“নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে,
চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে”
সেই পঞ্চাশের দশকের ছায়াছবির গান। ছায়াছবি “পৃথিবী আমারে চায়”। হোক না ছায়া ছবির গান, কিন্তু তা আধুনিক গানও বটে। সে সময়ের আধুনিক গান। স্পস্ট করে বললে বলতে হয় প্রখ্যাত গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার এর লেখায় বিশিষ্ট সুরকার নচিকেতা ঘোষ এর সুরে শুধু সুরেলা নয়, বললে বলতে হয় অসাধারণ স্বরমাধুর্যে ভরা জাদুকরী কন্ঠের ছোঁয়া দিয়েছিলেন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী গীতা দত্ত। এখনও যার কথা সুর আর কন্ঠের আবেদন এতটুকু কমেনি। ১৯৫৭ হলে প্রায় ষাট/ঊনষাট বছর। বুঝাই যায় এ গান শুনে, এ ছায়া ছবি দেখে আমাদের সে প্রজন্মের বাবা মা’রা কতবার প্রেমে পড়েছে অথবা প্রেমে ছেঁকা খেয়েছে কে জানে। আজ বাবা মা বেঁচে থাকলে জিজ্ঞাসা করে দেখতাম। না মোতেঈ বানিয়ে বলছি না, আপনি পারবেন কি পারবেন না আমি কিন্তু ঠিক পারতাম বাবাকে এবং মা’কে বলতে যে, তারা কোন গান শুনে সলজ্জ্ব চাপা প্রেমের আবেগে ভালবেসেছে একে অপরকে। সেখানে এই গান কতটুকু তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কারন প্রেম ভালবাসা তো সার্বজনীন, আর তা আমাদের বাবা মা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা হবে কেন? যা আমরা যারা এ প্রন্মের তারাও আজও অবলীলায় এ গানের মুর্ছনায় প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেতে পারি অনায়াসে। এবং বিশ্বাস আগামী আরও হাজার বছর বোধ হয় এ ধারাই অব্যাহত থাকবে এমন শ্বাশত গানের কথা, গায়কী কন্ঠ এবং সুর মূর্ছনায়।
আজ অবশ্য গান নিয়ে যতটা নয়, বরং এই গানে বাঁকা শব্দের উপর কেমন যেন একটা আকর্ষন অনুভব করাতে তা নিয়ে কিছু লেখার জন্য তাড়না অনুভূত হোচ্ছিল। তাই বাঁকা নিয়ে ভাবতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে পৃথিবীর প্রথম মানবী বিবি হাওয়া(আঃ)এর সৃষ্টি। পাঁজরের বাঁকা নিয়ে একটা কনসেপ্ট আল-কুরআনেও আছে। সূরা তারিক এর ৫ থেকে ৭নং আয়াতের ব্যাখ্যা হল এমন যে, “অতএব, মানুষের দেখা উচিত কি বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে। এটা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও পাঁজরের মধ্য থেকে।” আরেকটি প্রচলিত কথা যেমন হযরত আদম (আঃ) ঘুমিয়ে ছিলেন এবং তার বাম পাঁজরের পিছন হতে হযরত হাওয়া (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর আদমের ঘুম ভেঙ্গে তাকে দেখলে তিনি আকৃষ্ট হোন এবং তার মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি হয়।এ কথাগুলো পুরোপুরি বাইবেলের। বাইবেলের এই গল্প মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে।
৪৮০৭ নং হাদিসে বলা হচ্ছে বিশ্বের প্রথম মানবী বিবি হাওয়া(আঃ)কে হযরত আদম(আঃ)এর পাঁজরের হাঁড় হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসহাক ইব’ন নসর (রহঃ), আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে আল্লাহ এবং আখিরাতের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন আপন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যহার করবে। কেননা, তাদেরকে সৃষ্টী করা হয়েছে পাঁজরের হাড় থেকে এবং সবচেয়ে বাঁকা হচ্ছে পাঁজরের ওপরের হাড়। যদি তুমি তা সোজা করতে যাও, তাহলে ভেঙে যাবে। আর যদি তুমি তা যেভাবে আছে সে ভাবে রেখে দাও তাহলে বাঁকাই থাকবে। অতএব, তোমাদেরকে ওসীয়াত করা হল নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যহার করার। তবে তুমি তোমার মন মত পূর্ণ সোজা না করিয়া ছাড়িবে না। আর যদি তাকে তোমার মন মত পূর্ণ সোজা করায় তৎপর হও, তবে অবশ্য তার মধ্যে একটু আস্ত থাকিবে, কিন্তু ভাঙ্গিবে না। সহায়তা লাভ করিয়া নিজের অনেক কল্যাণ সাধন করিতে পারিবে।’’(বোখারি শরিফ, ২০৫)
