লিখাটা অনেকদিন পর চোখে পড়ল। এর মধ্যে আক্তার ভাই মারাও গেলেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমাদের স্থানীয় খুব নাম করা সংগঠন থেকে আমাকে সংবর্ধ্না দেয়া হয়েছিল। সেখানে সকলকে উদ্দেশ্য করে যে নিবেদনটুকু রেখেছিলাম আজ তোমাদের কাছে ফাঁশ করে দিলাম...
.............................................................................................
বিস্‌মিল্লাহের রাহ্‌মানের রাহিম। আজ সুনামধন্য ও ঐতিহ্যবাহী নবারুন পাঠাগার ও ক্লাবের  ৪১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর মহতি  অনুষ্ঠানের শ্রদ্ধেয় সভাপতি মোঃ হাসান চৌধুরী (মধু) বিশেষ অতিথিবৃন্দ,ক্লাবের প্রাক্তন ও নব্য  সদস্য/সদস্যাবৃন্দ, উপস্থিত হিলি এলাকাবাসীর সুধীজন এবং অন্যান্য এলাকা থেকেও আগত সম্মানিত অতিথিবৃন্দ আসসালামু আলাইকুম। মাঘের শেষে যখন ফাগুনের হাওয়া দোল দিয়ে যাচ্ছে ভালবাসার মনে, যখন অহংকারের ফেব্রুয়ারী মাস এবং মহান আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস সেই অহংকারের ২১ শে ফেব্রুয়ারী বাংগালীর  হৃদয়ের আংগিনায় সমাসন্ন, ঠিক সেই সময় নবারুন্ন ক্লাবের বিজ্ঞ কর্ণধারদের দ্বারা বাংলা সাহিত্যে আমার ক্ষুদ্র  অবদান ও প্রয়াসের জন্য আমাকে আপনারা নির্বাচিত করে সম্বর্ধনা দেয়ার যন্য মনোনীত করেছেন। এর জন্য আমি যার পর নেই আপনাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। এই যথাযোগ্য সম্মান আমি আমার বাকীটা জীবন গর্বের সাথে বয়ে নিয়ে বেড়াবো এবং সাহিত্য অংগনে যেখানেই সুজোগ হবে সেখানেই আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য সবসম স্বচেষ্ট  থাকব। আর  নির্দ্বীধায় এটাও বলে বেড়াবো যে হাজার বছরের ঐতিহ্যে ও কৃষ্টি পরম্পরায় লালিত সম্মানিত হিলিবাসী জানেন – কী ভাবে গুনির কদর করতে হয়, সম্মান দেখাতে হয় এবং যোগ্য অবদানের জন্য সম্মানিত করতে হয় তার কৃতি সন্তানদের। যদিও জানি না আমি আদৌ এই সম্মানের জন্য যোগ্য কি না।  
আমি আজ আবেগে এতটাই আপ্লুত যে, আমার এই যোগ্য মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠার পেছনে যারা ছিলেন তাদের অনেকের কথাই ভুলে যাচ্ছি। তবুও আজ প্রথমেই স্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি শৈশবে আমাদের স্কুলের জনাব স্যার, অনিল স্যার, নাসির স্যার, প্রধান শিক্ষক মহিউদ্দিন স্যার, মৌলভী স্যার এবং আরও অনেক শিক্ষককে। আজ তাঁদের অনেকেই হয়ত