তপস্যা- আঠারো হাজার বছর
অজিত কুমার কর
দেহত্যাগের পরে সতী আবার এলেন ফিরে
এবারে তাঁর অনন্য রূপ দেখছে সবাই ঘিরে।
মা মেনকার কন্যারূপে কৃষ্ণবর্ণ নিয়ে
গিরিরাজের নয়নমণি লালন স্নেহ দিয়ে।
অপরূপা সুন্দরী সে জগৎ আলোয় আলো
চোখ ফেরানো যায় না মোটেই লুপ্ত ধরার কালো।
আরূঢ়যৌবনা কালী মগ্ন মহেশ্বরে
আরাধনা প্রত্যহ তাই শ্রদ্ধা-ভক্তিভরে।
কোনও দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই নিরাকাঙ্ক্ষ শিব
ঘোর তপস্যায় মগ্ন সদা নয় মোটেও উদগ্রীব।
দেবতাগণ জর্জরিত তারক-অত্যাচারে
স্বর্গরাজ্যে অশান্তি তাই যায় ব্রহ্মার দ্বারে।
বলীয়ান সে ব্রহ্মা-বরেই তেজস্বী তাই এত
স্বয়ং ব্রহ্মাও অসমর্থ, অজেয় বলে খ্যাত।
দেবতারাও কম যায় না ধূর্ত অতিশয়
বলে,' উপায় শীঘ্র বলুন রুখতে পরাজয়।'
দেবাদিদেব মগ্ন ধ্যানে ভাঙাতে হবে আগে
কার্যসিদ্ধি সহজে নয়, আসবে তবেই বাগে।
হৃদয়ে তাঁর কেবলই শিব, কন্যা কৃষ্ণকলি
তাঁরই রূপে ভাঙবে ও-ধ্যান কামাগ্নিতে জ্বলি।
ডাক পড়তেই কামদেবতা তথায় উপস্থিত
কামাসক্তি জাগাও শিবির তবেই হবে হিত।
এ কাজ আমি করবো কেন কীসের বিনিময়ে?
'মিলবে দারুন উপঢৌকন এমন কঠিন জয়ে।'
পবিত্র স্থান গঙ্গোত্রী-ই শিবের সাধনভূমি
কালীকেও পাবে সেথায় এক্ষুনি যাও তুমি।
উদ্ভিন্নযৌবনা কালী যদিও তখন পাশে
তবুও শিবের হেলদোল নেই কল্পলোকে ভাসে।
'হর্ষণবাণ' ক'রল প্রয়োগ কন্দর্প মদন
অব্যর্থ এই অস্ত্রখানি বিগড়ে দেবে মন।
ক্ষণেক পরে ছুঁড়ে দিল 'সম্মোহনাস্ত্রবাণ'
দেবাদিদেব ওঠেন নড়ে তপস্যা খানখান।
আজ্ঞাবহ বসন্তরাজ বুঝতে পারে সবই
এগিয়ে গেলেন মদনসখী সুন্দরী সুরভী।
ক্ষণেক পরেই গজিয়ে গেল তরু-গুল্মলতা
উঠল ফুটে পলাশ-কেশর স্বপ্নের রূপকথা।
শতদলের মধুরবাসে আকুল চরাচর
কামাগ্নিতে কাতর পক্ষী-হরিণী-কিন্নর।
মধুপানে মত্ত ভ্রমর সুন্দর পরিবেশ
আবির্ভূত হলেন শৃঙ্গার, মনোমোহিনী বেশ।
কেমন করে ঢুকবে মদন ঈশানের অন্তরে
কোনও ছিদ্র পায় না খুঁজে ভাবছে কী যে করে।
এমন সময় এগিয়ে আছে কৃষ্ণবর্ণা কালী
প্রণাম জানায় চরণপদ্মে ভক্তিসুধা ঢালি।
ক্ষণতরে বিঘ্নিত ধ্যান মোহিত মহেশ্বর
ছিদ্র পেতেই 'হর্ষণবাণ' বিঁধিল অন্তর।
কাজল-কালো এই রমণী দুলিয়ে দিল মন
এবার মদন পুষ্পবাণের ঘটায় নিক্ষেপণ।
বাসনা জাগ্রত হল নারী সম্ভোগের
প্রশ্ন একটা জাগল মনে, 'এমন আছে ঢের'।
সামান্যা এক নারী কালী তপের বালাই নেই
কেবলমাত্র সেবাব্রত করে তো যেই-সেই।
এ তো তেমন সুযোগ্যা নয় যেমন ছিলেন সতী
তপোব্রতা সুপবিত্রা ভক্তিমতী অতি।