এই স্ত্রী’র বাঁকা চরিত্র নিয়ে তাই হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘আমি যদি কোন ব্যক্তিকে অন্য কোন ব্যক্তির সামনে সিজদা করার নির্দেশ দান করতাম তবে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য।’’ (তিরমিযী)। এ জন্য হয়ত আমরা প্রায়ই একটা ব্যাখ্যা ভুল করে বসি এ বলে যে, স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত। তবে সেটা নাহলেও স্বামির ইচ্ছাটা মেনে নেওয়া এবং স্বামীকে সকল পরিস্থিতে সুখে রাখা একজন স্ত্রীর দায়ীত্ব ও ভালবাসার মধ্যে পড়ে তা এ হাদিস থেকে বেশ অনুমেয়। “স্বামীকে সেজদাহ করা” ইসলামিক এ দৃষ্টি ভংগিতে অবশ্য আজকাল স্ত্রী জাতীদের ঘোর আপত্তি এবং সমালোচনাও বেশ পরিলক্ষিত।
আঁকাবাঁকা নিয়ে ছোটকাল থেকেই একটা বিষয় এখনও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। একবার সে ছোট কালেই শুনেছিলাম আচ্ছা মানুষের পায়ে চলার পথ আঁকাবঁকা হয় কেন? আসলেই সে ছোট থেকে আজ অবধি দেশে বিদেশে যেখানেই এমন পায়ে চলার পথে দেখেছি সেখানেই সচেতন ভাবেই মনে পড়েছে- মেঠো পথটা আঁকাবাঁকা কিনা। আশচর্য হোয়ে খেয়াল করেছি সেখানেও মানুষের পায়ে চলার পথটা আঁকাবঁকা। কিন্তু কেন? এ নিয়ে কোন ব্যাখ্যা হয়ত চিকিৎসা বিজ্ঞানে থাকতে পারে, অথবা জীব বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ কোন গবেষণা পত্রে উদ্দৃতি থাকতে পারে। কিন্তু আমার মনে হোয়েছে বিবি হাওয়া (আঃ) হযরত আদম (আঃ) এর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে বাঁকা বলেই যেমন তাদের (মেয়েদের) চাল চলন, ভাবনা, দৃষ্টি, কথা- বার্তা, নিজের স্বামীর বাইরে অন্য কারও সম্পর্কে কেমন বাঁকা মনোভাব তেমনি আদম (আঃ) এরও বাঁকা স্বভাব নিশ্চই ছিল। তা না হলে বিবি হাওয়া(আঃ)কে মাফ করে দেয়ার জন্য বেহেস্তের থেকে বের হতে হবে জেনেও স্রষ্টার কাছে মিনতি জানাতে পারত। যা হোক পরে স্রষ্টাই তাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে সে তস্র সৃষ্টি কর্তার কাছে মাফ চাইবে। এ বিষয়টা এবং বাঁকা নিয়ে যদি রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনি তাহলে দেখি যে,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বলাকায় যে মনোভাব প্রকাশ করেছেন তা হলঃ
“সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল--যেন খাপে-ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাঁটার শেষে রাত্রির জোয়ার
আঁকা-বাঁকা পথে এগিয়ে চলাটাই প্রকৃতির নিয়ম।“
তিনি ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা বলেও সাহিত্য রসের জন্ম দিয়েছেন। এও বলেছেন আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলাটাই প্রকৃতির নিয়ম।
সুতরাং আমাদের চলার পথ একেবারেই সোজা নয় একটু বাঁকাও বৈকি। বরং এটা সব সময়ই বাঁকা। তাই বাঁকা শব্দ নিয়ে সাহিত্যরস, সংগীত এবং সংঘাত কম নেই। বাঁকা অনেক জিনিষের বিড়ম্বনাও কম নয়। তাইত এই বাঁকা শব্দ অনেক শব্দের সাথে বসে মধুরতা যেমন ছড়ায় তেমনি তিক্ততাও কম নয়। এ যেন এমন, ঐ বাঁকা পাঁজরেড় হাড়ের মত। চেষ্টা করলে ভেংগে যেতে পারে আবার চেষ্টা না করে ছেড়েও দিতে ভয় করে। যেমনঃ বাঁকা কথা, বাঁকা চলন, বাঁকা দৃষ্টি (যদিও বাঁকা চোখ ভাল লাগে), বাঁকা কথা ইত্যাদি।
