"Poetry is when an emotion has found its thought and the thought has found words." -- Robert Frost.
কবিতা নিয়ে নিরন্তর ভাবনার ফল অবিরতভাবে সেই আদি প্রশ্নে ফিরে যাওয়া , কবিতা আসলে কোন রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়
যা আমাদের বোধের জগতকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায় ? কবিতা উপস্থাপনের হয়তো বিভিন্ন ধারা আছে । আমাদের কাছে তা কি রূপে প্রতিভাত হয়? নন্দনের দিকটা অনেকাংশেই অন্ধ । আমরা মোটাদাগে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারি না অনুভবের ব্যাপকতার কারনে । আর এই ব্যাপকতা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে , সাম্প্রতিককালে কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ মোটামুটি গুরুতর । সিম্বলিস্ট মালার্মে তো ঘোষণাই দিয়েছেন , কবিতা শুধুমাত্র সেই পাঠকের জন্য যার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আছে । ' রহস্যতা ও দুর্বোধ্যতা সাধারণের অলস ঔৎসুক্য থেকে কবিতাকে রক্ষা করে ।' বস্তুত মালার্মে কবিতাকে নিয়ে গেছেন এক কঠোর উচ্চতায় যেখানে সাধারনের বোধগম্যতা অনেকাংশেই অচল । কঠোর বলছি এজন্য যে , মালার্মে যেহেতু প্রতীকবাদী ছিলেন , তাই স্বভাবতই তিনি চাইবেন কবিতার লাইন ,তার প্রতিটি রূপকল্পকে সিম্বলে পরিণত করতে ।শিল্পের অন্যান্য শাখার মত কবিতার রূপও সর্বদাই এক রকম থাকে নি । নতুন চিন্তা , নতুন নিরীক্ষা কবিতাকে দিয়েছে ভিন্ন রূপ । এছাড়া নানান দার্শনিক ভাবনা দ্বারাও কবিতা কম প্রভাবিত হয় নি । মানব মনের যে বিভিন্ন রূপ - অবচেতন , অর্ধচেতন এবং সচেতন( ইদ , ইগো এবং সুপার ইগো ) সবগুলোই কব্যরস দিয়ে তাড়িত হয় । কোন কবি যেমন শুধু একটি লাইন দিয়েই অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারেন পাঠকের মনে ,আবার বিপুল কাব্যরচনাও কোন কবিকে কোন এক সীমাবদ্ধতায় আটকে ফেলতে পারে । কবি বিনয় মজুমদারের অতি পরিচিত একটি কবিতার কিছু লাইন -
' সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কতো বেশি বিপদসংকুল
তারও বেশি বিপদের নিলীমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ
এ সত্য জেনেও - তবুও আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হতে চাই , চিরকাল হতে অভিলাষী ।
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভাল লাগে বলে ।
তবুও কেন যে আজো , হায় হাসি ,হায় দেবদারু
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায় । ' (ফিরে এসো চাকা )
এই যে ' মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায় ' , অন্যান্য লাইন এবং রূপকল্পকে ছাড়িয়ে এটিই মনে গেঁথে যায় । এটি অন্তর্নিহিত একটা শক্তি যা আঘাত করে , অথচ কোমলরূপে । হয়তো চোখ বুলিয়ে যাই অজস্র লাইনের উপর অথবা প্রায়শই পাঠ করি প্রিয় কবিতাগুলো । মনের কোন এক গহীন কোণে জমা থাকে একান্ত নিজস্ব কিছু লাইন । সৌন্দর্য কিংবা নন্দন যাই নলি না কেন অনুভবের যে ভিন্নতা ,নানা রূপ তা তো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয় । কবিতার নিজস্ব কোন দায়বোধ নেই প্রচলিত অর্থে অর্থমন্ডিত হওয়ার , এমনকি প্রতিকীও নয় ,যতটা দায় আছে দ্যোতনার মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ার । আসলেই তো তাই । আমি যদি পুরোপুরি একটি কবিতার ভেতর বাহির , তার যাবতীয় রূপ সব ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হই তাহলে পারতপক্ষে কি আমার চিন্তার জগতকে আলোড়িত করার জন্য অবশিষ্ট কিছু থাকে ? হুমায়ুন আজাদ বলেছেন , ‘ যদি কেউ দাবি করে কোন কবিতা পড়ে সে বুঝতে পেরেছে এবং তার বুঝতে পারার সাথে অন্যরা একমত হচ্ছে , ধরে নিতে হবে কবিতাটি ব্যর্থ ।’ তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায় , কবিতার উৎকৃষ্টতা পরিমাপের যে মানদণ্ড দিয়ে বিদগ্ধ সমালোচকগণ পাঠ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তা আসলে কিরূপ ? এবং এই ব্যাখ্যার যে নানা পদ্ধতি ,সেগুলোই বা কেন ? সৌন্দর্য অনুভবের বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়ন দীর্ঘকালের আলচনার বস্তু । মানসিক যে অভিজ্ঞতা আমরা কবিতার মাধ্যমে অর্জন করি , তা আমাদের বোধকে নিয়ে যায় চেতনার নতুন এক স্তরে ।
