সুপ্রিয় পাঠক কবি বন্ধুগণ, অনেকদিন পর এই আসরে লিখছি। ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার দরুন দীর্ঘ কাল আসরে আসতে পারিনি। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটি মার্জনা করবেন আশা করি। গত ১৫-১২-২০১৪ তারিখে এই আসরে পোস্টকৃত 'শিল্পীর তৃপ্তি ও অতৃপ্তবোধ' শির্ষক রচনাটির আলোকে আজ নতুন করে আরো কিছু বলতে চাই তাই এই এই রচনা। উল্লেখ্য, রচনাটি আমার দ্বিতীয় প্রবন্ধগ্রন্থ 'মননের শাদ্বল ভূমে' শির্ষক প্রবন্ধগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
--------------------------------------------
অতৃপ্তিই শিল্পসত্ত্বা বিকাশের বড় নেয়ামক
সাহিত্য নিয়ে যখন ভাবতে বসি তখন সবার আগে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো কবিতা। এক যুগেরও বেশি নানান ব্লগ-পোর্টালে রকমারি লেখা পড়তে গিয়ে আর সংশ্লিষ্ট রচনায় মন্তব্য প্রতিক্রিয়া জাননোর সুবিধাটি কাজে লাগাতে গিয়ে যে লেখালেখির সূত্রপাত হয়েছিল কালক্রমে তা-ই রূপ পেয়েছে সাহিত্যচর্চায়। নিয়মিত চর্চার ফলে সাহিত্য সাধনাটি যেন জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর সাহিত্য সাধনায় যে বিষয়টি সবার আগে সামনে আসে তা হলো কবিতা। সেই কবিতা বিষয়ক ভাবনা থেকেই এই সন্দর্ভে শিল্পী তথা কবিতাশিল্পী সম্পর্কে কিছু কথা বলার প্রয়াস পাচ্ছি।
সৃজনের অবিনাশী সত্ত্বা - সৌন্দর্য রচনার অনন্য কারিগর। সাদা কথায় যাকে আমরা শিল্পী বলি। শিল্পীর শিল্পসত্ত্বা বরাবর ব্যক্তিকে ছাপিয়ে তার আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। যতদূর বুঝি, কারোর নির্দেশ কিংবা আদেশ মেনে দক্ষ কারিগর হওয়া যেতে পারলেও শিল্পী হওয়া যায় না। একজন শিল্পী ব্যক্তি হিসাবে যেমনই হোন না কেন তাঁর সাধনা বরাবর শাশ্বত সুন্দরের জন্য। শিল্পী তাঁর আপন খেয়ালেই শিল্পচর্চা করেন। জাগতিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয়াদি সেখানে গৌণ, সৃষ্টিটাই তাঁর মূখ্য উপজীব্য। তাই তিনি সৃষ্টির নেশায় জগৎ ভুলতে পারেন। শিল্পী বরাবর ভাবের তাড়ণায় কিংবা সৃষ্টিসুখের উল্লাসে বিভোর।
শিল্পী কখনোই কারোর দ্বারস্থ নন। ব্যক্তির কাছে তো কখনোই নয় তবে রাস্ট্র কিংবা সমাজের কাছে তাঁর দায়বদ্ধতা আছে! আর সেই দায়বদ্ধতা তাঁর শিল্পচর্চার অন্তরায় নয় বরং শিল্পকর্মকে আরো শানিত করার অমোঘ নেয়ামক বা উদ্দীপনার দুর্বার স্পিরিট। শিল্পীর শিল্পকর্ম কোন ফরমায়েশি পণ্য নয়, বলা যায় শিল্পকর্মটা তাঁর নেশা বা ইচ্ছাবিলাস। শিল্পী তাঁর ইচ্ছার কাছে জিম্মি, তিনি ইচ্ছার দাস। ইচ্ছার কাছে নিজেকে সোপর্দ করে শিল্পী তাঁর শিল্পের মাঝে বিলীন হতে ভালোবাসেন। আর সেখানেই তাঁর যত আনন্দ আর সুখ লুক্কায়িত।