যা হোক, বাঁকা্তে যে কোন জিনিষের, কোন শব্দের, কোন অংগের, কোন ভাবনার, কোন ভালবাসার একটা সৌন্দর্য্য এবং একটা নান্দনিকতা অথবা মাদকতা স্পষ্ট। তেমনি এ নিয়ে অনেক শব্দ, কথা, বাক্য, কবিতা, গান আমাদের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিতে অহরহ প্রচলিত। যেমনঃ
আধুনিক গানেঃ
বাঁকা ঠোঁটের রাঙ্গা রঙে , গোলাপ ভেসে উঠে ,
তাই দেখে হৃদয় আমার , বধুর পায়ে লুটে ।।
অথবা,পল্লী গীতিতেঃ
“কূল বাঁকা গাঙ বাঁকা, বাঁকা গাঙ্গের পানি,
সকল বাঁকায় বাইলাম নৌকা তবু বাঁকারে না চিনি।”
শত বছর পূর্বে হাছন রাজার হৃদয়ে প্রেমঃ
“নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে
হাছন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে। “।
নজরুলের অমর বিদ্রোহী কবিতায়ঃ
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য;
এ বিষের বাঁশী শুনে ঘরে থাকা দায়। যুদ্ধ করতে কার না ভাল লাগে? কারো ভাল লাগে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে, কারো ভাল লাগে বাকযুদ্ধ! প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে ছেলেরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, মেয়েরা বাক্যবানে। তাই ধূর্তরা বলে যখন একটি ছেলে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, বা একটি মেয়ে অনেক অনেক কথা বলে তাকে ভয় পাবার কিছু নেই। বরং যখন ছেলেটি চুপ করে থাকে, বা মেয়েটি বোবা কান্না কাঁদে, তখন তাকে ভয় করো। কারণ, সেটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।
আমিও কোন পরিসরে আমার এক কবিতা “বাঁশি”তে (কাব্য গ্রন্থঃ শব্দপ্রহরী) লিখেছিলাম কৃষ্ণের বাঁকা বাঁশি আজ অবহেলায় ফিরে গেছে জংগলে, অথবা শুকনো জল শুন্য নদীর বালু চরে স্রোতহীন স্বল্প জলের মধ্যে পড়ে আছে। তার ভেতর আশ্রয় নেয়া একটা বাইলা মাছ লেজের আঘাতে বালি নাচিয়ে বসবাস করে। নদীতে জল নেই। তাই রাধা সখীদের নিয়ে জলকেলিতে আসবে কেমন করে? আর বাঁকা চোখে কি ভাবে কৃষ্ণের গতবিধি লক্ষ্য করবে। তাই রাধারা মরে গেছে, কৃষ্ণেরা মরে গেছে সাথে তাই রংলীলার প্রেমও মারা গেছে যেন।
রবিন্দ্রনাথের “কোপাই”
ছিপ্ছিপে ওর দেহটি
বেঁকে বেঁকে চলে ছায়ায় আলোয়
হাততালি দিয়ে সহজ নাচে।
হাটে যাবে কুমোর
বাঁকে ক’রে হাঁড়ি নিয়ে;
পিছন পিছন যাবে গাঁয়ের কুকুরটা;
আর, মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরু
ছেঁড়া ছাতি মাথায়।
ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই মানব সমাজকে এগিয়ে যেতে হয়। তা সেই জীবনের ঊষালগ্ন থেকে প্রকৃতির বিরূপতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে, দাসপ্রথা, মধ্যযুগীয় সামন্তপ্রথা ভেঙ্গে আধুনিক সভ্যতায় উন্নীত হওয়া প্রতিটি সংগ্রামেই মানুষ এগিয়েছে অপ্রতিরোধ্যভাবে। প্রতিটি সংগ্রামেই মানুষ প্রায় বাঁকা পথেই কেবল তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। সোজা পথে অধিকার আদায় করা যে সহজ নয় তা অনেক ইতিহাস স্বক্ষী হয়ে আছে। যাই হোক বাঁকা নিয়ে যত ভাবনাই ভাবি না কেন, অথবা কৌতুকের ছলে যতই বলি না কেন বড়শির কলের মত সোজা মনের মানুষটি, তবুও এর মাঝে প্রেম, ভালবাসার পাশাপাশি দুঃখ ব্যাথাও উন্মুক্ত হোয়ে যায়। তবে সেই বাঁকা ক্ষতে কেবল শান্তি আর ভালবাসার প্রলেপ দিতে পারে এমন অনেক হারানো দিনের বাঁকা চাঁদের বাংলা গান যা আজও মনকে উতফুল্ল্য করে, ভালবাসায় ভাসায়, দুঃখ বেদনাকে ভোলায়- “নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে”।