সম্ভবত এজন্যই নন্দনতাত্ত্বিকেরা নন্দনকে জগতের আর সব কার্যকলাপ থেকে আলাদা ভেবেছেন । বাস্তবিক বোধের সাথে অবশ্যই একান্ত অনুভবের বোধগুলো খাপ খায় না । এখন তাহলে প্রশ্ন এসে যায় , কবিতা কি তাহলে মোটেই বাস্তবতা ধারন করে না ? এটি কি সর্বদাই বাস্তবের সাথে এক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে ? বাস্তবতা তথা জাগতিক জীবনের নানা উপাদান কবিতায় আসতে পারে , তবে তা সম্পূর্ণতায় নয় । যা আসে তাও অনুভবের মাত্রাকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য । কবিতা তার কোন বিশেষ অংশ নয় ,বরং সমগ্রতা দিয়েই ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে । অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কবিতা যা নিয়ে ক্রমিক উচ্চতায় উঠে আসে , তা হল রূপ । প্রথাগত
অর্থে অসত্য কিছু কবিতায় স্থান পেলেও , কবিতায় অসুন্দর বলে কিছু নেই । এমনকি ধ্রুব সুন্দরতার যে ধারনা , আদর্শগত স্থির যে নান্দনিক বিচার , তাকেও বাতিল করে দিতে পারে কবিতা । জীবনের সুখকর বা বিষাদের অনুভূতিই শুধু নয় , কবিতা ধারন করতে পারে আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারন , গৌণ উপাদানও । আমার মতে শিল্পীর দায় শুধুমাত্র শিল্পের প্রতি । কবি যখন কবিতা লেখেন , তখন তিনি সমাজের কোন দায়বদ্ধ মানুষ কিংবা রাষ্ট্রের দায়িত্ববান নাগরিক নন । দায়বদ্ধতা আছে , তবে তা পুরোটাই তার কবিতার প্রতি । হ্যাঁ ,প্রতিবাদের ভাষা কবিতা ধারণ করতে পারে যদি তা হয় স্বতস্ফূর্ত । কবিতায় জোরপূর্বক কিছু আরোপ পুরো কবিতার শিল্পমানই নষ্ট করে দিতে পারে । জীবনের সংকট , পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা , বিপন্নতা সবই আসতে পারে , তবে তা পুরোপুরি মন থেকে উৎসারিত ।কোনভাবেই আরোপিত নয় । অন্তরের সর্বাপেক্ষা গোপন অথচ গভীরের কুঠুরি থেকে কবিতার উৎপত্তি । তাই এর ভবিষ্যতও বিশাল ।বাস্তবের অনুপুস্থিতি এখানে হাজির হয় নিজস্ব সিম্ফোনি নিয়ে । কবি আসলে কি করেন ? তার চিন্তাকে ভাষার রূপ দিয়ে একটা ক্ষেত্রতৈরি করেন । কবিতার পুরো ব্যাপ্তি সম্পর্কে পাঠক অপেক্ষা তার অজ্ঞানতা কম নয় । দুয়ার খুলে দেন কবি । আগ্রহভরে তিনি এবং পাঠক
উভয়ই ওপাশের জগতের দিকে ধাবিত হন ।‘ কবিতার যে মুহূর্তসৌন্দর্য তাতে আমরা অবগাহন করি । কিন্তু এর ব্যাখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাই না ।
' অজাতশত্রু একবার বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ,আপনি নির্বাণের যে মার্গর কথা বলেছেন তার উৎস কি ? বুদ্ধ উত্তর দিলেন , আমার অনুভব । কবিতার নন্দনের সূত্রও নিহিত আছে এইঅনুভবে । বাগানের ভেতর সারাদিন থেকেও কোন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হয়তো পান না ফুলের অজানা সৌন্দর্য ও গন্ধ ।কারণ ,
তিনি যে অজানা ফুলের নাম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন । কিন্তু মালাকার নিমিষেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন ফুলের এক এক গন্ধে । বোর্হেসের মতআমরাও বিশ্বাস করি , কবিতা অনুভবে । শিক্ষা দেওয়াতে নয় । নান্দনিক জিনিসের ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দেওয়ার প্রয়োজন নেই । অনুভব দিয়েইতার প্রাপ্তি ঘোচে । ’( কবিতার অন্ধনন্দন , কুমার চক্রবর্তী)
বর্তমানে কবিতা ছাড়িয়ে গেছে তার কালিক এবং ভাষিক সমস্ত ব্যাকরণকে । নিয়ম দিয়ে কবিতার জগতকে সীমাবদ্ধ করার পুরনো সব রীতিকে অতিক্রম করে গেছেন আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক অধিকাংশ কবিরাই । শব্দগুচ্ছ নিয়ে কবিতা নিজেই একটা শিল্পশরীর । ভাষা শুধু প্রতীকের কাজ করে । এটা এক কথায় অবধারিত ছিল । নানা চিন্তা ,নানা দর্শন দ্বারা প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ হয় মানবমন । কবিতা ক্রমেই হয়ে ওঠে সার্বিক এক প্রকাশ মাধ্যম । বৈচিত্র তথা নতুনত্ব দিয়ে আমরা আমাদের বোধের জায়গা এবং কবিতা দুটোকেই নিয়ে যেতে পারি অন্য এক নান্দনিক উচ্চতায় ।
(প্রায় বছরখানেক আগে লেখা। আসরের কবি বন্ধুদের সাথে কবিতা নিয়ে কিছু নিজস্ব ভাবনা শেয়ার করলাম।)