সেদিন ফ্ল্যাট বাড়িতে ফ্রীজ থেকে গড়িয়ে পড়া পাকা আমের শব্দে হারিয়ে গেলাম কিশোর বেলার গ্রামের বাড়িতে। চালে পাকা আম পড়ার শব্দ, গাছের তলায় ধুপ করে আম পড়ার শব্দ আজও এত পরিচিত, এত নস্টালজিক তা যেন মুহুর্তে কানের পর্দায় দ্রীম দ্রীম করে বাড়ি খেলো। যা বলে শেষ করা যাবে না। কান খাড়া করেই রাখলাম আরও কিছুক্ষন। আরও একটা দুইটা আম গড়িয়ে পড়ে কি না তা শোনার জন্য। কিন্তু অন্য শব্দের ভীড়ে আম পড়ার শব্দ তখন বন্ধ।
বাড়ির সদস্যরা বুয়াকে এক হাত নিতে ব্যস্ত। আমি বললাম থাক না কি এমন ক্ষতি হল। কিন্তু এত দাম দিয়ে কেনা আম নষ্ট হল কিনা সে শোকেই ব্যস্ত বাড়ির সকলে। অথচ আমার কাছে ওই একটা আম নষ্ট হয়ার চেয়েও আম পড়ার শব্দ শুনতে পাওয়ার জন্য যে কত মূল্যবান শৈশব অতীত খেলা করে যাচ্ছিল তা বুঝাই কি করে। সেই চেনা শব্দটুকু যেন না হারায়। আম ফ্রীজ থেকে পড়ুক, আরও দুই চার টা পড়ুক , প্রতিদিন পড়ুক। ওরা ঝগড়াটা বন্ধ করুক নৈলে আম পড়ার শব্দের রেশটুকুও যে কেড়ে নিচ্ছে ওরা। কাজের বুয়ার সাথে এতক্ষনের ঝগড়ায় মৃত্যু হতে থাকল আমার ভেতরে ভেতর উন্মুখ হয়ে উঠা স্মৃতির শব্দ রেশ আর হারিয়ে যেতে লাগল মা'র আঁচল তলের স্মৃতি।
ইচ্ছে হচ্ছিল বুয়াকে বলি প্রতিদিন আমি বাসায় থাকলে বুয়া যেন ইচ্ছে করেই একটা দুইটা আম- ফ্রীজ থেকে টাইলসের মেঝেতে ফেলে দেয়। কেউ বললে বলবে স্যারে পাকা আম মেঝেতে ফেলে দিতে কইছে। যাতে করে আমার বুকের ভেতরে আমবাড়িতে আমার শৈশব দোল খেয়ে যায়, আমি যেন আর একটু বেঁচে থাকি সে শব্দের মাঝে। আমি গোপন চোক্ষে গ্রামের বাড়িটি দেখে হারিয়ে যাই সেই পরিবেশে একটু চাংগা থাকতে, আর একটু করোনা, রোগ, শোক, ভুলবুঝাবুঝির সংঘাতের কথা ভুলে থাকতে পারি বাবা-মা'র কবরটাকে বুকে চেপে ধরে থাকতে পারি।
মনে আছে লাল সিঁদুরে পাকা আম নিয়ে একটা দিনের কথা। মাকে বললামঃ তুমিও একটু খাওনা মা। তোমাকে ছাড়া এত সুন্দর আমটা খেতে মন চাইছে না। মা বলেঃ পাগল ছেলে আমার! তাই বলে কাছে টেনে নিয়ে মিছেমিছি জিহবায় শব্দ করে খেয়ে বলে নে খেয়েছি এবার খা বাবা। মায়ের দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করতাম, মা- তুমি এমন কেন এত ভালোবাসো কেন অথচ কারও কাছে কেন তোমার অভিযোগ বা বায়না থাকে না। ভাবতে ভাবতে ছুট দিতাম আম হাতে বাহির পানে।
আমের মৌসুম বলে এখন আর মৌসুমও নেই, প্রতিক্ষা নেই। আবেদন নেই। সারা বছর কত কিছিমের আমের হাট বসে, শপিং মল, সুপার মার্কেট, কাঁচা পাকা বাজার কত বড় বড় আম বিতান, আমের আড়ত। ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপাত, গোপালভোগ, ফজলি, আশ্বিনা, বোম্বাই, অগ্নি, অমৃত ভোগ, আলফাজ বোম্বাই, আতাউল আতা, আরিয়াজল, আরাজনমা, আলম শাহী, গিলা, গোলাপবাস, আনারস, ইলশাপেটি, কলাচিনি, কাঁচামিঠা, কালিয়া, কৃষ্ণচূড়া, টিক্কাফারাশ, টিয়াকাঠি, কালাপাহাড়ী, কালিভোগ, চোষা, আম্রপালি ইত্যাদি।
আনমনের কোন আম মেলার দোকানের সামনে ধীর পায়ে এসে তবুও দাঁড়াই। কিছু বাতলে দেয়া আম কিনি খাই ভালো লাগেনা। নিজের চয়েসের আম আরও কিনি। কিন্তু মনে হয় হরেক রকম নামের আমের মধ্যে ঐ একটা লাল সিঁদুরে গোপাল ভোগ আম ছাড়া আর কোন আমই চিনি না। গাছের নীচে কুড়ে পাওয়া আমের সেই মিষ্টির স্বাদ আর কোন দিন কোন আমে পাওয়া হল না। বড়ই আফসোস!
বগুড়া সি এম এইচ
২ জুন, ২০২১।