একজন কবিকে কি মোটাদাগে অভিজ্ঞতাবাদী বলা যায়? সম্ভবত কবি মাত্রই কোন সুনির্দিষ্ট আইডেন্টিটির চোরাগর্তে পড়তে চাইবেন না। তার পরিচয় তিনি কবি, কেবলই কবি। এটাই আদিতে ছিল আর এটাই তাকে অন্তে নিয়ে যাবে। আর মাঝখানের সময়টাতে তিনি শুধু শব্দারণ্যে বিচরণ করে ছেঁকে ছেঁকে নিজ শৈলি অনুসারে কবিতা লিখে যাবেন। কবির পারঙ্গমতার প্রশ্নের উত্তর এখানেই সারা।
আর সব সাধারণ মানুষের মতো কবিকেও যেতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আশেপাশের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার ভেতরে। পাশাপাশি চলে কাব্যের বিনির্মাণ। অভিজ্ঞতা কি তাকে তৈরি করে নেয় কবিতায় নিজস্ব ভাবনা রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে নাকি অভিজ্ঞতার জগতটি নির্মিত হয় কবির নিজস্ব চিন্তা অনুসারে? প্রথমটিই ঘটে সাধারণত। দ্বিতীয়টি বিরল এবং যদি কারও ক্ষেত্রে ঘটে যায়, তবে তার জীবনই হয়ে ওঠে শিল্প আর তাতে যতো দরজা তার সবগুলোই থাকে অবারিত। সম্ভাবনার বীজ উপ্ত অবস্থায় রেখে যখন একটি কবিতার প্রথম লাইনটি লিখিত হয়, তখন আসন্ন নির্মাণের স্থায়ীত্ব নিয়ে কবির মানসলোকে যে ঘনঘটা চলে, তা যদি সাকার অবস্থায় উঠে আসত, তবে প্রলয়কান্ডের প্রথম দৃশ্যটা রচিত হয়ে যেত সাম্প্রতিক ধরাধামেই।
মানুষ কতোটা পথ হাঁটে? কবি কি তার থেকে কম কিংবা অধিক? অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে কবি যে নিরন্তর দেখে যান একের পর এক ঘটনা, দুর্ঘটনা, সাময়িক অভিজ্ঞতা এক সময়ে হয়ে ওঠে অপরিহার্য এক কাব্যশরীর, তাতে মূল ঘটনার প্রাবল্যে কি কবিতার আনন্দ হারিয়ে যেতে পারে? অভিজ্ঞতাই যদি বাস্তবতা হিসেবে পরিগণিত হয় এবং কবিতা যদি ক্রমেই হয়ে ওঠে মিস্টিক, পলায়নপর, তবে এই অভিজ্ঞতা নামক কালপ্রিট থেকে কবি কীভাবে সন্তপর্ণে বাঁচিয়ে রাখেন নিজেকে?
জার্মান কবি মারিয়া রিলকে বলেছিলেন, ' শুধু আবেগ নয়, কবিতা আমাদের অভিজ্ঞতা। একটি কবিতা লেখার জন্য তোমাকে দেখতে হবে অনেক শহর, মানুষ আর বস্তু, জানতে হবে কোন ইশারায় ফোটে ভোরের ফুল ; অপরিচিত স্থান সব, অচেনা পথ, অপ্রত্যাশিত বিরোধ আর বিদায়ের মুহূর্তগুলি --তুমি জানো একদিন বিদায় জানাতে হবে তাদের। '
ভোরের ফুল ফোটা তো প্রতিদিন কতো মানুষই দেখে। তবে এই যে ফুল ফোটার ইশারাটুকু, তা দেখতে পান একজন কবি। তার সংবেদনশীল মন এই ঘটনাকে শুধু উপযোগহীন ইভেন্ট হিসেবেই দেখে না, সে একে উতরে নিয়ে যেতে চায় নিপাট সাদামাটা বসন থেকে কারুর কাছে।
সশরীরে উপস্থিত না থেকে কি কোন বস্তু, স্থান বা ঘটনাকে উপলব্ধি করা যায়? কবি এই কাজটি সফলতার সাথেই করে থাকেন। তার দিব্যদৃষ্টি যে সবদিকে খোলা।
জীবনানন্দে দেখি :
“রক্তে রক্তে ভরে আছে মানুষের মন
রোম নষ্ট হয়ে গেছে...গেছে ব্যবিলন পৃথিবীর সব গল্প কীটের মতন
একদিন ভেঙ্গে যাবেঃ হয়ে যাবে ধূলো আর ছাই '( রূপসী বাঙলা)।
আমরা জানি জীবনানন্দ রোম কিংবা ব্যবিলন থেকে ঢের দূরে এক তমসাচ্ছন্ন মন নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন পৃথিবীর পথে পথে। লিখে গেছেন কিংখাপের রূপধারী এক একটি কবিতা।
জীবনানন্দের 'মহাপৃথিবী ' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এক স্থির অবস্থান নিয়ে কোমল গতিময়তা নিয়ে কবি প্রত্যক্ষ করছেন পৃথিবীর অলিগলি।
' এইসব জানো নাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডাজান উল্লাসে;
রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডানা শাদা ফেনা- শিশুদের পাশে
হেলিওট্রোপের মতো দুপুরের অসীম আকাশ!