কবিও এক হেয়ালী শিল্পী আর কবিতা হ’ল তাঁর ইচ্ছাবিলাস - একে বাড়িয়ে কমিয়ে লম্বা-খাটো, মোটা-পাতলা যা ইচ্ছা কবি করতে পারেন। এর কোন বিধিবদ্ধ ছক নেই, বহিঃর্কাঠামোর নির্দেশিকা নেই। কবির বোধটা যেন তাঁর শৈল্পিক আঁচড়ে নিজের মত করে স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে পারেন, পাঠকের অন্তঃপুরে যেন তাঁর সৃষ্টি অনায়েসে ঢুকে যেতে পারে। কবি ভাবনার সৌন্দর্য ও সুখানুভূতি যেন পাঠকের মনে ছড়িয়ে দিতে পারেন - কবির সেই স্বাধীনতাটুকু থাকা চাই। কিন্তু সেই স্বাধীনতা ক’জন ভোগ করতে পারেন? অনেকেই দু’ছত্র লিখেই কবি হয়ে উঠেছেন বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। আর ঠিক তখনই তাঁর কবিসত্ত্বার অপমৃত্যু ঘটে। আত্মবিশ্বাসী হওয়া আর আত্মতৃপ্তি মানা এক জিনিস নয়। হ্যাঁ, একজন শিল্পী বা কবিকে অবশ্যই তাঁর কর্মের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হতে হবে কিন্তু আত্মতৃপ্তি মেনে নিলেই শিল্পীর মৃত্যু অবধারিত।
কবিতা কোন সংবাদ বা প্রতিবেদন নয় যে, পাঠককে মূল বক্তব্যটি বোঝাতে পারলেই হ’ল! কবিতা তারো বেশি কিছু, কেননা এতে ভাবের পাশাপাশি থাকে শৈল্পিক কারুকাজ যা কবিতাকে রমণীয় ও আবেদনময়ী করে তোলে। আর যেখানেই শিল্প সৌকর্যতার প্রশ্ন সেখানেই বরাবর থাকে অপূর্ণতাবোধ। আর সেই অপূর্ণতাবোধ থেকেই শিল্পী জন্ম দেন কালজয়ী নতুন কোন সৃষ্টির। সেখানেও তিনি তৃপ্ত নন তবু তাঁর শিল্পকর্মটি তৈরি করতে পারে যুগজয়ী এক নতুন ইতিহাস। সেই অর্থে কোন শিল্পীর শিল্পই পরিপূর্ণ হয় না কখনো। কিছু না কিছু অপূর্ণতা থেকেই যায়। আর, সেই অভাব বোধটিই শিল্পীকে তাড়িত করে নিয়ত উত্তম সৃজনের মূলে।
এযাবত অর্জিত কাব্যিকতার জ্ঞান থেকেই বলছি; কবিতা সৃজনে পূর্ণতার কোন স্থান নেই। যথার্থ কবি বরাবর তার সৃষ্টির খুঁত অন্বেষণ করে থাকেন। আপন সৃষ্টির ত্রুটি দুর্বলতা খুঁজে পাওয়াটা যেকোন শিল্পীর এক বিশেষ গুণ। উৎকৃষ্ট শিল্প তখনই সম্ভব যতক্ষণ শিল্পী তাঁর সৃষ্টির ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো খুঁটিয়ে দেখার বিষয়ে নিষ্ঠাবান। উৎকৃষ্ট কবিতার জন্ম দিতে হলেও কবিকে বারবার তাঁর সৃষ্টির ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। জাতকবি কখনোই পরিপূর্ণ কবিতা লিখে ফেলেছেন বলে তৃপ্তি মানতে পারেন না। কোন কবি যখনই পরিপূণতার তৃপ্তি নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে তুষ্ট হবেন - জানবেন, কবি নামের আড়ালের মানুষটা বেঁচে থাকলেও কবির মৃত্যু হয়েছে।
শব্দহীন শব্দের শ্রবণশক্তি হয়তো সবার থাকে না তবে এর ক্ষমতা স্পষ্টবাকের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। মেধা-মননে পুরুষ্ট নয় যে হৃদয়, তা মোটেও সাহিত্যবাসের উপযোগী নয়! মনন-মেধায় যথেষ্ট ধার না থাকলে সাহিত্যরস আহরণ বড় কঠিন। কবি একজন শব্দ কামার। ‘শব্দ কামার’ যিনি শব্দকে পোড়াতে ও পেটাতে শেখেন - তিনি গড়তে পারেন শব্দ-ছন্দের নতুন নতুন অবয়ব, হয়ে উঠেন কবিতাশিল্পী। তাই দু’ছত্র লিখে কবি বনে যাওয়া আর কবিতাশিল্পী হওয়া কখনোই এক নয়। জীবনে নানান আবহে দু’এক চরণ কবিতা হয়তো অনেকেই লিখে থাকেন। সেই অর্থে যিনি দু’এক চরণ কবিতা লিখেছেন তিনিই কবি। তাই বলি; কবি হওয়া খুব সহজ কিন্তু কবিতাশিল্পী হওয়া অনেক কঠিন।
কবিতা হ’ল কবির সৃষ্টি। আর সৃষ্টি মানেই জীবন বা প্রাণের স্পন্দন। কবি সৃজন করেন অর্থাৎ জীবনের সুরসুধা রচনা করেন। তাই মৃত্যু বা বিলয় কখনোই কবির সৃষ্টির বিষয়বস্তু নয়। জীবন মানে যেমন প্রাণের স্পন্দন, মৃত্যু তেমনি প্রাণের বিলয় সম্ভাষণ। মৃত্যু মানব জীবনের এক শ্রেষ্ঠ ঘটনা বটে কিন্তু একমাত্র অভীষ্ট নয়, জীবনই অভীষ্ট। তাই সৃষ্টি সৃজনের শেষ নেই, সমাপ্তির কোন দাঁড়ি কমা নেই। সৃজনশালার কোন দরজা নেই। সৃষ্টির মহাযাত্রায় বিরতি থাকতে পারে কিন্তু শেষ বলে কিছু নেই। সৃজনশীলতার অনন্ত নদী সতত বহমান আর কবির কবিতা সৃজনের কর্মকুশলতাও থাকে অনন্ত ধাবমান।
