বন্ধুরা প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন। শীতের এই শিশির ভেজা হিমেল দিবসে সবাইকে আমার পাতায় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাই। অনেকেরই হয়তো মনে আছে; ইতোপূর্বে ভাষাকে শুদ্ধ করে লেখার নানান উপায় ও কৌশল সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মানসে এই পাতায় একই শিরোনামে আরো ৬টি পর্ব উপস্থাপন করেছি। সে সব পড়ে কোন কোন বন্ধু বেশ উপকৃত হয়েছেন বলে জানিয়ে আরো লিখার অনুরোধ করেছেন। সকল বন্ধুদের প্রতি রইল আমার প্রাণের অভিনন্দন ও আন্তরিক ভালবাসা। আপনাদের ভালবাসায় হৃষ্ট হয়ে আজ আবারো বানান শুদ্ধতার কিছু টিপস্ বাতলে দেয়ার এ প্রয়াস – কেউ উপকৃত হলে আমার পরিশ্রম সার্থক বলে গণ্য করব।
আলোচনার শুরুতেই একটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি (যদিও ইতোপূর্বে এই পাতাতেই আলোচনা করেছি, তথাপি অনেক বন্ধুকে প্রায়ই এই ভুলটা করতে দেখি – ক্রিয়া পদের শেষে ‘না’ পদটিকে একসাথে লিখেন যেমন: করিনা, খাইনি, পাবনা, ধরিসনে ইত্যাদি):
* বস্তুত নঞর্থক শব্দ আলাদা লিখতে হবে যেমন: নাই, নেই, না, নি, নে, নয়... এই নঞর্থক অব্যয় পদগুলি শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে। যেমন : বলে নাই, যাস নে, যাই নি, পাব না, তার মা নাই, আমার ভয় নেই। জানি না (পাবনা, যাবনা, বলেনি, হইনি, জানিনা, হতনা, শুনিনি, খাবনা, পাননি ইত্যাদি কখনো নয়)।
তবে শব্দের পূর্বে নঞর্থক উপসর্গরূপে ‘না’ পদটা উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন : নারাজ, নাবালক, নাহক, নালায়েক, নাগাওয়া, নাদান, নাখোস ইত্যাদি।
এবার আলোচনা করব স্বরধ্বনি এ-কার (ে-কার) এবং ও-কার (ো-কার) প্রসঙ্গে:
এ/অ্যা এবং ে-কার:
বাংলায় এ বা (ে-কার) দ্বারা অবিকৃত ‘এ’ এবং বিকৃত বা ব্যাঁকা ‘অ্যা’ উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনিই নিষ্পন্ন হয়৷ তত্সম বা সংস্কৃত শব্দ - ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাপ্ত, জ্যামিতি, ইত্যাদি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম আছে৷ কিন্তু তৎসম এবং বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য সকল বানানে (বিকৃত-অবিকৃত নির্বিশেষে) এ বা ে-কার হবে৷ যেমন: দেখে, দেখি, জেনো, কেন, কেনো (ক্রয় করো অর্থে), গেল, গেলে, গেছে্ইত্যাদি৷ উল্লেখ্য; অনেকেই দ্যাখে, দ্যাখি, জ্যানো, ক্যান, গ্যালো, গ্যালে, গ্যাছে ইত্যাদি লিখে থাকেন। সে সব বিকৃত ‘অ্যা’ কতটা ব্যাকরণসম্মত তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে৷
বিদেশি শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা ে-কার ব্যবহৃত হবে৷ যেমন: এন্ড (end) , নেট, বেড, শেড৷
আবার বিকৃত বা ব্যাঁকা উচ্চারণে ‘অ্যা’ বা (য-ফলা+আ-কার) ব্যবহৃত হবে৷ যেমন: অ্যান্ড (and), অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট৷
তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষ কিছু দেশী শব্দ রয়েছে যার (য-ফলা+আ-কার)-যুক্ত রূপটিও বহুল-পরিচিত৷ যেমন: ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা৷ এ-সব শব্দে (য-ফলা+আ-কার) অপরিবর্তিত থাকবে৷
ও এবং ো-কার:
বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়৷ এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে ো-কার ব্যবহার করছেন৷ যেমন: ছিলো, করলো, বলতো, কোরছ, হোলে, যেনো, কেনো (কীজন্য), ইত্যাদি ো-কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে৷ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ো-কার ব্যবহার করার দরকার নেই৷
বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ো-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে৷
ক্রিয়াপদের যা যা রূপে ো-কার লাগানো হবে:
তুমি, তোমরা (সাধারণ বর্তমান কাল): ধরো, চড়ো, বলো, হও, খাও, যাও, বানাও
তুমি, তোমরা (ঘটমান বর্তমান কাল): ধরছো, চড়ছো, বলছো, হচ্ছো, খাচ্ছো, যাচ্ছো, বানাচ্ছো
তুমি, তোমরা (পুরাঘটিত বর্তমান কাল): ধরেছো, চড়েছো, বলেছো, হয়েছো, খেয়েছো, গেছো, বানিয়েছো
তুমি, তোমরা (বর্তমান অনুজ্ঞা): ধরো, চড়ো, বলো, হও, খাও, যাও, বানাও
তুমি, তোমরা (ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা): ধোরো, চোড়ো, বোলো, হয়ো, খেও/খেয়ো, যেও/যেয়ো, বানিও/বানিয়ো
সাধিত ধাতুর অসমাপিকা রূপ: ধরানো, চড়ানো, বলানো, খাওয়ানো, বানানো
ক্রিয়াপদের যে সব রূপে ো-কার লাগানো হবে না:
এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (সাধারণ অতীত কাল): ধরল, চড়ল, বলল, হল, খেল, গেল, বানাল
এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (ঘটমান অতীত কাল): ধরছিল, চড়ছিল, বলছিল, হচ্ছিল, যাচ্ছিল, বানাচ্ছিল
এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (পুরাঘটিত অতীত কাল): ধরেছিল, চড়েছিল, বলেছিল, হয়েছিল, গেছিল/গিয়েছিল, বানিয়েছিল
এ, এরা, ও, ওরা, সে, তারা (নিত্যবৃত্ত অতীত কাল): ধরত, চড়ত, বলত, হত, খেত, যেত, বানাত
আমি, আমরা (সাধারণ ভবিষ্যৎ কাল): ধরব, চড়ব, বলব, হব, খাব, যাব, বানাব
পুরাঘটিত অসমাপিকা রূপ: ধরে (ধোরে বা ধ'রে নয়), চড়ে, বলে, হয়ে
অন্যান্য শব্দ:
ো-কারযুক্ত:
তো, মতো, ভালো, আলো, কালো, কেন (কিসের জন্য), যেন, কোনো (বা কোনও), এখনো (বা এখনও), তখনো (বা তখনও), কারো (বা কারও)
ো-কারবিহীন:
বড় (বড়ো নয়), ঘন (ঘনো নয়), মন (মোন নয়), একজন (একজোন নয়), এক শ (অর্থাৎ ১০০; এক শো বা এক শ' নয়)
লেখাটি আর বড় করে বন্ধুদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। সবশেষে বলব; টিপসগুলো পড়ে বাস্তব প্রয়োগ করলে সহজেই এর সুফল পাবেন। এমন নিরস লেখাটি পড়ার জন্যে পাঠকবন্ধুকে আবারো ধন্যবাদ জানাই।