বাড়ুক, কিংবা কমুক, অক্ষর আর মাত্রার সংখ্যা সমান-সমানই র’বে।
কথা এই যে, অক্ষরবৃত্তের পঙক্তিকে বাড়ানো-কমানো যায় ঠিকই, কিন্তু নেহাতই খেয়াল-খুশি মতো বাড়ানো-কমানো যায় না। অর্থাৎ হ্রাসবৃদ্ধির একটা কানুন আছে, সেই কানুন মেনে তবেই লাইনটাকে বাড়ানো-কমানো চলে। কিন্তু সে-কথায় একটু বাদে ঢুকব। তার আগে জানা দরকার, এত যে মাত্রা-মাত্রা করছি, সেই মাত্ৰা জিনিসটা কী?
আমরা কথায় বলি, অমুক লোকটার মাত্রাজ্ঞান আছে, তমুক লোকটার নেই। ইংরেজিতে একেই বলে সেনস অব প্রোপোরশান। প্রোপোরশানের বাংলা অর্থ অনুপাত। মাত্রা বলতে কি তাহলে অনুপাত বুঝব?
না, মহাশয়, কবিতায় ঠিক এই অর্থে ‘মাত্ৰা’ কথাটার ব্যবহার হয় না। তবে কোন অর্থে হয়? জানি, আমার কপালে দুঃখ আছে, ছান্দসিকদের কাছে ধমক আমাকে খেতেই হবে। কিন্তু উপায় কী, বিজ্ঞজনেরা যতই চোখ রাঙিয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করুন, মাত্রা বোঝাতে গিয়ে কোনও গুরুগম্ভীর জটিল ব্যাখ্যার অবতারণা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আমার ক্লাস খুলেছি নতুন পড়ুয়াদের নিয়ে, ‘ব্যাঘ্র মানে শার্দুল’ শুনলেই তাঁরা ঘাবড়ে গিয়ে ক্লাস ছেড়ে পালাবেন। তাই, কিছুটা ত্রুটির ঝুঁকি নিয়েও, খুব সহজ করে ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে দিতে চাই। আপাতত, প্ৰবোধচন্দ্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এইটুকু বুঝলেই তাদের কাজ চলবে যে, “যার দ্বারা কোনো-কিছুর পরিমাপ করা যায়”, তাকেই আমরা মাত্রা বলে থাকি। প্রবোধচন্দ্র বলেছেন, “মাত্রা মানে পরিমাপক”, অর্থাৎ ইউনিট অব মেজার। এখন, বলা বাহুল্য, বস্তুভেদে ওই পরিমাপের ইউনিটও আলাদা হতে পারে, হয়ে থাকে। জল মাপবার ইউনিট যদি ফোঁটা, তো কাপড় মাপাবার ইউনিট হয়তো মিটার কিংবা গজ। ইউনিটের এই বিভিন্নতার ব্যাপারটা প্ৰবোধচন্দ্র নিজেই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়ে বলেছেন যে, ছন্দের রীতিভেদেও মাত্রা বিভিন্ন হয়। যাই হোক, আমার পড়ুয়ারা মোটামুটি এইটুকু জেনে রাখুন যে, কবিতার এক-একটি পঙক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং তাকে উচ্চারণ করার জন্য মোট যে-সময় আমরা নিয়ে থাকি, সেই উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হল মাত্রা। প্ৰবোধচন্দ্র তারই নাম দিয়েছেন “কলা”। ‘কলা’ মানে এখানে অংশ। যেমন ষোলো-কলায় চাঁদ পূর্ণ হয়, তেমনি কলা কিংবা মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় পূর্ণ এক-একটি পঙক্তির উচ্চারণকাল।
ব্যাপারটাকে এবারে হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখা যাক। ‘গোলোক বৈকুণ্ঠপুরী সবার উপর’— এই লাইনটিকে একবার চেচিয়ে উচ্চারণ করুন তো। করেছেন? করতে যে-সময় লাগল, সেই উচ্চারণকাল মোট চোদ্দোটি মাত্রার সমষ্টি। অর্থাৎ এই মাত্রাগুলি হচ্ছে লাইনটির উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটি অংশ। মোট মাত্রা এখানে চোদ্দো আবার লাইনটির মোট অক্ষরের সংখ্যাও তা-ই। কিন্তু অক্ষর আর মাত্রাকে এইভাবে তুল্যমূল্য করে দেখার একটা বিপদ আছে। যথা “ঐ” দৃশ্যত একটিই অক্ষর বটে, কিন্তু তাকে ভেঙে “ওই” লিখলেই অক্ষরের সংখ্যা দুয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ “ঐ” আর “ওই”-য়ের উচ্চারণ তো একই। ফলে, অক্ষরবৃত্তে কেউ যদি “ঐ” লিখে ওই একাক্ষর দিয়ে দু-মাত্রার কাজ চালান, তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ‘বউ’ আর ‘বৌ’য়ের ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার। “হাওয়া’, “পাওয়া’, ‘খাওয়া”, ইত্যাদির বেলাতেও অক্ষর আর মাত্রাকে সংখ্যার ব্যাপারে। তুল্যমূল্য করে দেখবার উপায় নেই। ওসব শব্দের ‘ওয়া’-অংশে যদিও দুটি অক্ষর, কার্যত সেই অক্ষর দুটি কিন্তু এক মাত্রার বেশি দাম পায় না।
তা ছাড়া আমরা চার-অক্ষরের সমবায়ে লিখি ‘তোমরই’ ‘আমারই’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘তোমারি’ ‘আমারি’; তিন অক্ষরের সমবায়ে লিখি ‘সবই’, কিন্তু উচ্চারণ করি ‘সবি’— ধ্বনির আয়তনের বিচারে দু-অক্ষরের ছবির সঙ্গে তার ফারাক থাকে না। পরে আমরা দেখিয়ে দেব যে, অক্ষর দেখে মাত্রা গুনতে গেলে আরও নানা বিপদ ঘটতে পারে। আপাতত এইটুকু জেনে রাখুন যে, ছন্দের ব্যাপারে আসলে ধ্বনিটাই প্রধান কথা, অক্ষরটা নয়। তবু ছন্দশিক্ষার প্রাথমিক পর্বে (অর্থাৎ মাত্রা ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি, তখন) অক্ষরের ভিত্তিতে ছন্দ চেনাবার চেষ্টা করেছি। এই জন্যে যে, নতুন পড়ুয়ার তাতে সুবিধে হয়। সেই প্রাথমিক পর্ব তো চুকেছে; এখন বলি, অক্ষরের উপর চোখ না-রেখে ধ্বনির দিকে কান রাখুন। ছন্দনির্ণয় আর মাত্ৰা-বিচার তাতেই নির্ভুল হবে।