কারও কপট অভিসন্ধি পিছনে এর আছে
চক্ষু খুলে দেখতে পেলেন দাঁড়িয়ে মদন কাছে।
শিব ঠাকুরের ক্রোধাগ্নিতে মদন পুড়ে ছাই
সেই ভস্ম অঙ্গে মেখে খোঁজেন অন্য ঠাঁই।
কোথায় গেলেন হৃদয়হরণ ভাবনা নিরন্তর
শিব বিহনে বৃথা জীবন ব্যথিত অন্তর।
এত শ্রদ্ধা এত ভক্তি, দিলেম সেবা ঢেলে
রেখেছিলেম হৃদকমলে প্রেমের অনলে জ্বেলে।
ফিরে এলেন কৈলাশে ফের ভারাক্রান্ত মন
কী করবেন পান না হদিস বিষণ্ণ এমন।
তপস্যাহীন আরাধনায় এমনই ফল হয়
নারদমুনি বোঝান তাঁরে হবেই হবে জয়।
তপস্যার যে মন্ত্র তোমায় শোনাচ্ছি এক্ষণে
'ওম নমো শিবায়' মন্ত্র জপবে তপোবনে।
সান্ত্বনা দেন গিরিরাজ আর মেনকা মৈনাক
কারও কথায় ভেজে না মন মা-কালী নির্বাক।
পিতার অনুমতি পেয়ে গেলেন উৎসস্থলে
তুষারাবৃত গঙ্গোত্রী অনুপম ঝলমলে।
হরশূন্য প্রস্তরময় নির্জন এই দেশ
অন্তরে তাঁর জন্মে বিলাপ সহ্য করে ক্লেশ।
দগ্ধ হচ্ছে কোমল তনু যজ্ঞের হোমানলে
তবুও তাঁর আক্ষেপ নেই মন্ত্র আউড়ে চলে।
গ্রীষ্মেও তাঁর দুনয়ন স্থির দিবাকরের দিকে
প্রবল শীতে ঢেকে রাখে তুষারে তনুটিকে।
সূর্য যেন শিবেরই মুখ দিবসে ভাবে তাই
নিরম্বু অনশন চলে 'কবে দর্শন পাই'।
বল্ক পরে জটাধারিনী মগ্ন সাধনায়
'ওম নমঃ শিবায়' মন্ত্র সর্বদা আওড়ায়।
কম দিন নয়, দীর্ঘ আঠারো হাজার বছর
দরিদ্র ব্রাহ্মণের বেশে দেখা দিলেন হর।
বাম হাতে তাঁর কমন্ডলু অঙ্গে উত্তরীয়
মাথায় জটা, দীপ্ত তনু এ বৈভব স্বকীয়।
শুধান তিনি কোমল স্বরে, 'কার দুহিতা তুমি
কেন এমন দুরূহ তপ ত্যজি আপন ভূমি?
সঙ্গিনী কী কোথাও গেছে, দেখছি না তো কাছে?
কোনও জবাব দেয় না কালী মৌন হয়েই আছে।
বিজয়া সই এগিয়ে গেল কালীর ইশারায়
সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে সম্মুখে দাঁড়ায়।
'স্বপ্নে সখীর কেবলই শিব অন্য পুরুষ নাই
মহাদেবের ধ্যানেই মগ্ন কোথায় তাঁরে পাই?'
এসব শুনে ছদ্মবেশী শিবের নিন্দা করে
গৃহত্যাগী শ্মশানবাসী কখন কী রূপ ধরে।
শৃঙ্গাররসশুন্য তিনি মজলে তুমি কীসে
ভয়ংকর এক কঠিন পুরুষ কণ্ঠ দগ্ধ বিষে।
'যত-ই তাঁর নিন্দা করুন তিনিই আমার প্রাণ '
এই কথাটি বলেই কালীর তখনই প্রস্থান।
পথ আগলে দাঁড়ান এবার নিজ মূর্তি ধরে
'দাঁড়াও অগ্নিমনোহারিণী', কণ্ঠে সুধা ঝরে।
'যেয়ো না গো মুক্তকেশী আমার এ হাত ধরো
বহ্নিমান কামাগ্নি থেকে আমায় উদ্ধার করো।'
------
তথ্যসূত্র : মহর্ষি মার্কণ্ডেয়-কথিতম্
কালিকাপুরাণম্ অবলম্বনে এক তাপসীর রোমান্টিক গল্পে - রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
-----
© অজিত কুমার কর