ও ভাবে চোখের জল ফেলতে নেই। কি হবে দৃষ্টি আঁধার করা মাতন আহাজারিতে? আমি তো জানি , একদিন দূর আকাশে তারা হয়ে গেলেও ধরায় তখনও আগের মতই বসন্তে ফাগুন হাওয়া বইবে, আষাঢ়ে কদম ফুল ফুটা বৃষ্টি ঝরবে, নদী শুকে মরলেও পাড়ে কাশ ফুলের হাওয়ায় দুলবে শরতের মেঘ, শীতের পাতা ঝরা হাওয়ায় গাছের শাখে মর্মর আলাপনে ঝরবে বনানীর বুড়ো পাতারা।
বুড়ো হলে সকলকেই ঝরে পড়তে হয়, ভেংগে পড়তে হয়, অবয়বহীন কিছু চিহ্ন রেখে গেলেও মাটির সাথে মাটি হয়ে কথা বলতে হয়। আমি তো জানি, আজ বারোয়ারীর আঙ্গিনা ঘিরে আলোক শয্যায় যে উতসব আয়োজন চলছে, ২১শে ফেব্রুয়ারী গ্রন্থ মেলায় বাংলা একাডেমির মঞ্চে যে কবিতা পাঠের আসর জমেছে অথবা পাড়ায় ঐকতানের মঞ্চে যে গানের আসর তা সেদিনও সমস্ত ফাল্গুনকে ঘিরে কত নতুন গান আর কবিতার শব্দে থাকবে মুখোরিত।
আমি তো জানি, হাজারও গান আর কবিতার ভিড়ে আমার গান আর কবিতারা হয়ত থাকবে সুর আর ভাষার মর্গে, কেউ খুঁজবে না তাকে, এও জানি খুঁজবে না আমাকেও। এমন কি তুমিও ভুলে যাবে- কোন এক ফাগুনে তোমাকে নিয়ে হেঁটেছিলাম সাগর বেলায়, গেয়েছিলাম সাগর উতল করা জলধি গান, আবৃত্তিতে ভাসিয়েছিলাম চাঁদের ক্ষন সাগর সংগমী জ্যাস্নায় হারিয়ে যেতে। হারিয়ে যাব জেনেও কবিরা তবুও শব্দ খুঁজে, ছবি খুঁজে, সম্পর্ক খুঁজে, মানুষ খুঁজে, প্রকৃতি খুঁজে। খুঁজে বেড়ানোই যেন কবির ধ্যান।
যে সড়ক ধরে প্রতিদিন ছুটে যাই সে সড়কেও থাকবে সেদিন আধুনিক যান জটের কোলাহল, খড়ের গোল ঘর, আধাপাকা বাড়ি ভেংগে দিয়ে উঠবে হাসপাতাল, স্কুল কলেজ আর থিয়েটার মঞ্চ। আমি তো জানি আম, জাম, শিমুল, জারুল, নিম, কৃষ্ণচূড়ার গাছ কেটে লাগানো হবে ইউক্যলিপটাস, ক্রিসমাস আর উইপিং পাইন গাছের সারি। ধনিয়া, লাল শাক, কলমি শাক অথবা লাউ, ছিম, কুমড়া, করলা, শশা, বরবটির ঝাংলার স্বব্জি স্বপ্নকে উপেক্ষা করে বোগেন ভেলিয়া, প্রোমিলা অর্কিড, মানি প্ল্যান্ট, চাইনা গ্রাসে ভরবে আংগিনা।
আমি তো জানি আমার জন্য আজ এই যে এত দুঃশ্চিন্তার রেখাপাত, কান্নার রোল, আহাজারির মাতন, সব কিছুই একদিন স্মৃতির অতলে তলিয়া যাবে। আমি তখন তোমার কাছে, নামহীন তুমি থেকে ও, ও থেকে সে, সে থেকে সন্তানের বাবা, বাব থেকে দাদু অথবা নানু, দাদু নানু থেকে কোন একদিন তার পর বিস্মৃতির গহ্বরে উঁকি দেয়া একজন মনে পড়ে, পড়ে না, তার পর আর নেই। আমি আছে থেকে ছিলাম, ছিলাম থেকে নেই হয়ে যাব। আমি তো জানি। তাই কি হবে দু’চোখে জল ফেলে। বরং যতক্ষন বেঁচে থাকা ততক্ষনই হোক আনন্দ আড্ডা।