প্রয়াত হয়েছেন। এ ছাড়াও আমাদের বাড়িতে আরবী গৃহ শিক্ষক মৌলভী রশিদ, ক্লাশ শিক্ষক মফিজ উদ্দীন (গেদু স্যার), সংগীত গুরু মোঃ রুহুল কুদ্দুস, সংগীত ও সুর পিপাসু আমার বড় মামা আহাদ আলী এবং মেঝ মামা সাহাদ আলী। আজ আমি অত্যন্ত নস্টালজিয়ায় ভুগছি। তবুও অনেকের মাঝে যাঁদের কথা না বললেই নয় তাঁদের কথা একটু হলেও আমাকে বলতেই হবে।  বার বার মনে পড়ছে শৈশবে দেখা আমাদের হিলির ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পরিবারের বাড়ির আংগিনা ফুলে ফুলে ভরে থাকা সেই সকল চাচা-চাচি,খালা-খালু, কাকা-কাকি, ভাই-ভাবিদের ঘর –বাড়ির কথা এবং হাড়ি পর্যন্ত্য অধিকারের কথা। যাঁদের প্রেম,  আদর -স্নেহে, মায়া-মমতায় এবং নিঃস্বার্থ দোয়া এবং আশির্বাদে বেড়ে উঠেছিলাম আমার অনেক গর্বেই এই হিলির আকাশ, বাতাস জল আর মাটিতে, যেখানে আমার নাড়ি আজও প্রোথিত। আজ তাদের অনেকেই নেই, তাঁদের কথা একটু করে না বললেই নয়।  যেমন মন্ডল পরিবারের শ্রদ্ধেয় রফিক মন্ডল,শফিক মন্ডল, মুনশি পরিবারের শ্রদ্ধেয় কুদ্দুস মুনশি, মল্লিক পরিবারের মকবুল মল্লিক, আফজাল মল্লিক, লক্ষ্মি কাকা, বিনয় কাকা, শিরু কাকা, যোগেন স্যার, নারায়ন স্যার এমন অনেক অনেক পরিবারের মুরুব্বিগন যাঁদের কথা আজ বার বার মনে পড়ছে। সেই সাথে মনে পড়ছে বিভিন্ন বয়সের আমাদের বড় ভাইয়েদের কথা। আর সর্বপরী যাঁর কথা ক্ষনে ক্ষনে অশ্রুশিক্ত নয়নে মনে পড়ছে তিনি হলেন আমার প্রয়াত পিতা সিংহ পুরুষ হিলি বিনির্মানে সদা আত্মত্যাগী মরহুম সৈয়দ সোলায়মান আলী মীর সাহেব এবং আজও জীবিত আছেন আমার বৃদ্ধ মা‘কে। আমি  নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি এ জন্য যে আমি কেবল তাঁদের সন্তানই ছিলাম না। আমি যেন ছিলাম সকলের সন্তান এবং ছোট ভাই।  এ ছাড়াও আমার ছোটবেলার একান্ত সাথীরা যেমন- মন্টু, তুর্কী, আলমগীর, আল্পনা, পুর্নীমা, ফিরোজা, কোহিনুর, মকবুল, সোলেমান, মন্ডল, ছোটন, মধু চাচা, ফোট ভাই, দুলাল ভাই আজ এ মুহুর্তে  অনেকের কথা মনে পড়ছে। যাদের নাম বলতে পারলাম না তাদের সম্পর্কও এ হৃদয়ের গভীরে এখনও গেঁথে আছে। আর একজন আক্তার মুন্সি,আমাদের আক্তার ভাই। এই হিলিবাসীর যোগ্য কৃতি সন্তান যিনি আজও আমাদের জীবনের একজন আদর্শ পুরুষ। জেনেছি তিনি অসুস্থ। তাঁর সুস্থতা কামনা করছি। আর যাঁরা প্রায়ত হয়েছেন, বিশেষ করে তদানিন্তন ভারত বর্ষের কংগ্রেসের নেতা, অত্র এলাকার  সেই প্রান পুরুষ মরহুম আত্তাব উদ্দীন