১৯৮৮ সাল। আমরা তখন মুন্সীগঞ্জে থাকি। আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্র। বছরখানেক হলো আমি ছড়া-কবিতা লেখার চেষ্টা করছি নিয়মিত। এবং কিছু একটা লেখা হলেই অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে তা প্রকাশ করার জন্য শিশু পত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেই। কখনও ছাপায় না বলে এক সময় উৎসাহেও ভাটা পড়ে। কিন্তু এমনই সময় একদিন আমার বন্ধু খালেদ শিশু পত্রিকার এক কপি হাতে নিয়ে স্কুলে হাজির। সেখানে আমার "কাঠবিড়ালী" নামের এক ছড়াকবিতা প্রকাশিত হয়েছে। (শিশু পত্রিকার একই সংখ্যায় বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, স্বৈরশাসক এরশাদেরও একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো। কবিতার প্রথম লাইনটি আমার মনে আছে, "কঁচি কলাপাতার মতো সবুজ এই শিশুদের মন"।) পুরো ক্লাসে তো হুলস্থুল পড়ে গেলো এই পত্রিকা নিয়ে! সবাই কবিতা পড়ে প্রসংশায় পঞ্চমুখ যে তাদের ক্লাসে একজন বিশিষ্ট কবি আছে। প্রতি পিরিয়ডে ক্লাসে টিচার এলেই তাকে দেখানো হলো পত্রিকাটি। কবিতা নিয়ে টিচারদেরও উৎসাহের কমতি নেই। কোন কোন টিচার আমার কবিতা লেখার ইতিহাস সম্পর্কে পুরো ইন্টারভিউ নিয়ে ফেললেন। অনেক টিচার জানতে চাইলেন আর কে কে কবিতা লিখে। দেখা গেলো ক্লাসে আরও অনেক সুপ্ত প্রতিভাবান কবি লুকিয়ে ছিলো এতোদিন। প্রত্যেককেই দাঁড়িয়ে স্বরচিত কবিতা পড়ে শুনাতে হলো ক্লাসে। আমাদের খালেদ শুধু কবিতাই না, ছবি আঁকাআঁকিতেও বিশেষ খ্যাতিমান ছিলো সেই সুদূর প্রাইমারী স্কুলের সময় থেকেই। তার হাতে আঁকা থান্ডার ক্যাটস-এর স্কেচের ফটোকপি ৫ টাকা দামে বিক্রি হতো একসময় ফটোকপির দোকানে। তো তাকেও কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতে হলো ক্লাসে। এরপর থেকে আমাদের ক্লাসে এবং এলাকার অন্যান্য বন্ধুদের মাঝে কবিতা লেখার এক জোয়ার এসে গেলো। যারা আগে কখনও কবিতা লেখেনি, তাদের অনেকেও জোর প্রচেষ্টায় কবিতা লেখায় মনযোগ দিলো। অনেকেই তার নতুন লেখাটি যাঁচাই করার জন্য আমাকে এনে দেখাতো। শত হলেও আমি তখন বিশিষ্ট পরিচিত এক কবি সবার মাঝে!

তো এভাবেই বছর শেষে নতুন ক্লাসে উঠলাম। ১৯৮৯ সালের শুরু, শীতের শেষ দিক। আমাদের কোয়ার্টারে এক বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। খেলার শেষে যেমন খুশি তেমন সাজো, তারপর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এর আগে আমি কখনও স্কুলের বা অন্য কোথাও কোন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেইনি। তারপরও বিভিন্ন খেলায় অন্যান্যদের পাশাপাশি দেখা গেলো আমার কপালেও কিছু পুরস্কার জুটেছে। যেমন খুশি তেমন সাজো-তে কোয়ার্টারের রানা ভাই সেজেছিলেন গ্রামের মোড়ল, আর সৈকত ছিলো তার সাথে ছাতা হাতে মোড়লের চামচা। দু'জনই কচুরীপানার কালো শিকড় কেটে সুপার গ্লু দিয়ে মুখে দাড়ি-গোঁফ হিসাবে লাগিয়েছিলো। অনুষ্ঠান শেষে সেই দাড়ি-গোঁফ তুলতে গিয়ে সৈকতের সে কি কান্না! তার ধারণা এগুলো এমন স্থায়ীভাবে লেগে গেছে যে আজীবন এখন তাকে এসব দাড়ি-গোঁফ মুখেই চলতে হবে!

খেলার মাঠের একপাশে লোক দিয়ে প্যান্ডেল ও মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিলো। সন্ধ্যায় সেখানে জমে উঠে গান, কৌতুক, মুকাভিনয় ইত্যাদির সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের পরিচালনা ও উপস্থাপনায় ছিলেন এ এস পি আংকেল, রানা ভাইয়ের বাবা। তিনি এক পর্যায়ে আমাকে এসে বলে গেলেন তৈরি থাকতে, আমাকে স্টেজে গিয়ে কবিতা পড়ে শুনাতে হবে। শুনে আমি তো ভয়ে কাঠ! নানাভাবে চেষ্টা করলাম আমার পরিবর্তে অন্য কাউকে কবিতার জন্যে বাছাই করতে। রানা ভাইও ভাল কবিতা লিখেন। কিন্তু খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে একটা কথা আছে। শত হলেও আমার কবিতাই পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। তাই আমাকেই যেতে হলো স্টেজে। নাম ডাকার পর টলোমলো পায়ে স্টেজে গিয়ে উঠলাম। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম "দাদুর চিন্তা" নামের কবিতাটি আবৃত্তি করবো। কিন্তু স্টেজে উঠে মাথায় সব এলোমেলো হয়ে গেলো। নিজের পরিচয় দিয়ে দাদুর চিন্তার পরিবর্তে কাঠবিড়ালী কবিতাটি বলে চলে এলাম। অনেক বছর পরও সেই কবিতা এখনও আগের মতোই মুখস্ত আছে। সবার জন্য তা এখানে দিলাম।

কাঠবিড়ালী

কাঠবিড়ালীর নাচন দেখে
খোকন ছুটে যায়,
রাতের বেলায় আকাশ হাসে
ফুটফুটে জোৎস্নায়।
দিনের বেলা ফুলের গন্ধে
উঠানটি যায় ভরে,
মৌমাছিরা মধু লোটে
মুখে মুখে করে।