বলাই বাহুল্য ক’দিন ধরে কথা, সংগীত, তাল, বেতাল, সুর, বেসুর নিয়ে আমদের পরিচিত সঙ্গীতজ্ঞ, বদ্ধাজন এবং ফেবু ন্ধুবরদের মধ্যে বেশ কলম চালাচালি দেখছিলাম। বিশেষ করে মিসেস তৃপ্তিকর, মিসেস সালমা যাকি, রুমি আজনবি, মিসেস সাদেকা বোরহান ফাঁকে ফাঁকে মিস্টার সারোয়ার, মিসেস লিজি আহম্মেদ, মিসেস নিগার সুলতানা, মিসেস মিনা হুদা, রীতা খান প্রমূখ সঙ্গীতের সুর আর বেসুরের উপর প্রানবন্ত আলোচনা ও মন্তব্যে জড়িয়ে ছিলেন। এখনো তার রেশ কাটেনি। আর সে কারনেই তার রেশ ধরেই বোধ করি একটু লেখার প্রয়াস খুঁজছিলাম। আর সেটা আরও উসকে উঠেছেছে বারিধারা ডি ও এইচ এস- এ নতুন করে সংগীত অনুরাগীদের নিয়ে একটা গানের দল তৈরী করা। যার একটা নাম ইতিমধ্যাই আমাদে পয়ার কবি ও ছড়াকার মিসেস শাপলা দিয়েই দিয়েছেন- “ ছন্দে-আনন্দে”। আমরা কোন বাক্য ব্যয় না করে এই ছন্দের তালে তালে এখনো স্বপ্নে ভাসছি এবং কখন এই গান আর ছন্দের দল সকলকে নিয়ে সপ্তাহে অথবা পাক্ষিকে অথবা মাসে অথবা ত্রইমাসে একত্রে বসে গানে আর কবিতার ছন্দে হারিয়ে যাব তা নিয়ে ঘোরের মধ্যে আছি কিছুক্ষনের জন্য হলেও জাগতিক যান্ত্রিক যাঁতা কলে পিষ্ট হওয়া যন্ত্রনার প্রাত্যহিক জীবকে ভুলে যেতে । যখন দুবে থাকবে ভিন্ন জগতে অনন্য ধ্যান আর এবাদতে নিজেকে খুঁজে নিতে- আমি কে, কোথায় আমার গন্তব্য, আমি কতটুকু পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে মানুষকে ভালবাসতে পেরেছি তার খন্ড কালিন অথচ গভীর অনুভূতির অনুরণন। কেননা সংগীত এবং এর সুরই দিতে পারে জীবনের একক গন্তব্যের ঠিকানা, দিতে পারে অজানা সীমানার ওপারে অপেক্ষায় জেগে থাকা সুখের আবাস অনুভুতি। আর এই সংগীতকে যে সাধক শ্রোতা কন্ঠে লালন করে সুর - বেসুর নিয়ে ডুবে থাকলেও তাল হারা না হয়ে আত্মহারা ছন্দে দুলে উঠে অথবা কোন সাধক গায়কের অসাধারণ কন্ঠের গানে হারিয়ে যেতে পারে সে-ই বুঝে জীবনের আসল মানে, সে-ই বুঝে কেন চোখের সংগীতজল তাকে এত আনন্দে ভাসায়। আসলে বেসুরও একটা সুর। যেমন আমি বলে থাকি দূর্ঘটনাও তো একটা ঘটনাই। কিন্তু এ ঘটনার গল্প হয়ত দুঃখ দিয়ে রচিত। তেমনি বেসুরও একটা সুর বৈ কি। এ সুরের মধ্যে মন শিরশির করে না উঠলেও, তাল আছে বলে মনে ঢেঊ তোলে। তাইত সকল কান্নার সুর এক না হলেও ভাষা কিন্তু একই। সে জগতের যে প্রান্তেই থাকি না কেন। তেমিনি সুরের ভাষাও শ্বাস্বত।
এ প্রসংগে আমি নিজেই এর ভুক্তভূগি। মনে পড়ে ভারত মহাসাগরের কোল ঘেঁষা মোজাম্বিকের পেম্বা সাগর বীচ জনপদে সন্ধ্যদকালিন সাগর সংগমে কোন একদিন বাংলার ঐতিহ্যবাহি ভাওয়াইয়া সংগিতের – “ কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যা কয়া যান রে “ গানে বন্ধুদের অনুরোধে কন্ঠ দেয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই স্থানীয় মোজাম্বিকানরা আমাকে গোল করে ঘিরে ফেলে প্রায় ৬০/৭০ জন। ইতি মধ্যে আমি মোজাম্বিক ভাষা বেশ রপ্ত করেছি। প্রত্যন্ত্য ওই জনপদে বাংলায় পল্লীর সুর মূর্ছনা যে কিভাবে আকৃষ্ট করেছিল তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি আবেগে স্তম্ভিত হোয়ে যাই। ওদের কাছে জিজ্ঞাস করলাম তমাদেরকে কি এমন ছিল এই গানে যা এত কাছে টানল তোমাদেরকে আমার কাছে এসে আমাকে ঘিরে গান শোনার জন্য। আমি তো বাংলায় গাইছি, তোমরা কি আমার গান, কথা এবং সে কথার মানে বুঝতে পারছ? তারা সকলেই এক সাথে বলল- না তারা কথার মানে হয়ত বুঝতে পারছে না। কিন্তু সুরের মধ্যে কি যেন প্রানের টান, আবেগ, আকর্ষণ অনুভব করছে তা তোমার ভাষাকে ছাপিয়ে কাছে আসতে বাধ্য করছে আর আবেগে ভেসে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে সান্ধ্যকালিন এ নীল ঘন সাগর জলের উচ্ছাস উচ্ছল বাতাস গায়ে মেখে। আমাকে তারা আরও গান গাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ফেলল। বলল- আমি যেন যে ক’টা দিন এখানে আছি সে ক’টা দিন এমন সুরে অনেক গান শুনিয়ে তৃপ্তি দিই। বিনিময়টা আমার উপর ন্যাস্ত হল।
সংগিতের সুর এবং বেসুর এতটাই শক্তিশালি যে এর সুরের আলো তারকালোকে অ পৌঁছে। কিছুদিন আগে তাই এক কবিতায় লিখছিলাম-
“তারার দেশেও ভেসে বন্ধু থাকবে ছোট্ট চাওয়া
তোমার সুর আলো হয়ে জড়ায় যেন দেহ,
সুখের বন্যায় বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখব তোমায়
আমিই শুধু জানব সে প্রেম জানবে না আর কেহ।“
তাই সংগীত নিয়ে মিসেস তৃপ্তি করের ছোট্ট দুটি লাইন এত নাড়া দিয়ে গেছে সকল সঙ্গীত পিপাসু এবং অনুরাগীদের মনে। সে লাইনটা হলঃ “সুর না লাগলে সে গান বেসুরা, অনেক শিল্পীই সেটা বুঝতে পারে না।“
প্রথম দিকে এর প্রতি উত্তরে সালমা জাকি লিখেছেনঃ “ রবীন্দ্র সংগীতে সুরে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভুল থাকে। এটা একমাত্র ভাল রবীন্দ্র শিল্পীরাই বোঝে। অন্য অংগের শিল্পীরা বুঝতে পারে না। রবিন্দ্র সংগিত অত্যন্ত সূক্ষ্ম সুরে গভির আবেগের গান”। এ ভা বেই অনেক যুক্তি তর্কের মধ্যে কথা এগিয়েছে। খুব ভাল লেগেছে হাসিও পেয়েছে মিসেস সাদেকা বরহানের কথা্যঃ “ অনেক কথা হয়েছে, এখন সবাই গিয়ে গলা সাধ আর গান practice কর।“।
“সবসময় গলা সাধাও যায় না, গানো গাওয়া যায় না। পরিবেশ এবং মানসিক প্রস্ততির দরকার” বলে মিসেস সালমা যে অভিমান এবং আত্ম অতৃপ্তির কথা অবলীলায় বলেছেন, সে যে আমাদের অনেকের মনের কথা। আর এর রেশ ধরেই আমাদের অনেকের মনে হয়েছে সুস্থ এবং সুন্দর পরিবেশ নিয়ে সংগীত চর্চা এবং উপভোগের একটা আসর বা প্লাটফর্ম দরকার। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এ “ছন্দে-আনন্দে” দলের বাস্তব রুপ নিয়ে কাজ করা।
আরু বলা বাহুল্য, আমরা যখন একটি কবিতা পড়ি তখন তাকে শুধুমাত্র কথার মালা বা ছন্দ হিসেবে দেখি না - কথার সাথে প্রেম, সুখ দুঃখ এবং ভাবের সম্বন্ধ বিচার করি।তবে সব কিছুর উর্ধে ভাব-ই মুখ্য লক্ষ্য। কবিতা নিয়ে কথা হল ভাবের আশ্রয়স্বরূপ। আমরা সঙ্গীতকেও এ ভাবেই দেখার প্রয়াস পাই। তাই সঙ্গীত কেবল ১০টি ঠাটের তান বিস্তার সহ সুরের রাগ রাগিণীই কেবল নয়, সঙ্গীত ভাবের রাগ রাগিণী। আসল কথা, কবিতা যেমন ভাবের ভাষা, সঙ্গীতও ঠিক তেমনি ভাবের ভাষা। তবে, কবিতা ও সঙ্গীতে প্রভেদ কি?