এবারে তাহলে লাইনের দৈর্ঘ্যের হ্রাসবৃদ্ধির প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নমুনা দিতে গিয়ে ইতিপূর্বে আমি যেসব লাইন তুলে দিয়েছিলাম, তার প্রত্যেকটিই চোদ্দো মাত্রার লাইন। এবারে বলি, এ-ছন্দে ছয় মাত্রার লাইন লেখা যায়, দশ মাত্রার লাইন লেখা যায়, চোদ্দো মাত্রার লাইন লেখা যায়, আঠারো মাত্রার লাইন লেখা যায়, বাইশ মাত্রার লাইন লেখা যায়, ছাব্বিশ মাত্রার লাইন লেখা যায় এমন কী, তিরিশ মাত্রার লাইনও আমি দেখেছি। তার বেশি বাড়াতে হলে চৌত্রিশ মাত্রায় যেতে হয়। কেউ গিয়েছেন বলে আমি জানিনা।
হ্রাস-বৃদ্ধির কানুনটা তাহলে কী? এখনও সেটা বুঝতে পারেননি? ছয়, দশ, চোদ্দো, আঠারো, বাইশ— মাত্রার সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে দেখুন। এখানে চার চার করে বাড়ছে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল আসলে চার মাত্রার চাল। মূলে রয়েছে চার। তার সঙ্গে, কিংবা চারের যে-কোন গুণিতকের সঙ্গে (অর্থাৎ চার-দুগুণে আটের সঙ্গে, কিংবা তিন-চারে বারোর সঙ্গে, কিংবা চার-চারে ষোলোর সঙ্গে, কিংবা চার-পাঁচে কুড়ির সঙ্গে) দুই যোগ করলে যে-সংখ্যাটা মিলবে, তত সংখ্যার মাত্ৰা দিয়েই অক্ষরবৃত্তের লাইন তৈরি করা যায়।
দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
লক্ষ ঢাকঢোল
বাজিছে হোথায়।
চক্ষু হয় গোল,
লোকে মূৰ্ছা যায়।
এ হল ৪+২=৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। এত ছোটো মাপে যদি মন না ওঠে, তো এর সঙ্গে আরও চার মাত্রা জুড়ে দিয়ে ৪+৪+২=১০ মাত্রার লাইনও আমরা বানাতে পারি। ব্যাপারটা সেক্ষেত্রে এই রকমের দাঁড়াবে :
ওই শোনো প্ৰচণ্ড দাপটে
লক্ষ ঢাকঢোল বেজে যায়।
ভক্তের আসর জমে ওঠে
ঘন-ঘন-পতনে মূৰ্ছায়।
আরও বাড়াতে চান? বেশ তো বাড়ান না, আগের লাইনে আরও চারটি করে মাত্রা জুড়ে দিন। দিলে হয়তো এই রকমের একটা চেহারা মিলতে পারে :
ওই শোনো সাড়ম্বরে প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ ঢোল বেজে যায়।
গর্জনে-হুংকারে ওই সভা জমে ওঠে
ভক্তদের ঘন-ঘন পতনে মূর্ছায়।
এ হল ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত।
ঠিক এভাবেই আমরা আরও চারটি মাত্রা বাড়াতে পারি, এবং চোদ্দের জায়গায় আঠারো-মাত্রার (৪+৪+৪+৪+২-১৮) লাইন বানাতে পারি। কিন্ত তার আর দরকার কী?
কথা হচ্ছে, যে-ছন্দের চাল মূলত চার মাত্রার, বাড়তি দুমাত্রা যোগ করতে হয় কেন? বলি।
কবিতা পড়তে-পড়তে মাঝে-মাঝে একটু দম ফেলবার অবকাশ চাই। একটানা তো ছোটা যায় না; ছুটতে-ছুটতে খানিক-খানিক দাঁড়িয়ে নেওয়া চাই। ওই দু-মাত্রা সেই ক্ষণিক-বিরতির ব্যবস্থা করেছে। ওদের যদি না জুড়ে দেওয়া হত, লাইনের শেষে তাহলে দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যেত না। প্রথম লাইন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় লাইনের উপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হত, দ্বিতীয় লাইন ফুরিয়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গেই তৃতীয় লাইনের উপর। এবং এই রকমই চলত, গোটা কবিতাটা যতক্ষণ না একেবারে ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তেমনভাবে তো আমরা কবিতা পড়তে পারিনে। পড়িমরি ছুটি লাগিয়ে কবিতা পড়া যায় না; আর-কিছু না হোক, দম ফেলবার ফুরসতটুকু চাই। সেই ফুরসতটুকুই মিলিয়ে দিচ্ছে আগের লাইনের শেষে জুড়ে-দেওয়া ওই মাত্রা দুটি। ওরা যদি না-থাকত, কবিতা পড়া তাহলে যে কী ঘোড়দৌড়ের ব্যাপার হত, নীচের কয়েকটি লাইন পড়লেই তা বুঝতে পারবেন :
বাজে লক্ষ ঢাকঢোল
চতুর্দিকে হট্টগোল
আর সহ্য হয় কত,
প্ৰাণ হল ওষ্ঠাগত।
ভক্তেরা বিষম খান,
দলে-দলে মূৰ্ছা যান।
