রবীন্দ্রনাথকে বিশ্লেষণ করা সত্যিই এক অসাধ্য ব্যাপার। তাঁর জীবন এবং সৃষ্টি নিয়ে ভাবনায় ভেসে যেতেও কূল হারা হতে হয় মাঝে মাঝে। অথচ ভাবনার পাখা এত বিস্তত এত প্রসারিত, যে পাখায় বাতাসে  ভর করে অসীম শুন্যে মেঘের পর মেঘ পাড়ি দেয়া কোন ব্যাপারই না। সেখানেও যেন কবি গুরুকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে, উড়তে উড়তে, ঘুরতে ঘুরতে চোখে ক্লান্তির তন্দ্রায় এক সময় নেমে আসতে হয় ধরায়। তবুও শেষ হয় না এই কালজয়ী মানুষটাকে নিয়ে কোন কল্পনা অথবা বাস্তব রাজ্যের রাজত্ব।

তাইত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শুধু এই বলতে ইচ্ছে হয় যে তিনি বাংগালী বিশ্কবি হয়ে না জন্মালে বোধ হয় আজ আমাদেরও বাংগালী হয়ে জন্ম নেয়ার এই যে অহংকার, গর্ব আর সম্মান তা বুঝি আর কোনদিনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াত না।
হয়ত বলা হবে কেন বংগবন্ধু বাংগালী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কি আমাদেরকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেননি। অবশ্যই করেছেন। কিন্তু আমাদের বংগবন্ধুও যে সেই প্রেরণা, শক্তি, জিদ, সাহস, প্রতিজ্ঞা আর শেকল ভাংগার মন্ত্র পেয়েছিলেন এই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ থেকেই। আর নজরুল তো ছিলেন সব সময়ই মুক্তির দিশারী। যা প্রভাবিত করেছে, করছে এবং আগামীতেও করবে আমাদের বাংগালী জীবনের অধিকার আদায়ের প্রতিটি  ক্ষেত্রেই।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ অনুক্ষন প্রভাব বিস্তার করে ছিলেন বলেই বংগবন্ধু যেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২ , পুরানো বিমান বন্দর তেজ্গাঁতে  অবতারণ করলেন সেদিন তাঁর চোখে আনন্দ অশ্রুর বন্যা ছিল। সকল অবিসংবাদিত নেতা, সম্মানিত মুক্তি যোদ্ধা ও বাংলার আপামর জনগনের সামনে শোভিত মুক্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর চোখে ঝরতে থাকে আনন্দ অশ্রু। নয় মাস বাংলা দেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর পাকিস্তানের কারাগারে সেই নয় মাস তার নিজের সাথে আর মৃত্যু ভয়ের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রেখে  যে কালজয়ী বাংগালী মানুষ্টির কথা প্রথমেই স্মরণ করেছিলেন বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনি আর কেউ নয়,  তিনি হলেন আমাদের অহংকারে আর এক বাংগালী বিশ্ব কবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  বংগবন্ধু বলেছিলেনঃ “হে কবি গুরু তুমি ঠিক নও। তুমি এসে আজ দেখে যাও আমরা স্বাধীন! আমি আমরা হার মানবো না আমরা হার মানতে জানি না। তুমি বলেছিলেঃ

"সাত কোটি বাঙ্গালির হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নাই"।

তিনি আরও বললেনঃ কবিগুরু, আজ মিথ্যা কথা প্রমান হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।“

এ ছিল শেখ মুজিবের একেবারেই অভিমানের কথা, জিদের কথা, এ থেকে সঞ্চয় করা শক্তি আর সাহসের কথা। কেননা রবি  ঠাকুরেরও তো এ ছিল এক চরম অভিমানের কথা তাঁর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতয়। নইলে এ কথা যে তাঁর নিজেকেই বলা হচ্ছিল বা হচ্ছে তা কি তিনি জানতেন না! কারন তিনিও যে মনে প্রানে সেই বাংগালীদেরই একজন। কবিগুরুর মনেও এ অভিমান জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল বলে সংগ্রাম করেছেন কলমের অস্ত্র হাতে। আর শেখ মুজিব সেখান থেকে শক্তি সাহস অভিমান  জিদ আর অনুপ্রেরণা নিয়ে করেছেন সশস্ত্র সংগ্রাম। তিনি সেই সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। পক্ষান্তরে তাঁকে অস্ত্র তুলে এই সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য যে ব্যক্তিটি তাঁর মনে বসে থাকতেন সে হল রবীন্দ্রনাথ, আমাদের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কিন্তু আজ যদি সেদিনের সেই স্বাধীনতার ডাক, পরবর্তীতে স্বশস্ত্র সংগ্রামে রুপ নিয়ে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন না হত তাহলে বাংগালীর ইতিহাস আর অস্তিত্বের কি হত?  কি হত যারা মারা গিয়েছিল সেই ৩০ লক্ষ বাংগালী মা ভাইবোনেদের? তাঁদের আত্মা আজও অভিসম্পাদ দিত শুধু শেখ মুজিবুরকে নয় সকল বাংগালী জাতীকে। আর বলত কবি গুরু এত বলার পরও কেউ বিশ্বাস করেনি যে আমরা বাংগালীরা আসলেই মানুষ নয়। সাথে বংগবন্ধুও হয়ত কাঁদতেন। আজ কেঁদেছেন আনন্দে, সেদিন ফাঁশির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাঁদতেন মনে গভীর কষ্ট আর দুঃখ নিয়ে । ক্ষুদিরামের মত কোন অহংকার বা গর্বও থাকত না হয়ত সেদিন!
যদি বংগবন্ধু সশ্বস্ত্র সংগ্রামে সত্যিই পরাজিত হতেন তাহলে তিনি এ ভাবে না বলে (তা বলার সুজোগ পেতেন কি না!) চোখের জল ঝরাতে ঝরাতে বলতেন কবিগুরু তুমি ঠিকই বলেছিলেঃ "সাত কোটি বাঙ্গালির হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নাই"