যথার্থ শিল্পী শিল্প রচনা করে বা কবিতা লিখে কখনোই শতভাগ পরিতৃপ্তির সুখে ভাসতে পারেন না। কেবলই তাঁর মনে হবে; আরো ভাল হতে পারতো। একজন কবি হবেন নিখুঁত শিল্পী। শিল্পকর্মের মধ্যে কবিতা খুব কঠিন শিল্প। মননে জাগা বিমূর্ত ভাবকে যথাসাধ্য মূর্ত করেই তাঁকে পাঠকমন জয় করতে হয়। তাই, কবি কখনোই তাঁর সৃষ্টিতে পরিতৃপ্ত হন না যতক্ষণ না পাঠককে পরিতৃপ্ত করতে পারেন। তাই, পাঠকের তৃপ্তিই কবির তৃপ্তি, তাঁর শিল্পের সার্থকতা। তখনই তিনি মনে করেন – এবার তাঁর শিল্পটি মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। মোটামুটি বললাম এই কারণে যে, সেই কবিতাটি কখনোই শতভাগ পাঠকের মন জয় করতে পারে না।
একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম শিল্পী নিজে বন্ধ না করলে তা কখনো শেষ হয় না কিন্তু গণিতের একটা অঙ্ক শেষ করার পর আর কিছুই করার থাকে না। ওটা আপনাতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জাতশিল্পীর অতৃপ্তির তৃষাটা কখনোই যেন মিটতে চায় না। তিনি ভাল থেকে আরো ভাল করতে চান। যেন তিনি নিজের প্রিয়তমাকে বারবার নানান সাজে দেখে তৃপ্ত হতে চান। পূর্ণতা বোধ না করলেও বাস্তবতার প্রয়োজনেই এক সময় তাঁকে থামতে হয় তাই, থামেন। আর পরবর্তী শিল্পে আগেকার ঘাটতিটুকু তিনি পুষিয়ে নিতে চান। এভাবেই শিল্পী এবং কবি ক্রমাগত পরিশীলিত হয়ে উঠেন।
তাই বলি, প্রকৃত কবি কখনোই তার সৃষ্টি পূর্ণ করতে পারেন না অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কবিতা হ’ল বলে তৃপ্তি মানতে পারেন না। তৃপ্তি মানলে কবি নামক মানুষটি বেঁচে থাকলেও কবির মৃত্যু হয়ে যায়। যেমন একজন গাড়িচালক যতক্ষণ একথা মাথায় রেখে গাড়ি চালান যে, আমি এখনো পটু ড্রাইভার হয়ে উঠিনি। সুতরাং আমাকে বরাবর সতর্ক থাকতে হবে। তাই তিনি গাড়ি চালনায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করেন। আর সেই বাড়তি সতর্কতার ফলে যেমন আরো নিখুঁতভাবে গাড়ি চালাতে পারেন তেমনি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকেও বাঁচতে পারেন। শিল্পীও যদি মনের মাঝে এমনি অপূর্ণতার ক্ষুধা পোষণ করেন তাহলে তার পরবর্তী কর্মে আরো বেশি মনযোগী হতে পারেন। তাতে তাঁর শিল্পমান বাড়ে বৈ কমে না।
একজন কবির সমগ্র জীবনটাই যেন হয় সাধনার কঠিন সংগ্রামে মোড়ানো একটি পূর্ণাঙ্গ ও শ্রেষ্ঠ কবিতার চারণক্ষেত্র। সেখানে কবি ফসল ফলাবেন, সোনালি শস্যের স্বপ্ন দেখবেন, তাঁর সৃষ্টির পরিচর্যা করবেন। সেই সোনারূপী ফসলে কাব্যরসিকের হৃদয় তৃপ্ত হলে তবেই কবি সার্থক শিল্পী হয়ে উঠবেন। আর সেখানেই কবির সার্থকতা, সেটুকুই তৃপ্তি। তাই বলি; সৃষ্টির মহাযাত্রায় বিরতি থাকলেও থামা নেই, সৃজনশালার কোন দরজা নেই, তা অবারিত, অবাধ। দরজা থাকা মানেই তাকে অবরুদ্ধ করার সুযোগ থাকা। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়: অতৃপ্তিই হ’ল শিল্পসত্ত্বা বিকাশের বড় নেয়ামক।