সাহিত্য, সঙ্গীত বা চিত্রকলা যার কথাই বলি না কেন, নির্দিষ্টতার ধারণা উপভোগকারীর নিকট এখন অন্য রকম। স্পেসিফিক কোন জিনিস বা অনুষঙ্গের প্রতি সরাসরি ফোকাসের যে প্রবণতা তা থেকেও বোধকরি সচেতন শিল্পীমাত্রই একটা মিনিমাম ডিসট্যান্স বজায় রেখে চলেন। শানেনুযুল সহকারে একটা প্ল্যাটফর্ম একজন শিল্পী তার লেখা দ্বারা দর্শক বা পাঠকের মনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এখন অপেক্ষা শুধু সেই প্ল্যাটফর্মে একটা অসাধারণ ক্ল্যাইম্যাক্সের। শুধু কথাসাহিত্যই নয়, কবিতার ক্ষেত্রে বরং এ কথা আরও বেশি খাটে। কারণ সুনির্দিষ্ট মুহুর্ত সৌন্দর্যের যে ধারণা এতকালের কবিদের মনে বদ্ধমূল ছিল, তা ক্রমান্বয়ে বদলে যেতে থাকে সচেতন কবিদেরই কাব্য উদ্যোগে। সেখানে হয়তো নিরীক্ষা প্রবণতাও দেখা যাবে। তবে গল্প, উপন্যাস, মুভি কিংবা গানের জগতে এখনো খেয়াল করলে দেখা যাবে তার অন্তঃস্থ এবং বহিঃস্থ সকল প্রচারণা বা আবেদনই আমাদের নিয়ে যেতে চায় কেবল একটি দৃশ্যকল্পে যা সম্পর্কে আমরা পূর্বেই অবহিত হয়ে যাই। ব্যতিক্রম হিসেবে হয়তো আমরা অনুমাননির্ভর শিল্পধারণা লালন করি। তবে শেষমেষ আমরা মেসেজটি অবিকৃতই পেয়ে যাই। এখানে আমার চোখকে অবাক করে দিয়ে পারস্পারিক আপাত সম্পর্কবিহীন সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্যপট তৈরি হতে দেখি না। বোধগম্যতার দোহাই দিয়ে না হয় শিল্পকে গুরুর দুয়ার থেকে চন্ডালের উঠোন পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। তারপর? চন্ডাল যদি তার সেই বোধগম্যতার দোহাই দিয়ে এখন শিল্পখানাকেই ওলটপালট করে ছাড়ে তো ক্ষতিটা কার? শিল্প জমিনের নাকি সাহিত্য ধ্যানেচ্ছু (!) চন্ডাল মশাইয়ের? এখন মানুষের সাথে দূরত্ব বাড়লে আর্টিস্ট যদি খ্যাপাটে আচরণ করতে থাকেন এবং নিজ লেখাকে প্রবল দুর্বোধ্য করার সংকল্প নিয়ে নামেন, তবেই বলবো এখানে সমস্যাটা উভয়ের। মানে শিল্প ব্যাপারটা শিল্পীর ঠিক হজমে আসছে না। আর উপযোগের ব্যাপারটা তো তলানি হিসেবে হলেও একটুখানি থেকেই যাচ্ছে। তাই শিল্পের দুর্বোধ্যতা আর শিল্পীর দাম্ভিকতা এখন পর্যন্ত মানুষের অনাগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। বৃক্ষের অন্তত শিকড়টা টবের মাটিতে নয় নয়,জমিনের মাটিতেই প্রোথিত আছে।
ছোটবেলায়, সম্ভবত ক্লাস ওয়ানে ইংরেজি বইয়ে একটি কবিতা ছিল। যতদূর মনে পড়ে শুরুটা এ রকম, two little black birds sat on a wall ......one called Peter, one called Paul ...... ইংরেজি শুরু করেছি সবে। কবিতাটির বলতে গেলে সব শব্দই অপরিচিত ছিল। তারপরও কতবার যে পড়েছি এটি তার শেষ নেই। ব্যাপারটা ঘটে গেছে হয়তো ছড়া - ছন্দের মেকানিজমের দরুণ।
শব্দরাজির সঠিক বিন্যাস নয় বরং জুতসই শব্দ চাই। তবেই তাকে মালা বলে চালিয়ে তবে গলায় পরানো যায়। কোলরিজ যেমন বলেন, ' Prose : words in the best order. Poetry : best words in the best order. ' হয়তো গদ্যেও দরকার আছে একটা ক্রমের তবে শব্দের বক্ষবন্ধনী দিয়ে গদ্যকে বাঁধতে হয় না। শব্দ সৃষ্টি বা দায়িত্বহীনভাবে শব্দের আবাদ কবিতাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই একাগ্রে শব্দখেলার চিন্তাকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে চলে আসে সেই ধাক্কা বা ভালোভাবে বলতে গেলে 'পোয়েটিক রিদম '। বিন্দু বিসর্গ না বোঝার দোহাই হতে আপাতত অভিধান দিয়ে না হয় বাঁচা গেল। দৃশ্যটা বা ফেয়ারি টেলসের মতো একটা মরালই না হয় পাওয়া গেল। তো কাব্যভ্রমণের পুরো পথে আনন্দের জায়গাটা কোথায়? আলোড়নে সহায়ক বাড়তি কিছু অবশিষ্ট থেকে গেল কি? আসলে কিছুই থাকল না।
পাঠ, শ্রবন, দর্শন এগুলো তো উত্তেজনার এডভেঞ্চার বৈ ভিন্ন কিছু নয়। সব অভিযানের শেষেই থাকে আবিষ্কারের আনন্দ। এভারেস্টের চূড়োয় দাঁড়িয়ে অভিযাত্রী এভারেস্টের চূড়োকে আবিষ্কার (discover) করেন। এখানে পূর্বস্থিত এভারেস্টকেই জয় করেন। তবে কবিকে সম্ভবত এক সময় ডিসকভারির এরিয়া অতিক্রম করে ইনভেনশনের এরিয়ায় ঢুকতে হয়। এটা এক অর্থে নিজেকেই অতিক্রম। আমি তৈরি করতে পারি নিজস্ব সৌন্দর্যের জগত, নতুন ধারার এক দৃশ্য পরম্পরা। শেষমেষ আমাকে তো নিজেকেই পেছনে ফেলে যেতে হয়। যে ভাষা ওলটপালট হয়ে গেছে, যে ভাষাতে ঢুকিয়েছি অলংকার, যে ভাষা থেকে সেকেলের প্রত্যঙ্গগুলো ফেলে দিয়েছি বিনা সংকোচে, এখন সেই আপডেটেড ভাষা দিয়েই যদি কবিতার রঙ পাল্টাতে না পারি তবে ভাষাবদলের ঐ পরিশ্রমের কাজ না হলেও দিব্যি চলে যেত। ভাষা নতুন প্রাণ পেয়েছে। তার চারপাশটাও তো মানানসই হওয়া চাই।
এই সময়ে এসে প্রেম ব্যাপারটা শারীরিক না মানসিক এ বিতর্ক যেমন অর্থহীন, তেমনি কবিতার অলিগলি এবং কবিতা সহজবোধ্য হবে নাকি দুর্বোধ্য হবে সে বিষয়ক বিতর্কও মালমশলাবিহীন। প্রতি স্তবক নয়, প্রতি লাইন নয়, প্রতিটি শব্দে নতুন অনুভূতির স্বাদ দিয়ে যাবেন কবি । কবিতা হোক এ সময়ের বিনামূল্যের ভিনটেজ।