শেখ মুজিবুর রহমান এর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। মুনতাসীর মামুন এর “বঙ্বন্ধু কোষ” এর পাতায় পাতায় চোখ রাখলে প্রতিমুহুর্তে শিহরিত হতে হয় যে বংগবন্ধু কত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, ‘সুপ্রভাত’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’, ‘দুই বিঘা জমি’ প্রভৃতি কবিতা যেমন আবৃত্তি করতেন, তেমনি গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথের গানও গাইতেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এমন কি আমাদের বংগমাতাও বংগবন্ধুর কারাবাস কালীন সঞ্চয়িতাসহ রবীন্দ্র রচনাবলী, নজরুল, শরত ইত্যাদি সাথে দিয়ে দিতেন। এ ছাড়াও রবীন্দ্র রচনাবলীর বিভিন্ন বই কিনেও কারাগারে পাঠাতেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি কত অগাধ ভক্তি ও স্রদ্ধা থাকলে ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করলে শিল্পী ও প্রগতিবাদী মানুষের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু একাত্ম হন। তিনি বলেনঃ আমরা এই ব্যবস্থা মানি না—আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হবেই।’ ১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, “Tagore had reflected the hopes and aspiration of the millions of Bengalies through his works. Without him…the Bengali Language was incomplete” রবীন্দ্রসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে সমধিক গুরুত্ব আরোপ করে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে আহ্বান জানান। রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কারণেই বারবার রবীন্দ্রবাণী উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে, তাঁর চেতনার গভীরতম প্রদেশে অধিষ্ঠিত ছিল রবীন্দ্রনাথ ।


এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সে কারণেই সেদিন এই অবিসংবিদিত নেতার মনে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের মাটিতে পা রেখে যে  কবির কথা   তাঁর স্মরণে এসেছিল তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ। তা না হলে এত বিশ্ব বরেন্য নেতা, নেতৃ, কবি, লেখক, মাশায়েখ, আলেম ওলামায়ে একরাম,  পন্ডিত, বৈজ্ঞানিক, গবেষক, শাষক থাকতে কবি গুরুর নাম কেন নিতে হয়েছিল তাঁকে? সুতরাং এই হল বংগবন্ধু তথা বাংগালী জীবনে রবীন্দ্রনাথের আলো, আকর্ষণ এবং সর্বপরি তাঁর দর্শনের প্রভাব। শেখ মুজিব আরও বললেনঃ আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। রবীন্দ্রনাথের দ্বারা তিনি প্রভাবিত ছিলেন বলেই তো এই বাংলাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী সংগীত তিনি মুখে যেমন আওড়িয়েছেন তেমনি “ আমার সোনার বাংলা আমি  তোমায় ভালোবাসি” গানকে তিনি জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহন করতে এতোটুকু দ্বিধা করেন নি।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে বিমানে বসে বঙ্গবন্ধু বাষ্পরুদ্ধস্বরে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাইতে থাকেন এবং সহযাত্রী ভারতীয় কূটনীতিজ্ঞ শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীকে তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে বলেন। এ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত হবে বলে বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন। তা না হলে তিনি তো নিজেও একটা সংগীত লিখে বলতে পারতেন এই আমার সৃষ্টি জাতীয় সংগীত। দেশ যখন স্বাধীন করেছি মানে সৃষ্টি করেছি তখন তার জাতীয় সংগীতটাও নিজে তৈরি করে দিয়ে গেলাম। এখন থেকে এটাই হোক প্রতিষ্ঠিত। তাহলে সেদিন কি কেউ ছিল তাঁকে কিছু বলবে বা সংবিধান কি পরিবর্তন হত ! কিন্তু তা হয় নি।  কেননা শেখ মুজিব নিজেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন প্রতিটি মুহুর্তে। আর সেটাই তাঁকে আর এক শ্রেষ্ঠ বাংগালী তথা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংগালী হিসেবে বিশ্বের দরবারে সম্মানিত করেছে। আর শ্রেষ্ঠ হতে গেলে শ্রেষ্ঠর সাথেই থাকতে হয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগীতা। তা না হলে শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না।  

১০ মে, ২০২০।