বুঝতেই পারছেন, কী হুলুস্থুলু ব্যাপার! বাড়তি দুমাত্রাকে ছোট্ দিয়ে শুধুই চারের চালের উপরে নির্ভর করে এই ছত্র-কটি দাঁড়িয়ে আছে। তার ফল হয়েছে এই যে, দাঁড়ি-কমা থাকা সত্ত্বেও লাইনের শেষে দাঁড়ানো যাচ্ছে না; ছন্দের তাড়না এতই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, পাঠককে সে লাইন থেকে লাইনে ছুটিয়ে মারছে। এই ঘোড়দৌড়কে ঠেকাবার জন্যেই লাইনে-লাইনে বাড়তি দুটি মাত্রা জুড়ে দেওয়া দরকার।
কবিতার আলোচনায় ঘোড়দৌড় কথাটা যদি আপত্তিকর মনে হয়, তবে না-হয়। পাখির উপমা দেব। বাড়তি দু-মাত্রা যখন থাকে না, পাখিকে তখন ক্ৰমাগত উড়তে হয়। আর লাইনের শেষে ওই দু-মাত্ৰা আশ্রয় থাকলে সেটাকে ধরে সে একটুক্ষণের জন্যে জিরিয়ে নিতে পারে। কিংবা বলি, চারের চালের কবিতা যেন একটা বহতা নদী। আগের লাইনের শেষের ওই দু-মাত্রা তাতে বয়ার মতন ভাসছে। সাতার কাটতে-কাটতে আমরা ওই বয়াকে গিয়ে ধরছি– ব্যাপারটা অনেকটা এই রকমের।
মজা এই যে, লাইনটাকে যখন একসঙ্গে দেখি, তখন গোটা লাইনের বিন্যাসের মধ্যে ওই বাড়তি মাত্রা দুটি এমন চমৎকারভাবে নিজেদের ঢেকে রাখে যে, ওরা যে আলাদা, তা ঠিক ধরাও পড়ে না। বিশেষ করে, ছয় কি দশের বৃত্ত ছাড়িয়ে আমরা যখন চোদ্দো মাত্রায় গিয়ে পৌঁছোই, অতিরিক্ত ওই দু-মাত্রাকে তখন ছন্দের মূল চালেরই অঙ্গ বলে মনে হয়। তার হেতুটা আর কিছুই নয়, লাইনের টুকরো-টুকরো অংশের যেমন ছোটো মাপের চাল থাকে, তেমনি গোটা লাইনটারও আবার একটা বড়ো মাপের চাল থাকে। ছোটো মাপের চালের দিকে যখন তাকাই, বাড়তি দুমাত্রাকে তখন আলাদা করে দেখতে পাই; কিন্তু বড়ো মাপের চালের দিকে তাকালে আর দেখতে পাইনা। তার কারণ এই যে, ছোটো চালটা বাড়তি দু-মাত্রাকে দূরে ঠেলে দেয়; বড়ো চাল তাকে নিজের মধ্যে টেনে আনে। হাতেকলমে বুঝিয়ে দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে–
ওই শোনো সাড়ম্বরে প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ ঢোল বেজে যায়।
এই যে দুটি লাইন, ছোটো চালের হিসেব মেনে যদি এদের ভাগ করে ফেলি, ব্যাপারটা তাহলে এইরকম দাঁড়াবে–
ওই শোনো/সাড়ম্বরে/প্রচণ্ড দা/পটে
মহোল্লাসে/লক্ষ লক্ষ/ঢোল বেজে/যায়।
এইভাবে ভাগ করে দেখতে পাচ্ছি, আগের লাইনের এক-এক অংশে (এই অংশেরই অন্য নাম ‘পর্ব) চারটি করে মাত্রা পড়ছে, আর লাইনের প্রান্তে পড়ে থাকছে সেই বাড়তি দু-মাত্রা।
কিন্তু কবিতা পড়বার সময়ে তো ঠিক এই রকমের ছোটো চালে পা ফেলে আমরা পড়িনা। আর-একটু লম্বা চালে এইরকমে পড়ি—
ওই শোনো সাড়ম্বরে/প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ/ঢোল বেজে যায়।
তখন মনে হয়, লাইনগুলি যেন দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আট মাত্রা, দ্বিতীয় ভাগে ছয় মাত্রা। অক্ষরবৃত্তের আঠারো মাত্রার লাইনকেও এই বড়ো চালে ভাঙা যায়। ভাঙলে তার প্রথম ভাগে পড়বে আট মাত্রা, দ্বিতীয় ভাগে দশ মাত্রা।
মোটকথা, বড়ো চালে যখন চলি, লাইনের শেষের বাড়তি দু-মাত্রাকে তখন আর আলাদা করে ধরতে পারিনা। বাইরের লোক হয়েও সে তখন ছন্দের ভিতরে এসে ঢুকে পড়ে; বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে না থেকে অন্দরমহলে এসে আপনার লোক হয়ে যায়।
অক্ষরবৃত্তের চেহারা দেখলাম, চরিত্রের খোঁজখবর নিলাম, চালচলনেরও একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। কিন্তু মোদ্দা কথাটা বোঝা গেল কি?
আলোচনার সুবিধের জন্যে আবার চলুন ধ্বনিকে ছেড়ে অক্ষরের কাছে ফিরে যাই। আমি বলেছি, এ-ছন্দের এক-এক লাইনে অক্ষর যত, মাত্ৰাও তত। এটাই সাধারণ নিয়ম। এর যে ব্যতিক্রম হয় না, তা নয়। বিস্তর হয়। তার কারণ, ধ্বনি সর্বদা অক্ষরের আঁচল ধরে চলে না। কিন্তু ব্যতিক্রমের কথা এখুনি বলতে চাইনা। পরে বলব। অক্ষরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও অনেকসময়ে ধ্বনির পরিসর কেন বাড়ে না, এবং মাত্রার যোগফলও তার দরুন, একটা নির্দিষ্ট হিসেবের মধ্যেই থেকে গিয়ে কীভাবে লাইনের ভারসাম্যকে ধরে রাখে, তা-ও বলব। আপাতত শুধু সাধারণ নিয়ম নিয়েই আলোচনা করা যাক।
সাধারণ নিয়মটা এই যে, অক্ষর আর মাত্রার সংখ্যা এতে সমান-সমান। তার চাইতেও জরুরি কথা, অক্ষর আর যুক্তাক্ষর এ-ছন্দে তুল্যমূল্য; অক্ষরবৃত্তের লাইনে যদি যুক্তাক্ষর-সংবলিত শব্দ ঠেসেও বসান, মাত্ৰা-সংখ্যার তবু ইতরবিশেষ হবে না। লাইনের ওজন তাতে বাড়বে বটে, কিন্তু দৈর্ঘ্য তার ফলে মাত্রার সীমা ছাড়াবে না। অর্থাৎ ছন্দও বে-লাইন হবে না।
দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। প্রথমে আসুন দশ-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখি।
নিশীথিনী ভোর হয়ে আসে
আলো ফোটে পুবের আকাশে।
দশ-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা এই যে দুটি লাইন, এর মধ্যে যুক্তাক্ষর একটিও দেওয়া হয়নি। দিয়ে দেখা যাক কী হয়।
আমারাত্রি ভোর হয়ে আসে
আলো ফোটে পূর্বের আকাশে।
কী হল? কিছুই হল না। এক-এক লাইনে একটি করে যুক্তাক্ষর ঢোকালাম, কিন্ত অক্ষরবৃত্ত তাকে দিব্যি গিলে নিল। দশ-মাত্রা দশ-মাত্ৰাই আছে, এগারো হয়ে গিয়ে ছন্দপতন ঘটায়নি। আরও কিছু ভার তাহলে চাপানো যাক :
অন্ধকার সাঙ্গ হয়ে আসে
রক্ত-আভা পূর্বের আকাশে।
এক-এক লাইনে এবারে দু-দুটো করে যুক্তাক্ষর বসালাম। কিন্তু তাতেই-বা কী হল? মাত্রা সেই দশেই আটকে আছে। ভার তাহলে আরও বাড়িয়ে দেখি।
কৃষ্ণরাত্রি সাঙ্গ হয়ে আসে
রক্তচ্ছটা পূর্বের আকাশে।
কিন্তু তাতেও কিছু ইতরবিশেষ হল না। আগের লাইনে তিন-তিনটে যুক্তাক্ষরকে অক্লেশে গিলে নিয়ে দশ-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত সেই দশ মাত্রাতেই দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।
দশ মাত্রায় যদি মন না ওঠে তো চোদ্দো-মাত্রার লাইন নিয়ে পরীক্ষা করুন।
‘চলো ভাই মাঠে যাই বেড়াইয়া আসি’
বাল্যে-পাঠ্য একটি বিখ্যাত কবিতার এটি প্রথম লাইন। এর ছন্দ অক্ষরবৃত্ত। অক্ষরের সংখ্যা এখানে চোদ্দো, মাত্রার সংখ্যাও তা-ই। যুক্তাক্ষর এতে একটিও নেই। কিন্তু থাকলেও তার ফলে মাত্রার সংখ্যা বেড়ে যেত না। প্রমাণ দিচ্ছি :
চলো বন্ধু মাঠে যাই বেড়াইয়া আসি
ভাইকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা বন্ধুকে এনে ঘরে ঢোকালাম। ফলে একটি যুক্তাক্ষরও এল। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু চোদ্দো-ই। এবার দেখুন :
চলো বন্ধু মুক্ত-মাঠে বেড়াইয়া আসি।
দু-দুটি যুক্তাক্ষর ঢুকেছে। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু বাড়েনি। অতঃপর :
চলো বন্ধু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মাঠে যাই।
অর্থাৎ তিন-তিনটে যুক্তাক্ষর ঢুকল। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু সেই চোদ্দেই, তার বেশি নয়। কিংবা :
সাঙ্গোপাঙ্গ সঙ্গে নিয়ে মুক্ত-মাঠে চলো
এবারে চার-চারটে যুক্তাক্ষর। কিন্ত লাইনের মাত্ৰাসংখ্যা। তবু সেই চোদ্দোতেই ঠেকে আছে, এক ক্ৰান্তিও বাড়েনি।
যুক্তাক্ষরের সংখ্যা এইভাবে আরও বাড়ানো যায়। কত যে বাড়ানো যায়, সেটা বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্ৰনাথ লিখেছিলেন :
‘দুৰ্দান্ত পণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’
যুক্তাক্ষর এখানে গিজ-গিজ করছে। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা তবু সেই চোদ্দে তো চোদ্দেই, ওজনে-ভারী এতগুলি যুক্তাক্ষরকে বক্ষে ধারণ করেও অক্ষরবৃত্তের এই লাইনটি তবু সেই চোদ্দো-মাত্রাতেই ঠেকে আছে।
অক্ষরবৃত্ত যেন সৰ্বংসহা বসুন্ধরার মতো। তার উপরে যতই-না কেন ভার চাপানো হোক, মুখ বুজে সে সহ্য করবে। তার জন্যে সে বাড়তি-মাত্রার মাশুল চাইবে না; যেমন অন্যান্য অক্ষরকে, তেমনি যুক্তাক্ষরকেও সে মাত্র এক-মাত্রার মূল্যেই বহন করে, তার দৃষ্টান্তও দিয়েছি।
কথা এই যে, দুটি অক্ষর যদি দৃশ্যত পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত না-হয়েও শ্রবণের বিচারে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে যায়, তো অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতায় সেই অক্ষরদুটিকে- দৃশ্যত তারা যুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও- মাত্র একমাত্রার মাশুল দিয়েই তাড়িয়ে দেওয়া যায় কি? যায় না, এমন কথা কেমন করে বলব? কবিরা অনেক ক্ষেত্রে দিব্যি তাড়িয়ে দেন। দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
চকর্পূর-সুবাসে জল ভরপুর হয়েছে
এই যে লাইনটি, এর মধ্যে ‘কর্পূর’ শব্দটি যে তিন-মাত্রা, তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘ভরপুর’ও কি তা-ই?
হ্যাঁ, তা-ই। তার কারণ, ‘ভরপুর’-এর রপু দৃশ্যত যুক্ত নয় বটে, কিন্তু শ্রবণের বিচারে যুক্ত। কান তাকে “ভর্পুর’ হিসেবেই গ্রহণ করেছে, এবং ছন্দবিচারে চোখ নয়, কানই যে হাকিম, তা কে না জানে!
