বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে বিভাগীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ২৩ এপ্রিল ১৯৯৯ । অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল – “আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা চর্চা : আলোচনা সভা ও আঞ্চলিক কবিতা পাঠের আসর ।” মূল অনুষ্ঠানটি দুটি পর্বে বিন্যস্ত করে উপস্থাপিত হয় ।
প্রথম পর্বের সূচনাতে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ড. লায়েক আলি খান আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় কবিতা চর্চা নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত ও মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেন । অনুষ্ঠানের সূচনাতেই তাঁর বক্তব্য থেকে এ বিষয়ে তাঁর মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । তিনি বলেন যে, আধুনিক কবি বিষ্ণু দে লোর্কার প্রভাবে একদা ‘নববাবুভাষা’ ছেড়েছিলেন । ‘রেখো না বিলাসী কোনো আশা, / নববাবু ভাষা ছাড়ো মন / ... গ্রামে ও শহরে পাবে কবিতার ভাষা ।’ ড. খান উল্লেখ করেন যে, মনীশ ঘটকের আগে আদর্শ বাংলার কাব্যধারার সমান্তরালে কেউ আঞ্চলিক বাংলায় কবিতা লেখার সজ্ঞান চেষ্টা করেছেন বলে তাঁর জানা নেই । তাঁর মতে, ‘বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার আর সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখা দুটি স্বতন্ত্র ব্যাপার ।’ তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন , ‘বাংলা দেশের লাল মৃত্তিকার অঞ্চল মেদিনীপুর, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়া জেলার মানুষ নগর কোলকাতা থেকে দূরবর্তী, আদর্শ বাংলার কবিতার যে পরিমণ্ডল ব্যবহৃত হচ্ছে প্রান্তিক এলাকার মানুষজনের কাছে তা অক্রিয় ।’ প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত সহযোগে শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে এ বিষয়টি তিনি পরিষ্কার করেন । তাছাড়া তিনি সামান্য সময়ের মধ্যে অসামান্য বিশ্লেষণী দৃষ্টির সাহায্যে যে সমস্ত বিষয়গুলির ওপর আলোকপাত করেন তার মধ্যে উল্লেখ্য –
(১) সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উদ্ভব,
(২) আদর্শ বাংলা ভাষার উদ্ভব,
(৩) আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় কবিতা চর্চার উদ্দেশ্য,
(৪) আঞ্চলিক বাংলা কবিতার শৈলী ও প্রকরণ,
(৫) এই ধরনের কবিতা আন্দোলনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত । – ইত্যাদি ।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আশিস কুমার দে এবং অতিথি অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার । ড. দে তাঁর অভিভাষণে আঞ্চলিক বাংলা ভাষার কবিতা চর্চা নিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন যে, এই আঞ্চলিক বাংলা কবিতা চর্চার ধারায় প্রথম কবি অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় নাকি মনীশ ঘটক – তা অনুসন্ধান তথা গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার । তাছাড়া এই ধরণের কবিতায় শব্দ চয়ন ও শব্দ প্রয়োগ, আঙ্গিক এবং এই জাতীয় কবিতা চর্চার ভবিষ্যত নিয়ে তিনি আলোকপাত করেন ।
অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার তাঁর বক্তব্যে আলোচনা সভাকে আরো আকর্ষণীয়, প্রাঞ্জল ও সুমধুর করে তোলেন । কেননা তাঁর অভিভাষণ আঞ্চলিক বাংলা কবিতার উদ্ধৃতিতে সমৃদ্ধ ছিল । বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায় যা একান্ত কাঙ্ক্ষিত ছিল । তিনি আঞ্চলিক বাংলা কবিতার ভাবগত দিক, রূপগত নির্মিতির দিক অর্থাৎ অলংকার, ছন্দ, লয় প্রভৃতি উপযুক্ত দৃষ্টান্তসহ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেন ।
সেমিনারের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিশিষ্ট কবি মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, ভবতোষ শতপথী, ভরত চন্দ্র মাহাতো, যুগলকিশোর মাহাত, নারায়ণ চন্দ্র মাহাত, সৌরেন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। উপস্থিত কবিগণ স্বরচিত আঞ্চলিক বাংলা কবিতা শোনান । কবি ভরত চন্দ্র মাহাতো ও যুগলকিশোর মাহাত কবিতা ছাড়াও ঝুমুর গান পরিবেশন করে অনুষ্ঠানে অভিনব মাত্রা সংযোজন করেন । কবি নারায়ণ চন্দ্র মাহাত-র স্বরচিত আঞ্চলিক বাংলা কবিতার উপস্থাপন বৈশিষ্ট্য মনে রাখার মতো। কবি ও আবৃত্তিকার সৌরেন চট্টোপাধ্যায় অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব স্বাদের সঞ্চরণ ঘটান । এছাড়াও আঞ্চলিক বাংলা ভাষার কবিতা পাঠ ও আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করেন পরিতোষ মাহাত, দীনবন্ধু কর্মকার, জয়প্রকাশ দাস, রাজীব পাল, গোবিন্দ প্রসাদ বর্মন প্রমুখ ।
[ সংগৃহীত / প্রতিবেদনটি ১৯৯৯ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ‘বাংলা বিভাগীয় পত্রিকা’-তে প্রকাশিত হয়েছিল ।]