ঝিকমিক করে রৌদ্রের বরফের মতো শাদা ডানা,
যদিও এ-পৃথিবীর স্বপ্ন ছিন্তা সব তার অচেনা অজানা। ' (সিন্ধুসারস)
কিংবা --
' সূর্যের আলো মেটায় খোরাক কার:
সেই কথা বোঝা ভার।
অনাদি যুগের অ্যামিবার থেকে আজিকে ওদের প্রাণ
গড়িয়া উঠিল কাফ্রির মতো সূর্যসাগরতীরে
কালো চামড়ার রহস্যময় ঠাসবুনুনিটি ঘিরে।
চারি দিকে স্থির-ধুম্র-নিবিড় পিরামিড যদি থাকে-
অনাদি যুগের অ্যামিবার থেকে আজিকে মানবপ্রাণ
সূর্যতাড়সে ভ্রণকে যদিও করে ঢের ফলবান-
তবুও আমরা জননী বলিব কাকে?
গড়িয়া উঠিল মানবের দল সূর্যসাগরতীরে?
কালো আত্মার রহস্যময় ভুলের বুনুনি ঘিরে। ' ( সূর্যসাগরতীরে)
এই রকম অনেক কবিতাই পাওয়া যাবে যেখানে আমরা দেখতে পাই এক নির্মোহ পরিব্রাজকের মতো ধীর অথচ বিষাদের চিরন্তন মালা গেঁথে গেঁথে কবি পার হচ্ছেন মহাদেশ থেকে মহাদেশ। সমুদ্রতীর, আকাশ, সবচেয়ে গাঢ়তম অন্ধকারের বর্ণচ্ছটা কবিকে ক্রমিক সৃষ্টিশীলতার দিকে নিয়ে গেছ।
সচেতন কিংবা অবচেতনভাবেই কবিতায় এসে পড়ে নানা ঘটনার ঘনঘটা। ফলে, ঘরকুনো স্বভাবের কবিটিও অনায়াসে লিখে যান আলো মাটি আকাশের এই পৃথিবীর বৃত্তান্ত, কেননা কবিতা তাকে তৃতীয় একটি চোখ দিয়েছে, যেখানে ভ্রমণপিপাসা মৃত্যুপূর্ব মুহূর্তেও অবিচল।
অতিদৃষ্টির ঠাসবুননে জায়গাগুলো একদম কাছে চলে আসে, যেন চোখের সামনেই সমস্তটা। যেন চাইলেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে, দেখা যাবে পরখ করে।
পুরো বস্তুজগতের এই কাছে চলে আসা, পারতপক্ষে কোন ঘটনা বাস্তবে অবলোকন করা কিংবা না করা, এই সবকিছুই কবির দৃষ্টির প্রাবল্যের কাছে এসে মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
পঙক্তির অন্তর্নিহিত রস এবং তা পাঠে আনন্দই হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতার আড়ালে আবডালে গড়ে ওঠা দৃশ্যচেতনার চূড়ান্ত ফলাফল।
কবির ওয়েভ ফাংশন যে কোন সময় যে কোন স্থানে ভ্রমণের জন্য বদলে যেতে পারে। দৈহিক এবং মানসিক অবস্থান দুই প্রান্তে রেখে এবং মাঝখানের পথটা পুরোটা কবিতার জন্য ছেড়ে দিয়ে চলে এক অন্যলোকের উৎসব।