অক্ষরের চাইতে ধ্বনি বড়ো। অক্ষর তো আর-কিছুই নয়, ধ্বনিরই একটা দৃশ্যরূপ মাত্র। আসলে যা ধর্তব্য, তা হচ্ছে ধ্বনি। তাই, চোখের নয়, কানের রায় ই শিরোধার্য। আর তাই, অক্ষরবৃত্তের লাইনে চার অক্ষরের শব্দ ‘কলকাতাকে অক্লেশে তিন-মাত্রা হিসেবে চালানো যায় (কেন-না। কান তাকে কল্কাতা” বলে জানে), পাঁচ-অক্ষরের শব্দ “খিদিরপুর’কে চালানো যায় চার-মাত্রা হিসেবে (কেন-না কনের কাছে সে খিদির্পুর), ছয় অক্ষরের শব্দ ‘কারমাইকেল’কে তাড়িয়ে দেওয়া যায় পাঁচ-মাত্রার মাশুল দিয়ে (কেন-না কর্ণে তিনি কাৰ্মাইকেল)। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের এই একটা মস্ত সুবিধা। যেখানে সম্ভব, শব্দকে সেখানে অক্ষরের তুলনায় কম-মাত্রার মাশুল দিয়ে তাড়ানো যায়, ছন্দের ভারসাম্য তাতে নষ্ট হয় না। আবার তার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
চারজন হাড়গিলে-ছোকরা ঘুরবার বাতিকে
কাতরাতে কাতরাতে চলল হাতিরাসের দিকে।
লক্ষ করে দেখুন, এই লাইন দুটির প্রত্যেকটিতেই অক্ষরের সংখ্যা আঠারো। কিন্ত তা সত্ত্বেও এরা চোদ্দো মাত্রার লাইন হিসেবে চলতে পারে। তার কারণ, চক্ষু এদের যে-চেহারাই দেখুক, কানের কাছে সংকুচিত হয়ে গিয়ে এরা এই রকমের চেহারা নেয় :
চার্জন হার্গিলে ছোক্ৰা ঘুর্বার বাতিকে
কাত্ৰাতে কাত্ৰাতে চল্ল হাত্ৰাসের দিকে।
আবার বলি, ছন্দের ব্যাপারে অক্ষর-বস্তুটা কিছু নয়, সে ধ্বনির-প্রতীক মাত্র, এবং ধ্বনিটাই হচ্ছে একমাত্র ধর্তব্য বিষয়। পরে তার আরও অজস্র প্রমাণ মিলবে।
বুদ্ধিমান পড়ুয়া আশা করি ইতিমধ্যেই একটা জরুরি কথা বুঝে নিয়েছেন। সেটা এই যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সংকোচনকে প্রশ্রয় দেয়, আর তাই হসন্ত অক্ষরমাত্রেই সেখানে পরবতী অক্ষরের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তার আত্মস্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বিশেষত, যুক্ত হবার বিধি যেখানে আছেই, সেখানে— দৃশ্যত আলাদা থাকলেও— শ্রবণের বিচারে যুক্ত হতে তাদের কিছুমাত্র আটকায় না। ল’য়ে ক’য়ে মিলন প্রথাসম্মত বলেই ‘কলকাতা’ আমাদের শ্রবণে ‘কল্কাতা’ হয়, ‘ত’য়ে ‘ত’য়ে মিলন রীতিসিদ্ধ বলেই ‘পাততাড়ি’ গুটিয়ে গিয়ে হয় ‘পাত্তাড়ি’।
কিন্তু মিলন যেখানে রীতিসিদ্ধ নয়, শ্রবণ কি সেখানেও অসবর্ণ বিবাহে অনুমোদন দেয়? তা-ও দেয়। এবং আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম, শ্রবণের অনুমোদন নিয়ে, সেই অসবর্ণ মিলন ঘটাতে সাহসী হয়েছিলেন। ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই”- “বাঁশি” কবিতার এই লাইনটির সঙ্গে সকলেই পরিচিত। ছন্দ অক্ষরবৃত্ত। তার প্রশ্রয়ে ‘আকবর’ হয়েছে তিন-মাত্রা; বাদশার শব্দটিও তা-ই। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, কয়ে ‘ব’য়ে মিলন রীতিবিরুদ্ধ নয় বটে, কিন্তু সেই ‘ব’-ফলায় ইংরেজি ‘বি’-অক্ষরের ধ্বনি আসে না (দৃষ্টান্ত; পকৃ, নিকৃণ), এক্ষেত্রে কিন্তু সেই ধ্বনিকে সম্পূর্ণ বঁচিয়েই কবি তাকে ‘ক এর সঙ্গে জুড়েছেন। ‘বাদশা’র ব্যাপারটাও সমান চমকপ্ৰদ। ‘দ’য়ে শ’য়ে যুক্ত হবার রীতি নেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তবু অসম সাহসে তাদের মিলিয়ে দিয়েছেন।
একালের কবিতায় অবশ্য এমন অসবর্ণ মিলন আকছার ঘটতে দেখি। কিন্তু ভুলে না যাই যে, রবীন্দ্রনাথই এই দুঃসাহসিক মিলনের প্রথম পুরোহিত। অক্ষরবৃত্ত সম্পর্কে আমাদের ক্লাসে এযাবৎ যেসব কথাবার্তা হল, তার থেকে ছেঁকে নিয়ে মোদ্দা কথাটা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে :
১) ৪ কিংবা তার গুণিতকের সঙ্গে ২ যোগ করলে যে-সংখ্যাটা পাওয়া যায়, সেই সংখ্যার মাত্রা দিয়েই তৈরি করা যায় অক্ষরবৃত্ত কবিতার লাইন।
২) এ-ছন্দ শব্দের সংকোচনকে প্রশ্ৰয় দেয়; তাই শব্দের ভিতরকার হসন্ত অক্ষর এ-ছন্দে পরবতী অক্ষরের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। দৃশ্যত যেখানে তারা যুক্ত হয় না, সেখানেও তারা শ্রবণে যুক্ত হয়; ফলে দৃশ্যত তারা পৃথক থাকে বটে, কিন্তু শ্রবণে তারা মিলিত হয়ে দুয়ে মিলে একটিমাত্র মাত্রার মর্যাদা পায়।
৩) দুটি অক্ষরের মিলন যেখানে রীতিসিদ্ধ, সেখানে তো শ্রবণের অনুমোদন নিয়ে মিলিত হয়ই (খিদিরপুর = খিদির্পুর = ৪ মাত্রা),- মিলন যেখানে রীতিসিদ্ধ নয়, সেখানেও অনেকসময়ে শ্রবণের ঔদার্যে তাদের অসবৰ্ণ বিবাহ ঘটে, এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দ তাতেও বেজার হয় না (বাদশা = ২ মাত্রা)।
অক্ষরবৃত্তে এই অসবর্ণ মিলনের সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতা থেকে তুলে দিয়েছি। এবারে দেখা যাক, আমরা নিজেরাও এইভাবে অক্ষরে-অক্ষরে অসবৰ্ণ বিবাহ ঘটাতে পারি, কি না।
বাজনা বাজে পূজার প্রাঙ্গণে;
ফোটেনি সজনের কুঁড়িগুলি।
খাজনার আতঙ্ক জাগে মনে,
শস্য খেয়ে গিয়েছে বুলবুলি।