সংগীত এক ধরনের শ্রবণযোগ্য কলা ,যা সুসংবদ্ধ শব্দ ও নৈশব্দের সমন্বয়ে মানব চিত্তে বিনোদন সৃষ্টি করতে সক্ষম। স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে সঙ্গীতের সৃষ্টি। এই ধ্বনি হতে পারে মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রর শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সুর বা বেসুর সংগীত ধ্বনির প্রধান বাহন। সুর ছাড়াও অন্য যে অনুষঙ্গ সঙ্গীতের নিয়ামক তা হলো তাল। বেসুর হয়ে সংগীত ুতরিয়ে গেলেও আমার মনে হয় তাল হীন বা বেতালে সংগীতকে উতরান যায় না।
কিন্তু কোন কিছু বিশ্বাস করানো এক, আর উদ্রেক করানো হল একক এবং স্বতন্ত্র যা আর এক অনুভূতি। বিশ্বাসের শিকড় যদি থাকে দেহের মাথায়, তা হলে বলতেই হয় উদ্রেকের শিকড় থাকে হৃদয়ে। এই জন্য, বিশ্বাস করানোর জন্য যে ভাষা উদ্রেক ঘটানোর জন্য সে ভাষা েক নয় কখনও। যুক্তির ভাষা গদ্য যা আমাদের বিশ্বাস করায় আর কবিতার ভাষা পদ্য যা আমাদের হৃদয়ে উদ্রেক ঘতায়।যুক্তি যে-সকল সত্যকে বুঝাতে পারে না বলিয়া হাল ছেড়ে দেয়, কবিতা সে-সকল সত্যকে বুঝানোর জন্য ভার পরিসরকে বিস্তৃত।
আমাদের ভাবপ্রকাশের দুটি উপকরণ আছে- কথা ও সুর। কথা যতখানি ভাব প্রকাশ করে, সুরও প্রায় ততখানিই ভাব প্রকাশ করে। এমন-কি, সুরের উপরেই কথার ভাব নির্ভর করে। একই কথা নানা সুরে নানা অর্থ প্রকাশ করে। অতএব ভাবপ্রকাশের অঙ্গের মধ্যে কথা ও সুর উভয়কেই পাশাপাশি ধরা যেতে পারে। সেখানে সুর – বেসুর নিয়ে যাই থাকুক বা ঘটুক না কেন। ভাব সংগীতের মধ্যে আরাধনাই মূখ্য হোয়ে যায়। সংগীতকে অনেকে উপেক্ষা করে বসে থাকে ধর্মিয় অনুশাসনের আবেগ জড়িয়ে। কিন্তু এর গভিরতা কতটুকু বা এ আদৌ পরিহার্য্য কিনা তা এড়িয়ে চলে অথবা এড়িয়ে যেতে হয়। আমি এ প্রসংগ নিয়ে আর আগে বাড়তে চাই না। কেননা আমি মনে করি আমার বিবেক এবং আমার মন-ই হল সব চাইতে বর কাবাঘর, মন্দির অথবা মসজিদ। এ জায়গাটুকু পরিস্কার থাকলে সকল সাধনাই সুদ্ধ হয়। তাই সকলকে আহবান করব চলুন আমরা সকলেই যারা সংগোতকে ভালবাসি তার সুর-বেসুর, তাল-বেতাল, ভাব- অভাব, বিশ্বাস-অনুভূতি নিয়ে জীবনের মানে খুজতে একপত্রে বসে হারিয়ে যাই মহা সৃষ্টির সুরের বলয়ের মধ্যে জীবনের মানে খুজতে। আর সে আলো এবং ভালবাসা নিয়ে যথা শীঘ্রই জন্ম নিক আমাদের সংগীত এবং কবিতার ভদল ছন্দে-আনন্দে। সকলকে ধন্যবাদ।
প্রাথমিক যাত্রায় যাদের নাম পেলাম এ ছন্দে আনন্দে হারাতে গানে গানে আর কবিতায় তার সংখ্যা প্রায় ২৪ জনের মতঃ
রিতা আবেদ, নিগার ভাবি, বোরহান ভাবি, আয়েশা ফরিদ, মিনা হুদা, মন্টি ভাবী, শাপলা ভাবী, শের স্যার, তৃপ্তি বৌদি, সালমা জাকি, নজরুল ভাবী, নিগার ভাবী, রুমা ভাবী, লিজি আহম্মেদ, ওবায়েদ স্যার, শাহীন ভাই, পলক,
বজলু স্যার, জিতু, সামিনা, লতা ভাবী, বোরহান স্যার, রেখা ভাবী, সিফাতে রাব্বানী প্রমূখ।