চৌধুরী, যাঁকে আপনারা তাঁর লিখা “ অতীতের কথা “ বইতে অসামান্য অবদানের জন্য মরোনত্তর সম্বর্ধনা দিতে যাচ্ছেন, তাঁর জন্য রইল আমার হাজারও স্যালুট । আজ এ পরিসরে তাঁদের সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আজ গর্বে আমার বুক ভরে যাচ্ছে যে আজ এই একই অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গীত গুরু এবং বিশেষ করে সাহিত্যাংগনে আমার হাঁটাহাঁটি করার পেছনে যিনি পথিকৃত, যাঁর কথা আমি ইতি পুর্বেই বলেছি মোঃ রুহুল  কুদ্দুস, তাঁকেও সম্বর্ধনা দেয়া হচ্ছে। এখানে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে যে, জীবনে একটি বই প্রকাশ করা সন্তান জন্ম দেয়ার মত। আমার সেই প্রথম সন্তানের জন্ম অর্থাৎ আমার প্রথম কাব্য গ্রন্থ- “ কবচ “ আমি আমার এই সঙ্গীত গুরুর নামে উৎসর্গ করেছি আমার আজীবন কৃতজ্ঞতা এবং ঋণের জন্য।    
আজ একটা কথা না বললেই নয়। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই হিলি প্রপারের একমাত্র মেজর হয়েও নিজেকে কখনও একজন  মেজর মোখলেস মনে করতে পারিনি, কখনো বেতার-টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত সিনিয়র গায়ক হয়েও নিজেকে একজন শিক্ষিত গায়ক মনে করতে পারিনি, দক্ষিন বাংলা আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন  থেকে সাহিত্যে অবদানের জন্য পদক প্রাপ্তির পরও নিজেকে কবি সাহিত্যিক ভাবতে পারিনি, সাপ্তাহিক ভোরের তারা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হয়েও আমি সাংবাদিকতায় জুজুর ভয় ধারণ করতে শিখিনি,  ঢাকায় বাস করেও নিজেকে ঢাকাবাসী হিসেবে ভাবতে পারিনি। আমি আজও ভাবি আমি মোখলেস এবং কেবলই আপনাদের এই হিলির মোখলেস ওরফে পলক রহমান!!  
এ অবধি আমার ১০টি কাব্য গ্রন্থ-  কবচ, ভাংগা আয়না, মধ্যরাতে কাকের ডাক, তোমার জন্য, শব্দ প্রহরী, হৃদয়ের গান, নিরাপদ সড়ক চাই, প্রবারণা পুর্ণিমার ছাদ, প্রেম ও ভালবাসার সাত কাহন এবং এবারের বই মেলায় “আমি যেন এক বেজন্মা ফেরারী “ বের হয়েছে। এবারে কাব্য গ্রন্থ থেকে একটা কবিতা আবৃতি করার লোভ সামলাতে পারছি না-
মজিদ চাচা এবং আমার ছেলেবেলা
হিলি ইস্কুলের করিডোরে প্রকাণ্ড বট গাছের
তলায় এসে বসতেন মজিদ চাচা।
সাথে কিশমিশ লাগানো লাল এবং দুধ সাদা
রঙের আইসক্রিমের শীতল বাক্স। ঐ বাক্সের ভেতরে  
আটকে থাকত আমার প্রান। কখন স্কুল
ছুটি হবে,কখন বাজবে ছুটির ঘণ্টা! এলেবেলে চিন্তা
তখন থমকে দাঁড়াত বাড়ির পথ চেয়ে।

