শিশুকাল থেকেই কবিতা ও ছন্দ ভাল লাগতো। আমি কিছু ব্যতিক্রম নই, এমন অনেকেরই লাগে। অজ-পাড়া-গাঁয়ে মানুষ, তাই চর্চা ছিল না মোটে। স্কুলে পাঠ্য বিষয় হিসাবেই যা কবিতা পড়া হতো। আর স্কুলের বাইরে কবিতা বলতে; কালেভদ্রে বিশেষ কোন অনুষ্ঠানে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ থেকে একটু আধটু আবৃত্তি – ব্যাস। কলেজজীবনে কখনো মনে ভাব এলে লুকিয়ে ছাপিয়ে দু’একটি লিখলেও সাবধানে থাকতাম; কেউ যেন দেখে না ফেলে। পরিণত বয়েসেও রোগটা এখনো কাটেনি। তাই আগাগোড়াই ছদ্মনামে লিখি।
এখনো পরিচিত মহলে আমার কাব্যরোগের কথা বরাবর আড়াল করেই রাখি। আমার প্রকাশিত কোন বই পর্যন্ত কাউকে দিতে যাই না। কারণ পরিচিত মহলের অনেক উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিতজনকেও দেখি কবিতা বিষয়ে বেশ উদাসীন। তাদের কাছে কর্ম ধর্ম ও অর্থোপার্জনই জীবনের একমাত্র কাজ। সাহিত্যে-ফাহিত্য বরং ছেলে-ছোকড়ারা করলেই মানায়। তাদের ধারণা কবি সাহিত্যিকরা একটু ক্ষেপাটে বা পাগল কিসিমের লোক। এসব ‘নাই কামে’ সময় দেয়ার মত সময় তাদের নেই।
কিন্তু কীভাবে যেন সারা জীবন এই রোগটি আমার মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল। একটু আধটু ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল বটে, কিন্তু কবিতা লিখতাম না। কী করতে লিখবো? পাঠক পাবো কাথায়? প্রকাশ করবে কে? আবার তা প্রকাশের জন্য পত্র-পত্রিকায় ধর্না দেয়াও সম্ভব না। তা হলে আর লিখে কী হবে? প্রেরণা আসবে কোথা থেকে? আর প্রেরণা না পেলে কবিতার সৃষ্টি হবে কী করে?
প্রযুক্তির আশীর্বাদ! এখন দেখছি কবিতা লিখে তা প্রকাশের জন্য পত্র-পত্রিকায় ধর্না না দিলেও চলে! নানান ব্লগ-পোর্টালে চাইলেই ইচ্ছামত যখন খুশি পোস্ট করা যায় আবার কিছু পাঠক পড়েনও! কেউ কেউ উৎসাহ দেন। কেউ বা আবার গঠনমূলক পরামর্শও দেন। বছর দুই আগে ‘সোনায় সোহাগা’ - এই বাংলা-কবিতার সন্ধান পাই। আর যাই কোথা? রোগটি এবার সবেগে আক্রমণ করলো। তখন থেকেই কবিতা চর্চা করা আর লিখা। কবিতার ভাবনাগুলো সারাক্ষণ মাথায় কিলবিল করতে থাকে। সেই কাব্যরোগের প্রভাবে কখনো কখনো ভাবনার অতলান্তে হারিয়ে যাই – দেখি, ঘরে-বাইরে, কর্মে-যাপনে সর্বত্রই কবিতা! সারা বিশ্বই কবিতাময়!
স্বপ্নের পাদদেশে সৃষ্টির প্রতিভাসে
কেউ যদি এঁকে যায় জীবনের কাব্য
বেগবান স্রোত চাই, দেখতে চাই না
পিছন ফিরে, সে নদী নাব্য কি অনাব্য।
কবিতা যেন প্রিয়তমার সৌন্দর্য আবিষ্কারের মত এক অনন্ত আকর্ষণ! তাকে টেনে-খুঁড়ে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে যতই দেখি – তৃষ্ণা মিটে না। প্রেমিকের চোখ যেমন কখনো প্রিয়তমার সৌন্দর্যের পূর্ণতা টানতে জানে না তেমনি কবিতারও পূর্ণতা খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিনিয়ত কবি তার সৃষ্টির হাতিয়ার শান দিয়েই চলেন, সামান্য উৎসাহ পেলেই তিনি বর্তে যান -
দেবী তুমি কবিতা প্রণয়-নিচয়
তোমা তরে মানি না কোন অবচয়।
মন্দ-ভালো যা-ই লিখি, বন্ধুরা কন বেশ
ভালবাসার শত প্রভায় পাই অনিঃশেষ!
মনে তো হয়; একটা মানুষের পুরো জীবনটাই একটা কবিতা! মানব জীবনে যেমন ছন্দ আছে, ছন্দ-পতনও আছে। প্রাপ্তির তৃপ্তি আছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের জোয়ার-ভাটা আছে, বিরহের করুণ রাগিনী কিংবা মিলনের সুর আছে। তেমনি কবিতায় এর সবই আছে! কী নেই কবিতায় – জীবনের চলনে বলনে দিবসে নিঃশ্বাসে খাওয়া-পরায় মায়, আচার আচরণের সর্বত্রই কবিত্ব রয়েছে। তাই বলি;
আমি এক হঠাৎ কবি
ভাবনার কাব্য নদে
খাচ্ছি ডুবে শুধুই খাবি।
সুর পেলে তাই ছন্দ রচি
নইলে চেঁচাই হেড়ে গলায়
সৃষ্টিসুখে তা-ধিন্ নাচি।
কবিতা নিয়ে গবেষণা হয়, চিরকালই হয়ে এসেছে। কবিতার উৎকর্ষতার জন্যে গবেষণা প্রয়োজন। তবে আমি বরাবর কবিতার ছন্দ ও লয়ে বিশ্বাসী। দেখতে যাই না ভাব বিন্যাসে কতটা বিমূর্ততা ছড়াতে পেরেছি কিংবা পাঠককে কতটা ধাঁধাঁয় ফেলতে পেরেছি। বরং পাঠক বোধ্যতার বিষয়টি মাথায় রেখে মনে যেমন আসে তা-ই লিখে যাই -
বুঝি না কিছুই স্পষ্ট কি অস্পষ্ট দুরূহ ছবির
খুঁজি না ভাব কতটা ব্যপক, কতটা গভীর
রাতের গর্ভে আঁধার যেমন, আলোর গর্ভে শূন্যতা
করতালি পাই বা না পাই ছন্দে গাঁথি কবিতা।
কবি তার সমসাময়িক সমাজ ও পরিবেশকে পাশ কাটাতে পারেন না। সমাজ ও দেশের প্রতি তার দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই দেশ সমাজের কোন অসংগতি অন্যায় অত্যাচার দেখলে কিংবা মানুষকে সত্য সুন্দরের জন্যে উজ্জীবিত করে তুলতে কবির কলম বারবার সরব হয়ে উঠবে। তবেই তিনি হবেন মানুষের কবি, সমাজের জন্যে উপকারী। আমি মনে করি; কবি তাঁর কলম চাহনিতে সমাজ দেখবেন, সমাজের অসংগতি আর অসুন্দরকে সেই কলমেই সাফ-সুতরো করবেন -
কবিতা নিয়ে শত ভাবনার ফুলকুঁড়ি,
কাব্য-পাখিদের অস্থির উড়াউড়ি
বর্ণ-ছন্দে উঠুক জেগে শব্দের মিছিল
ভেঙে যাক যতসব অসুন্দরের পাঁচিল।