মানুষের চিন্তার সাথে বাহ্যিক জগতের প্রতিনিয়ত যে কন্ট্রাডিকশন, তা দ্বারা প্রতি মুহূর্তে মানুষ স্বপ্নভঙ্গের বেদনা পেলেও এই বৈপরিত্য না থাকলেই সেটা বেশি গোলমালে ঠেকত। যা ভাবি, আশেপাশের মানুষ এবং পরিপার্শ্বকে যে রূপে কল্পনা করি, বাস্তবের সাথে মিনিমাম ডিসট্যান্স আছে বলেই কল্পনা এত সুন্দর। আবার এই কল্পনা কখনো বাস্তব হয়ে চোখের সামনে হাজির হবে না, এই চিন্তাও মানুষের চিরকালীন সামর্থ্যের ব্যাপারে তাকে সংশয়ী করে তোলে। এইজন্য মানুষ কল্পনায় পুরোপুরি একীভূত কিংবা একেবারে কল্পনাবিচ্যুত, কোনটাই হতে পারে না। সম্ভ্যব্যতার একশো আশি ডিগ্রী এঙ্গেলে দাঁড়ানো দুই সম্ভাবনার দিকে তাকিয়েই মানুষ সেই কবে থেকে হাঁটছে শুধু মাঝখানে।
এই মাঝখানে দাঁড়িয়েই মানুষের শিল্পচিন্তা, যাবতীয় অভিজ্ঞতা। মানুষের সকল প্রকাশভাবনা যা থেকে তাড়িত হয়ে একের পর এক সে রচনা করেছে শিল্প, তা তার প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতারই ফল। অভিজ্ঞতা শুরুর আগে যে চিন্তা, সেই চিন্তা এবং অভিজ্ঞতার পরের চিন্তার মাঝে ব্যবধান অবশ্যম্ভাবী। চিন্তার সাথে অভিজ্ঞতা মিশে যেমন শব্দকে বিস্তৃত অর্থের দিকে নিয়ে যায়, তেমনি অভিজ্ঞতা জিনিসটা চিন্তার নিখাদ জগতে অনেকটাই খাদ ঢুকিয়ে দেয়।
পাবলো নেরুদা যেমন বলেন, 'And I wrote the first faint line. Faint, without substance, pure .Pure wisdom of someone who knows nothing. '
যে কিছুই জানে না, ভাষাগত প্রপঞ্চ থেকে সে মুক্ত। তাই তার শব্দাবলি হতে পারে একদম মূল থেকে উৎসারিত।
অভিজ্ঞতার ব্যাপারটা একই সাথে অনতিক্রম্য। ভাষাগত অভিজ্ঞতা তো আছেই। চলতে ফিরতে প্রতিদিন কতো না অভিজ্ঞতাই তো হয়। কতক মনে থাকে, আর কতক থাকে না। সেইটেই বেশি দাগ কাটে যেটা আমাদের ভাবনার জগতকে নাড়া দেয়, মনের সংবেদনশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
কবিতার ক্ষেত্রে কোন অভিজ্ঞতাই ফেলনা নয়। যেহেতু আগে থেকে আমি কোন ঘটনা সম্পর্কে অবগত নই, তাই অভিজ্ঞতা অনিবার্য। জীবনকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করতে সাহায্য করে এই ঘটনাগুলো। অবধারিতভাবেই তার রেশ কবিতায় এসে পড়ে।
হয়তো উৎকৃষ্ট ভাষা, চমক লাগানো আঙ্গিক, নিজস্ব শৈলী এসব দিয়ে কবি তার কবিতাকে এক মৌলিক উচ্চতায় নিয়ে যান। তবে অভিজ্ঞতা তার কবিতার মালমশলা হিসেবে থেকে যায়, গোচরে কিংবা অগোচরে।
হয়তো রাস্তায় হাঁটছি, বাজারে ঘুরছি কিংবা বাসে প্রচন্ড গরমে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় দেখা গেল নতুন কোন কবিতার আইডিয়া এসেছে। নতুন দু একটা লাইন উঁকি দিচ্ছে। পরপর কয়েকটা লাইন মাথায় চলে এসেছে। এমন সময় হাতের কাছে লেখার জন্য কাগজ কিংবা পারতপক্ষে মোবাইলের নোট না থাকলে সব কবিই একটা দিশেহারা অবস্থার ভেতর দিয়ে যান। এই অভিজ্ঞতা সম্ভবত সব কবিরই আছে।
সময়, যা ক্রমাগত বয়ে চলে নানামুখী ব্যঞ্জনের মধ্য দিয়ে, সেই সময় এবং সেই সময়ের চিন্তাকে ধরে রাখার বাসনা কবিমনের ঊষালগ্ন থেকে।
আনন্দ আর সৌন্দর্যকে কাছ থেকে দেখা, তার রস উদঘাটন করা, এইরূপ ঘোরগ্রস্ত ব্যস্ততায় কবির দিনাতিপাত। অভিজ্ঞতা আর চেতনাও তার বাইরের কিছু নয়। জীবনের নিরীখেই তার গতিপথ বহুধা বিভক্ত।
গুরুদেবের 'আমি ' কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন দিয়েই শেষ করি :-
' আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম "সুন্দর',
সুন্দর হল সে।'