আচ্ছা মজিদ চাচা কি এখনও বেঁচে আছেন,
উনার বয়স কত হল। ছেলে অথবা মেয়ের ঘরের
নাতি নাতনিরা এসে ওর দাড়ি নিয়ে কি খেলা করে?
আর বেঁচে থাকলেও বয়সের ভারে সে হয়ত এখন
বিছনাগত। ফাঁকি দেয়ার অপেক্ষায় তার নিজেরিই প্রান  
এখন হয়ত বন্দি পড়ে আছে দেহের বাক্সে।

এখনও ঐ বট গাছটার কাছে এসে পথ হারাই,
একাকী দাঁড়িয়ে থাকি, আবার কখনও তার তলায়
গিয়ে বসি। ক্লান্ত দুপুরে মজিদ চাচাকে খুঁজে বেড়াই।  
শতায়ু বট গাছকে প্রমিত চিত্তে জিজ্ঞেস করি
মজিদ চাচার কথা, জিজ্ঞেস করি কেমন ছিল
আমার ছেলে বেলা, কোন আইসক্রিমটার জন্য
কি ভাবে বায়না ধরতাম মজিদ চাচার কাছে?  

আবার কখনও মনে হয়, স্কুলে যাওয়ার জন্য
কি বর্ণের পোষাক পরতাম?  পায়ে কি জুতো থাকত,
কেরলিন শার্টের সাথে টাই ঝুলত কিনা। পেন্সিলের
শার্পনার  হারিয়ে কাঁদতাম কিনা, বড় বুবু কি বলে
শান্তনা দিতেন, মজিদ চাচা সেই শান্তনার সুরে
সুর মেলাতেন কিনা। কোন উত্তর মেলে না। তবুও
বোবা বট গাছের সাথে বিড় বিড় করে কথা বলি বহুক্ষণ।  

এখন জিন্স প্যান্ট আর পোলো শার্টের হাল ফ্যাশনে
নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। শিততাপ নিয়ন্ত্রিত শহরের
নামি দামী ফাস্ট ফুডের দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডায়
এসে বসি। বার্গার, সমুচা কিংবা শরমা খেতে খেতে
কোকের গ্লাসে চুমুক দিই। কিন্তু মন ভরে না।
হায় ছেলেবেলা এত ছোট কেন তোমার বয়স !
কি হত আর একটু বড় হলে?

মজিদ চাচার চোখেও স্বপ্ন ছিল। আমার মত  
তার একটা ছেলে থাকবে, বই হাতে স্কুলে পড়তে যাবে,
আইসক্রিমের জন্য বায়না ধরবে। স্কুলের অদুরে
সরকারী দাতব্য চিকিৎসালয়ে বসা ডাক্তার বাবুর
মত ডাক্তার হবে। জ্বর হলে কতদিন ডাক্তার বাবুর
কাছে গিয়ে বড়ি এনেছে। তার ছেলেরা কি মানুষ
হয়েছে, তাকে কি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় !

ইউনিভারসিটির ক্যাম্পাসে বিশাল সামিয়ানার ছায়ার
নীচে এসে দাঁড়াই। স্কুলের করিডোরে দাঁড়ানো প্রকাণ্ড
বট গাছের কথা মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়
মজিদ চাচার কথা। কোলাহল থেকে নিজেকে  
আড়াল করি।আমি খোলা আকাশের দিকে তাকাই,
কনভোকেশনের ঝুঁটি আলা টুপি ছুঁড়ে দিই শুন্য আকাশে।
কিন্তু ছুঁড়ে ফেলা যায় না স্কুলের করিডোরে দাঁড়ানো
প্রকাণ্ড বট গাছ, মজিদ চাচার আইসক্রিমের বাক্স  
আর আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলে বেলা।

সাহিত্যাংগনে হাঁটা হাঁটি করতে করতে এ ছাড়াও ০৩টি উপন্যাস, ০১টি গল্প গুচ্ছ এবং ০১টি ধর্মীয় আলোচনার বইসহ এ পর্যন্ত্য প্রায় ১৬টি বই প্রকাশ হয়েছে।  আমার সব বই আমি “পলক রহমান “ এই ছদ্মনামে লিখে থাকি।  আমার কিছু বই গার্লস কলেজ লাইব্রেরী এবং হিলি পাবলিক লাইব্রেরীতে আছে। এবার হিলিতে আসলে এই মহতি ক্লাবের জন্য আমার বই ছাড়াও আরও কিছু বই সংরক্ষন করার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। আশা রাখি এ সুজোগটুকু আমি পাব।    
আজ এই মহতি অনুষ্ঠানে আমাকে সম্মানিত করার জন্য আমি যেমন ভাবে আনন্দবোধ করছি তেমনি আমি স্বশরীরে আপনাদের মাঝে উপস্থিত থাকতে না পেরে নিজেকে  দুর্ভাগা মনে করছি। তবুও আমার লেখাটুকু পড়ে শোনানোর জন্য এবং ধৈর্য সহকারে শোনার জন্য আন্তরিকভাবে আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সে সাথে আরও  কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমাকে এমন ভাবে সম্বর্ধনা দিয়ে আমাকে আপনাদের হৃদয়ে স্থান করে দেয়ার জন্য। আমি আপনাদের সকলের দোয়া চাই, আল্লাহ্‌ আমাদের সকলের মঙ্গল করুন এই কামনায় আমি আপনাদের একান্ত মোখলেস। আসসালামুয়ালাইকুম, আল্লাহ্‌ হাফেজ।