এ-ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরই কবিতা। এর আগের লাইনে অক্ষরের সংখ্যা এগারো বটে, কিন্তু মাত্রার সংখ্যা দশ। তার কারণ আর-কিছুই নয়, আগের লাইনে এমন এক-একটা শব্দ আছে, ভিতরে হসন্ত অক্ষর থাকায় শ্রবণে যা সংকুচিত হয়ে যায়। প্রথম লাইনে সেই শব্দটি হচ্ছে বাজনা” (শ্রবণে গুটিয়ে গিয়ে সে দু-মাত্রার মর্যাদা পায়), দ্বিতীয় লাইনে সেই শব্দটি হচ্ছে “সজনের” (শ্রবণে গুটিয়ে গিয়ে সে তিন-মাত্রায় দাঁড়াচ্ছে), তৃতীয় লাইনে সেই শব্দটি হচ্ছে ‘খাজনার’ (শ্রবণে সে-ও গুটিয়ে গিয়ে হচ্ছে তিন-মাত্রার শব্দ), আর চতুর্থ লাইনের সেই শব্দটি হচ্ছে “বুলবুলি” (কানের কাছে যার সংকুচিত শরীরের মূল্য মাত্র তিন-মাত্রা)। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরবর্তী অক্ষরের সঙ্গে শব্দের মধ্যবর্তী হসন্ত অক্ষরের মিলন। এখানে অসবর্ণ। (প্রথম তিনটি ক্ষেত্রে ‘জ’ কে নিয়ে মিলন ঘটেছে, যা রীতিবিরুদ্ধ। চতুর্থ ক্ষেত্রে মিলন ঘটেছে ল’য়ে আর ইংরেজি ‘বি’ অক্ষরের ধ্বনিসম্পন্ন ব’য়ে; তা-ও রীতিসিদ্ধ নয়। চোখের বিচারে তারা অবশ্য আলাদাই রইল, শুধু কানের বিচারেই তারা মিলিত)
এখন একটা মজার কথা বলি। অক্ষরের এই মিলন-লীলা যে নেহাতই ঘরোয়া, অর্থাৎ একই শব্দের গণ্ডির মধ্যে যে এই মিলন চলে, তা কিন্তু নয়। এতক্ষণ অবশ্য শুধু ঘরোয়া মিলনেরই দৃষ্টান্ত দিয়েছি। এইবার বলি, এক বাড়ির মেয়ে যেমন অন্য বাড়ির ছেলের প্রেমে পড়ে, তেমনি এক-শব্দের অক্ষর অনেক সময়ে আর-এক শব্দের অক্ষরের সঙ্গে হাত মেলাতে চায়। সেসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, শব্দের প্ৰান্তবর্তী হসন্ত অক্ষরটি পরবর্তী শব্দের আদ্যক্ষরের সঙ্গে মিলিত হতে চাইছে। দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
কালকা মেলে টিকিট কেটে সে
কাল গিয়েছে পাহাড়ের দেশে
এর মধ্যে, অক্ষর-সংখ্যা যা-ই হোক, ‘কালকা মেলে’ শব্দ দুটির মোট মাত্ৰা-সংখ্যা ৪; ‘কাল গিয়েছে’র মাত্ৰা-সংখ্যাও তা-ই। কানের কাছে এদের প্রথমটির চেহারা ‘কাল্কা মেলে’; দ্বিতীয়বার চেহারা ‘কাল্গিয়েছে’। অক্ষরে-অক্ষরে মিলন ঘটেছে দুটি ক্ষেত্রেই। কিন্ত প্রথম ক্ষেত্রে সে-মিলন ঘরোয়া (“কালকা’ শব্দটার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ)। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মিলন ঘটেছে এক শব্দের (কাল) শেষ অক্ষরের (যা কিনা হসন্ত) সঙ্গে তার পরবতী শব্দের (গিয়েছে) প্রথম অক্ষরের।
এইখানে একটা কথা বলে রাখি। অক্ষরে-অক্ষরে মিলন ঘটিয়ে, যুক্তাক্ষরের মায়া সৃষ্টি করে, মাত্রা কমাতে মজা লাগে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু মজা লাগে বলেই যে প্রতি পদে এইভাবে মিলন ঘটাতে হবে, তা কিন্তু ঠিক নয়। এসব সেয়ানা কৌশল বারবার খাটালে এর চমকটাই আর থাকে না, পাঠকও বিরক্ত বোধ করেন। আর তা ছাড়া, কবিতার মধ্যে এই ধরনের মিলনের বাড়াবাড়ি ঘটলে ছন্দ-অনুসরণেও তাঁর অসুবিধে ঘটে। লক্ষ রাখতে হবে, কবিতার ছন্দের মধ্যে পাঠক যেন বেশ স্বচ্ছন্দে ঢুকতে পারেন; তারপর ভিতরে ঢুকে যখন কিনা বেশ অনায়াসে তিনি চলাফেরা করে বেড়াচ্ছেন, তখন বরং এই ধরনের এক-আধটা চমক লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে, সেটা তার ভালোই লাগবে।
আর-একটা কথা এই যে, লাইনের যে-কোনও জায়গায় কিন্তু এইভাবে অক্ষরেঅক্ষরে মিলন ঘটানো সম্ভবও নয়। অক্ষরবৃত্তের যে একটা চার-মাত্রার ছোটো চাল আছে, সেই চালের পর্বের মধ্যেই মিলনটাকে ঘটিয়ে দেওয়া ভালো। মিলন ঘটাতে গিয়ে যদি পর্বের বেড়া ডিঙিয়ে যাই, তাতে বিপদ ঘটতে পারে, ঘটেও।
এবারে একটা জরুরি কথা বলি। কবিতা লিখতে গিয়ে লক্ষ রাখতে হবে, শব্দের উচ্চারণ আর ছন্দের চাল, এ দুয়ের মধ্যে যেন ঠিকঠাক সমন্বয় ঘটে। অর্থাৎ ছন্দের চাল ঠিক রেখে কবিতা পড়তে গিয়ে যেন দেখতে না পাই যে, ছন্দের খাতিরে শব্দের শরীরকে এমন-এমন জায়গায় ভাঙতে হচ্ছে, যেখানে তাদের ভাঙা যায় না। আবার শব্দের সঠিক উচ্চারণের খাতিরে ছন্দের চাল যেন বেঠিক জায়গায় না ভাঙে। বেঠিক জায়গায় চাল ভাঙলে ছন্দের নাভিশ্বাস উঠবে। এই বিভ্ৰাট যদি এড়াতে হয় তাহলে ছন্দের চাল আর শব্দের উচ্চারণ, এই দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা চাই। উপমা দিয়ে বলি, ছন্দের চাল আর শব্দ যেন একই-গাড়িতে-জুতে-দেওয়া দুই ঘোড়ার মতন। লক্ষ রাখতে হবে, সেই ঘোড়া দুটি যেন পরস্পরের বিপরীত দিকে ছুটতে না চায়। গাড়ি তাহলে এক-পাও এগোবে না। গাড়ি যাতে ঠিকমতো এগোয়, তারই জন্যে চাই ঘোড়া দুটির মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক।
এই সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে, অঙ্কের নিয়মে সবকিছু ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও, বিপদ কীভাবে অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়, একটু বুঝিয়ে বললেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ধরা যাক, আমরা চোদ্দো-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে দু-লাইন কবিতা লিখতে চাই। তার বিষয়টা এই যে, উঁচুনিচু বৃক্ষ পথে হেঁটে-হেঁটে যাত্রীদের জীবন কেটে গেল। তা কথাটাকে যদি এইভাবে বলি :
অসমতল অমসৃণ পন্থায় হেঁটে
যাত্রীদের গিয়াছে সারা জীবন কেটে
তাহলে কি ঠিক হবে?
