কেমন আছো আমাার প্রিয় স্বদেশ?
কেমন চলছে তোমার দিনকাল?
তুমি তো জানো, ’৭১ এর আগেই আমার জন্ম। আরও যদি বলি
পূর্বপাকিস্তানের শাসন আমলে ঠিক ’৬০ এর দশকের
গোঁড়াতেই আমায় নিয়ে মায়ের ছিল প্রসব বেদনা।
তখন ‘৫২’র ভাষা আন্দোলন কতটুকু থিতিয়ে এসেছিল
জানি না। তবে তার রেশ ধরেই জন্ম নিয়েছিল বাংগালীদের
বুকের মধ্যে আর এক নতুন দেশ, আর এক নতুন পতাকা, বাংলা ভাষার ন্যায্য অধিকার আদায়
আর স্বাধীনতার স্বপ্নে মৌলিক গনতন্ত্রের চর্চা।
কেমন আছো আমার প্রিয় স্বদেশ?
মনে কি পড়ে তোমার সে সব বিগত দিনের ঘটনা?
আজ ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আর ভারতের যুদ্ধের কথা খুব
মনে পড়ছে। শিশুর চোখ দিয়ে দেখা হয়েছিল যতটুকু ঠিক
ততটুকু। ব্ল্যাক আউট! আলোর ব্যাবহার নিষিদ্ধ। মনে আছে
আমার প্রয়াত পিতা কিভাবে ক্রসকান্ট্রি পাথারের আল পথ ধরে
আমদেরকে সংগে করে সতর্কাবস্থায় হাঁটছিলেন। নিকষ কালো আঁধার রাতে ম্যচের কাঠি
ক্ষনে ক্ষনে জ্বালিয়ে আমাদের নিরাপদ স্থানে নেয়ার জন্য
দেখাচ্ছিলেন বেঁচে থাকার পথ। দিয়েশলাইয়ের কাঠির আগুনে
বাবার হাতের আংগুল কতটুকু পুড়ে গিয়েছিল আজ তা আর মনে নেই।
কখনও জানাও হয়নি সে আগুনের মতই বাবার বুকের মধ্যে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে
জ্বলছিল কতটুকু দ্রোহের আগুন।
মাটির টানে, আগামির টানে শুধু উর্ধশ্বাসে ছুটে যাওয়া ছিল নিরাপদ আস্তানায় প্রানে বাঁচতে হবে বলে।
কেমন আছো আমার প্রিয় স্বদেশ?
কেমন চলছে তোমার স্বশস্ত্র ভাবনার দিনকাল?
সেইই ছিল আমার কোন স্বশস্ত্র যুদ্ধকে কাছে থেকে দেখা। ভয়কে নিরস্ত্র হাতে ধরে দেখা,
জীবনকে সাথে করে চেনা, দেশকে বুকে ধারণ করে ভালোবাসা।
অথচ যে আশা নিয়ে এই যে ত্যাগ তা ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ এই পাঁচ
বছরেই পালটে গেল। বরং বাংগালীদের পাল্টাতে হল বাধ্য হয়েই। পাকিরা মুখে
ভাই ভাই বললেও কোনদিন ভাইয়ের মর্যাদা দেয়নি। উন্নয়নের কথা
বলে কেড়েছে মুখের গ্রাস, ভাষার কথা বলে “মা” বলে ডাকার বক্ষে
সেঁধিয়েছে তপ্ত বুলেট, ধর্মের কথা বলে গীতাঞ্জলীর পাতায় এঁকেছে
বাংলা জননীর নগ্ন শরীর। “ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায়
ভালোবাসি”। “আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হব শান্ত”।
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের
স্বাধীনতার সংগ্রাম”। এমন কত পবিত্র সংগ্রাম আর দ্রোহের বানীকে গলা টিপে রুদ্ধ করতে চেয়েছে।
কেমন আছো আমার প্রিয় স্বদেশ?
কেমন চলছে তোমার স্বাধীনতা উত্তর দিনকাল?
সেই থেকে হল যুদ্ধ, হল দেশ ভাগাভাগি, বিজয়ী বেশে পেলাম
স্বাধীনতা, পেলাম দেশ, পেলাম পতাকা, পেলাম হাজার বছরের
শ্রেষ্ঠ বাঙালী, পেলাম জাতির পিতা। অথচ মুহুর্তে পিতৃহারা হয়ে
পড়লাম, দুঃখি জননী ছেড়ে গেল বাংলা, কিন্তু দুঃখকে হারাতে
পারল কই? তাই মা আমার আজও কাঁদে, কাঁদে বাবার শোকে, কাঁদে সন্তানহারা শোকে, কাঁদে চোখের সামনে স্বধীনতার অর্ধনমিত
পতাকা দেখে, কাঁদে পদ্মায় পানিহীন ধুঁ ধুঁ বালির চর দেখে, পাহাড় কাটার মাটি
দেখে, কাঁদে ধর্ষিত মেয়ের লাশ কোলে করে, কাঁদে ঘুঁষকে ন্যায্য কাজের অনৈতিক স্বীকৃত পুরস্কার হতে দেখে, কাঁদে জাতির পিতার আবক্ষ অবয়ব
ভূলুন্ঠিত হতে দেখে। শুধু কান্না কান্না আর কান্না। আজও সে কান্না
থামে না, কে এসে থামাবে সে কান্না! কেউ কি নেই? কেউ কি তৈরি নয়, কোন কালপুরুষ কি নেয়নি জন্ম?
কেমন আছো আমার প্রিয় স্বদেশ?
কেমন চলছে তোমার মধ্যম উন্নয়নের দিনকাল?
পদ্মার চরের বুক চিরে জন্ম নিয়েছে কংক্রিটের সড়ক, রেল সড়ক, রুপোলী ইলিশ মাছেরা মিছিল করে দেখতে আসে বর্ষার জলে উন্নয়নের সে ছোঁয়া, কষ্ট বুকে ডলফিনের দল তবুও জল থেকে মুখ বের করে দেখে মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে তার স্বদেশ, গাংচিলেরা বাতাসে গানের রেশ রেখে যেতে যেতে বলে মোহনায় ফিরে যাব তবু উভয় পাড়ে গড়ে উঠুক আধুনিক আওয়ামী শহর। তলাহীন ঝুড়ির তলায় যেন বেনিয়ারাই এখন দুই হাত পেতে থাকে ভিকেরীর মত কখন কাঁড়িকাঁড়ি ঝরবে সবুজাভ ডলার,
কখন তারাই সেই ছেঁড়া ঝোলা নিয়ে বলবে " আমার আল্লাহ নবীজীর নাম", হরিণ একটা বান্ধা ছিল গাছেরই তলায়।" সে হরিণ তো "সোনার হরিণ" নয়। একেবারে সুন্দর বনের হরিণ। সেই সুন্দরবন যেন এক হয়ে যায় পদ্মাকে পায়ে পায়ে জড়িয়ে। রয়েল বেংগল টাইগারের হুংকারে কেঁপে কেঁপে ওঠে বিশ্ব চরাচর, পৃথিবী অবাক- এ কেমন বাংগালী - বাংলার জয়গান আজিকে যেন এক অনন্য বিশ্ময়।
০৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১।