না, হবে না। অঙ্কের হিসেবে অবশ্য সবকিছু এখানে ঠিকঠাক আছে, আগের লাইনে চোদ্দো মাত্রার বরাদ্দ চাপাতে কোনও ত্রুটি ঘটেনি; তবু কান বলছে, ঠিক হল না। তার কারণ ঘোড়া দুটো এখানে দু-দিকে ছুটি লাগিয়েছে; ছন্দের চাল আর শব্দের উচ্চারণে বিরোধ ঘটছে পদে-পদে। ছন্দের চাল ঠিক রেখে এই লাইন দুটিকে যদি পড়তে যাই, তো এইভাবে পড়তে হয় :
অসমত/ল অমসৃ/ণ পন্থায়/হেঁটে
যাত্রীদের/গিয়েছে সা/রা জীবন/কেটে
অর্থাৎ, শব্দগুলিকে বে-জায়গায় ভাঙতে হয়। কিন্তু শব্দকে তো আমরা তেমনভাবে ভাঙতে পারিনা। বলা বাহুল্য, ছন্দের খাতিরে শব্দকে অনেকসময়ে ভেঙে পড়তে হয়, কিন্তু সেই ভাঙারও একটা নিয়ম আছে, খেয়ালখুশিমতো যে-কোনও জায়গায় তাকে ভাঙা চলে না। শব্দ যদি ভাঙতেই হয়, তো নিয়ম মেনে এমনভাবে ভাঙতে হবে, যাতে কানের সমর্থন পাওয়া যায়। সুতরাং, হয় শব্দকে আদৌ না-ভেঙে লাইন দুটিকে আমরা এইভাবে লিখব :
অমসৃণ/অতিরুক্ষ/পথে-পথে/হেঁটে
যাত্রীদের/জীবনের/দিন গেল/কেটে
আর নয়তো ভাঙতে হলেও, কানের সমর্থন নিয়ে, এইরকমভাবে ভাঙব :
বন্ধুর দা/রুণ রুক্ষ/পথে-পথে/হেঁটে
যাত্রী-জীব/নের দিন/রাত্রি গেল/কেটে
এইরকমে যদি শব্দ ভাঙি, তাহলে অক্ষরবৃত্তের ছোটো চালে (অর্থাৎ চার-মাত্রার চালে) যদি-বা ভাঙাটা চোখে পড়ে, বড়ো চালে (অর্থাৎ ৮+৬। মাত্রার চালে) সেটা আদৌ ধরা পড়ে না। ব্যাপারটা তখন এইরকম দাঁড়ায় :
বন্ধুর দারুণ রুক্ষ/পথে পথে হেঁটে
যাত্রী-জীবনের দিন/রাত্রি গেল কেটে
তাহলেই দেখা যাচ্ছে যে, ছন্দবিভ্ৰাট এড়াতে হলে লাইনে-লাইনে মাত্রার সংখ্যা ঠিক রাখাটাই যথেষ্ট নয়, শব্দগুলিকে সাজিয়ে বসাবার ব্যাপারেও নিয়ম রক্ষা করা চাই। নিয়মের সারকথাটা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তই বলে গিয়েছেন। তার পরামর্শ: “বিজোড়ে বিজোড় গাঁথি, জোড়ে গাঁথি জোড়।” অর্থাৎ কিনা বিজোড়-শব্দের পিঠে বিজোড়-শব্দ বসাতে হবে, জোড়-শব্দের পিঠে জোড়। শব্দের ব্যাপারে জোড়-বিজোড় কাকে বলে, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবার কথা নয়। যে-শব্দের অক্ষরসংখ্যা বিজোড়, সেটা বিজোড়-শব্দ। যে-শব্দের অক্ষরসংখ্যা জোড়, সেটা জোড়-শব্দ। মোদ্দা কথাটা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, দুই কিংবা চার অক্ষরের শব্দের পিঠে জোড়-শব্দ বসাতে হবে; এক কিংবা তিন অক্ষরের শব্দের পিঠে বিজোড়-শব্দ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল ঠিক রাখবার ব্যাপারে। এইটেই হচ্ছে সবচাইতে নিরাপদ নিয়ম।
এখন আমাদের আলোচনাকে একটু পিছিয়ে নিতে চাই। তার কারণ, অক্ষরে-অক্ষরে মিল ঘটিয়ে যুক্তাক্ষরের মায়া সৃষ্টি করে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা চুরি করা সম্পর্কে এর আগে যেসব কথা বলেছি, একটা জরুরি কথাই তাতে বাদ পড়ে গিয়েছিল। আমার মাসতুতো ভাইয়ের সেই পদ্য-লিখিয়ে কনিষ্ঠ পুত্র সেটা মনে করিয়ে দিল। বুড়ো হয়েছি, সব কথা সর্বদা মনে থাকে না, চিন্তার শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে, পরের কথাটা অনেকসময়ে আগেই বলে বসি, আগের কথার খেই হারিয়ে যায়, এগিয়ে গিয়েও মাঝে-মাঝে তাই পিছনে তাকাবার প্রয়োজন ঘটে। তাকিয়ে বুঝতে পারছি, জরুরি সেই কথাটা এবারে চুকিয়ে দেওয়া দরকার, নয়তো পরে আবার হয়তো ভুলে যাব।
কথাটা সংক্ষেপে এই :
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ‘কলকাতা’ যে সহজেই ‘কল্কাতা’ (অর্থাৎ ৩ মাত্রা) হয়ে যায়, তা আমরা দেখেছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখতে গিয়ে ‘কলকাতা’কে আমরা ৪-মাত্রার শব্দ হিসেবে ব্যবহার করতে পারব না। আসলে, শব্দটাকে আমরা কীভাবে উচ্চারণ করব, তারই উপর নির্ভর করছে সে ক-মাত্রার মর্যাদা পাবে। গোটানো উচ্চারণে সে ৩-মাত্রার শব্দ বটে, কিন্তু ছড়ানো উচ্চারণে সহজেই সে আবার চার মাত্ৰা দাবি করতে পারে। নীচের লাইন দুটি লক্ষ করুন :
উচ্চারণভেদে হয় মাত্রাভেদ ভ্রাতা,
না হলে কলকাতা কেন হবে কলকাতা?
বুঝতেই পারছেন, দ্বিতীয় লাইনে ‘কলকাতা’ শব্দটিকে দু-বারে দু-রকমে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম বারে সে গোটানো উচ্চারণে ৩-মাত্রা (কঙ্কাতা); দ্বিতীয় বারে সে ছড়ানো উচ্চারণে ৪-মাত্রা।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, এইভাবে, উচ্চারণের তারতম্য অনুযায়ী, “খিদিরপুরকে ৪মাত্ৰাও করা যায়, ৫-মাত্ৰাও করা যায়। ‘হ’ল’ক’কে ২-মাত্ৰাও করা যায়, ৩-মাত্ৰাও করা যায়। শরবতী কে করা যায় কখনও ৩-মাত্রা কখনও ৪-মাত্রা। কয়েকটি লাইন দেখুন :
শহরের দক্ষিণেতে ‘খিদিরপুরে’তে
গিয়ে যদি খিদে পায়, কিছু হবে খেতে।
যদি দ্যাখো ‘খিদিরপুরে’ খাদ্যের দোকান
বন্ধ, তবে খেয়ে নিয়ো এক খিলি পান।
দ্বিপ্রহরে বাতাসের তপ্ত ‘হলকা’য়।
রাজপথে যদি বাছা মাথা ঘুরে যায়,
তদুপরি পেটে যদি ক্ষুধার ‘হলকা’-ও
চলে, তবে পান ছাড়া অন্য কিছু খাও।
কলেরার ভয় যদি না-ই থাকে প্রাণে,
‘শরবত’ খেতে পারো পানের দোকানে।
যদি নাড়ি ছাড়ে, তবু মনে রেখো প্রিয়,
ঘোলের শরবত অতি উত্তম পানীয়।
বলাই বাহুল্য, কবিতায় যা-ই লিখি না কেন, কলেরার সুই যদি না-নিয়ে থাকেন, তবে আর যা-ই করুন, যত্রতত্র শরবত খাবেন না। কিন্তু সেটা কোনও কথা নয়। একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন, খিদিরপুরকে এখানে প্রথম বারে ৫-মাত্রা ও দ্বিতীয় বারে ৪-মাত্রা, ‘হলকা’কে এখানে প্রথম বারে ৩-মাত্রা ও দ্বিতীয় বারে ২-মাত্রা, এবং শরবতকে এখানে প্রথমবারে ৪-মাত্রা ও দ্বিতীয় বারে ৩-মাত্রার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের শব্দ আসলে গোটানো ও ছড়ানো দ্বিবিধ উচ্চারণের শাসনই মেনে চলে, এবং উচ্চারণ অনুযায়ী এদের মাত্ৰাসংখ্যারও তারতম্য হয়।
তবে একটা কথা। এখানে ব্যবহার করেছি বটে, কিন্তু এই ধরনের শব্দকে একই কবিতার দুই স্থানে দু-রকম মাত্রার মর্যাদা দিয়ে ব্যবহার করাটা ঠিক নয়। কবিতার মধ্যে এসব শব্দকে একবার যদি গোটানো উচ্চারণের শাসনে আনি, তো অন্তত সেই কবিতায় তাদের আর ছড়ানো উচ্চারণের স্বাধীনতা না দেওয়াই ভালো। দিলে তাতে মহাকাব্য অশুদ্ধ না হোক, পাঠককে অসুবিধেয় ফেলা হয়। ডাবল স্ট্যানডার্ড জিনিসটা কোনও ক্ষেত্রেই ভালো নয়। কবিতাতেও তাকে প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত।
সুতরাং অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখতে বসে আগেভাগেই স্থির করে নিন, যেসব শব্দ দ্বিবিধ উচ্চারণকেই মান্য করে, ঠিক কীবিধ উচ্চারণে আপনি তাদের বাঁধবেন। একবার যদি তাদের কাউকে গোটানো উচ্চারণে শক্ত করে বাঁধেন, তো অন্তত সেই কবিতায় অন্যত্র তার বাঁধনে আর ঢিল দেওয়া ঠিক নয়। কলকাতা’ আপনার কবিতায় যদি একবার গোটানো উচ্চারণে ৩-মাত্রার মূল্য পায়, তবে সেই কবিতাতেই পরে আর তাকে (কিংবা সেই রকমের অন্য কোনও শব্দকে) ছড়ানো উচ্চারণে বেশিমাত্রার মর্যাদা দেওয়া অনুচিত হবে। উপমা দিয়ে বলতে পারি, ব্যাপারটা হচ্ছে গান গাইবার আগে ‘স্কেল” ঠিক করে নেবার মতো। গান গাইতে-গাইতে মাঝপথে যেমন স্কেল পালটানো চলে না, কবিতা লিখতে-লিখতে তেমনি মাঝপথে উচ্চারণের বাঁধুনি পালটানো চলে না। কোন রকমের বাঁধুনি আপনার মনঃপূত, সেটা আগেই ঠিক করে নিন; মাঝপথে রীতিবদল না করাই ভালো।
সকলে এ-ব্যাপারে একমত নন, আমি জানি। সবাইকে আমার দলে টানতে পারব, এমন আশাও আমি করিনা। তবু আমি, শ্ৰীকবিকঙ্কণ সরখেল, যে-রীতিকে উচিত বলে মানি, অকপটে তা নিবেদন করলাম। অক্ষরবৃত্ত সম্পর্কে আলোচনা এখনকার মতো এখানেই শেষ হল।