বন্ধুরা, এখন যা বলব - তা ব্যাকরণের কোন নিয়ম নয় বরং পাতায় পাওয়া অসঙ্গতিগুলোই তুলে ধরছি (কিছু বন্ধুর অনুরোধে লিখছি) যা - আগের কোন এক লেখায় এ বিষয়ে কিছু লিখব বলে কথা দিয়েছিলাম। জানি; এ জাতীয় আলোচনায় কোন বন্ধু মনঃক্ষুণ্ণও হতে পারেন। তবু শুদ্ধতার খাতিরে একটু বলতেই হচ্ছে। আমার কোন ভুল হলে বা বাড়াবাড়ি মনে হলে ক্ষমা করবেন। তবে, এ থেকে যদি কোন বন্ধু উপকার পান আমার প্রয়াস সার্থক বলে বিবেচনা করব।
কবিতা লেখা বেশ সোজা! আর সে কারণেই কবির সংখ্যা এত বেশি; তাই আমিও কবি! কেন না - বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, কবি তার আপন সৃষ্টির সেরা গবেষক ও মহান স্রষ্টা। তিনি যা লিখবেন তা ই কবিতা (তা অন্য কারো বোধে না আসলেও কবিতা!)। সুতরাং ভুল শুদ্ধ যা ই লিখি তা ই কবিতা বলে মেনে নেয়া হয়। কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যে দু’চার লাইন লিখতে গেলেই সমস্যা। বাক্যটিকে এখানে আর কবিতার মত দুর্বোধ্য রাখা যায় না তাই, হয় আমরা বাক্যটি সফলভাবে শেষ না করেই “...” (ট্রিপল্ ডটস্)-এর ব্যবহার করি নয়তো অপূর্ণ বাক্যে ভুলটাই রেখে যাই। কবি-সাহিত্যেকরা মূলত কথাশিল্পী। সুতরাং একজন কথাশিল্পীর কাছে কোন পাঠকই এ জাতীয় ফাঁকি আশা করেন না।
প্রত্যেক ব্যক্তি-কবি আপন সৃষ্টিতে বরাবরই স্বাধীন! আর সেই স্বাধীনতার সুবাদেই আমরা ভাষাকে কাঁটাছেঁড়া করে নানান গবেষণা করছি! বিশ্বাস করা হয়; যুগের প্রবাহেই ভাষা এক সময় তার আপন অবস্থান খুঁজে নিবে... তবে ভাষাকে যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে কলুষিত না করার বিষয়ে কবি-সাহিত্যিকদের একটা মহান দায়িত্বও রয়েছে। আমরা যেন সে কথাটিও মাথায় রাখি, কোনরূপ অপব্যবহার না করি। শব্দ-গঠন ও বাক্য-বিন্যাসের ব্যাপারে অনেক ঋদ্ধ কবিকেও যথেষ্ট বেখেয়াল অথবা যথেচ্ছাচার হতে দেখি, যা - খুবই দুঃখজনক। এ নিয়ে কথা বললে অনেক বন্ধুই হয়তো নাখোস হবেন। তাই ও বিষয়টি নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করতে চাই না। তবু যে একটু না বললেই নয়!
পাতায় অনেক কবি আছেন যারা শত শত কবিতার পোস্ট দিচ্ছেন। তাঁদের দীর্ঘদিনের সরব পদচারণায় আসর ধন্য, তবু কেউ কেউ নিম্ন মানের শব্দ ও বাক্য গঠন করেও রীতিমত ভ্রুক্ষেপহীন। বিষয়গুলো তাদের নজরে আনলে সংশোধন তো করেনই না কেউ আবার অপমান বোধ করেন বা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কবিতায় কবির আপন সত্তাকে বরাবরই প্রাধান্য দেয়া হয়। তার মানে এই নয় যে, একজন চাইলেই যা-ইচ্ছে করতে পারি, যেমন খুশি বাক্য বানাতে পারি; তাতে ভাব প্রকাশ হোক বা না হোক (ব্যাকরণের কথা না ই বললাম)। এ জাতীয় স্বেচ্ছাচারিতা কেবল ওই কবিরই ক্ষতি করে না; বরং লেখাটি যারা পড়ছেন তাদেরও ক্ষতি করছে। বিষয়টি কবিদের মাথায় রেখে বাক্য গঠন করা চাই যেন বাক্যটি শুদ্ধ হয় এবং মনের ভাব পূর্ণ প্রকাশ পায়। শত শত কবিতা লিখে পাতা ভরছি কিন্তু আলোচনায় বা মন্তব্যে নজর করলেই বোঝা যায় যে আমি কতটা অজ্ঞতা লালন করেও নিজের সৃষ্টিতে অসীম তৃপ্তি মানছি। আমার মনে হয়; কবিদের এ-বিষয়টায় আরো বেশি মনযোগী হওয়া দরকার।
আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা খুবই মনোরম হতে পারে সুতরাং, আঞ্চলিক ভাষার কবিতাকে স্বাগত জানাতেই হবে। কিন্তু কিছু কবি আছেন (তারমধ্যে কিছু প্রসিদ্ধ কবিও আছেন) যারা - ভাষার আঞ্চলিক উচ্চারণের কথ্যভাষার সাথে সাযুজ্য বানান লিখেন যেমন; দ্যাশ, দ্যাখো, য্যানো, দ্যাখলো ইত্যাদি। কবিদের মনে রাখতে হবে; এ জাতীয় বানানগুলো ভাষা বিকৃতির জন্যে অনেকাংশে দায়ী। এটা পরিহার করা উচিৎ।
কি এবং কী শব্দ দু’টির ব্যবহারের পার্থক্য (যা আমরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলি): সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে কী শব্দটি ‘ী’ (ঈ-কার) দিয়ে লেখা হবে। যেমন : কী করছ? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলব? কী জানি? কী যে করি! তোমার কী। এটা কী বই? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে। কী আনন্দ! কী দুরাশা!
অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে কি শব্দটি লেখা হবে। যেমন : তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলা কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী। এখানে কি চাও? ইত্যাদি।
সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ‘ম’ স্থানে অনুস্বার (ং) লেখা যাবে। যেমন : অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন। তবে অঙ্ক, অঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা, গঙ্গা, বঙ্গ, লঙ্ঘন, সঙ্গ, সঙ্গী, প্রভৃতি সন্ধিবদ্ধ নয় বলে ঙ স্থানে ং হবে না।
‘আলি’ প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ‘ি’ (ই-কার) হবে। যেমন : খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি।
এবার আমার নিজের মত করে কিছু টিপস্ বলছি (আমি ব্যাকরণবিদ নই, ক্ষমা করবেন; ব্যাকরণের ভাষ্য জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতে পারব না):
‘ও’-এর ব্যবহার: ‘ও’ একটা সংযোগকারী অব্যয় হলেও কোথাও আবার কিছু পদ বা ধাতুর সহযোগী হয়ে কাজ করে যেমন; তুমিও, আমিও, সেও, তাদেরও, তারপরও, কোথাও, যদিও, সত্ত্বেও, তখনও, এখানেও ইত্যাদি। এ সব ক্ষেত্রে ‘ও’ কখনোই আলাদা বসবে না, বরাবর মুল পদের সাথেই বসবে। ‘ও’-কে কখনো আবার ‘ো’ (ও-কার) হয়ে যেতেও দেখা যায় যেমন: কখনো, আমারো, আবারো, তারো ইত্যাদি।
‘ও’ যখন সংযোগকারী অব্যয় তখন সে ‘এবং’ এর বিকল্প হিসাবে কাজ করে একই বাক্যে দুই বা ততোধিক সংযোগকারী অব্যয় পদ (ও, এবং, অথবা, কিংবা, নতুবা, নয়তো, আরো ইত্যাদি) ব্যবহার করতে হলে একই অব্যয় পদ বারবার ব্যবহার না করাই বাঞ্চনীয়। স্থান, ভাবার্থ, অবস্থা ও পরিবেশ বুঝে এদের ব্যবহার করতে হবে। অনেকেই আমরা ভুল করে একই বাক্যে দুই বা ততোধিকবার ‘ও’ অথবা ‘এবং’ ব্যবহার করে থাকি। দুইয়ের অধিকবার ব্যবহার করতে হলে - ‘ও’ ‘এবং’ ব্যবহারের পর ‘বা’ ‘কিংবা’ ‘অথবা’ ব্যবহার করতে পারি। সে ক্ষেত্রে দুই পদের সংযোগকারী অব্যয়টি কোন পদের সাথেই যুক্ত না হয়ে পৃথকভাবেই বসবে। যেমন; সে এবং আমি কিছু বই ও খাতা কিনলাম। রহিম এবং করিম প্রান্তিক চাষি, দবিরও তাই, আবার সজল ও কুদ্দুস কিংবা তোমরা অথবা আমরা কেউই এই প্রজেক্টের উপকারভোগী নই।
‘দু’ হবে না ‘দূ’ হবে?: ‘দু’ ধাতুটি যখন নঞর্থক তখন ‘দু’ সহযোগে সকল বানানেই ‘দ’-এ ‘ু’ (উ-কার) হবে যেমন; দুর্দশা, দুর্মর, দুর্বহ, দুর্বার, দুর্বোধ্য, দুরূহ, দুর্দিন, দুর্জয়, দুর্লঙ্ঘ, দুরাশা, দুর্দান্ত, দুর্ণীতি, দুঃসাহস, দুঃসময় ইত্যাদি ছেলেবেলায় শব্দগুলো কানমলা খেয়েই ‘ূ’(ঊ-কার) দিয়ে শিখেছিলাম। তাই, এ সব শব্দে আমিও আগে ‘দূ’-ই ব্যবহার করতাম। আসলে ওই সবই ছিল ভুল। একমাত্র ‘দূর’ সম্পর্ক বোঝাতেই ‘দ’-এ ‘ূ’(ঊ-কার) হবে বাদবাকি কোন শব্দেই ‘দ’-এ ‘ূ’(ঊ-কার) দেয়ার দরকার নেই যেমন; সুদূর, দূরদেশ, দূর-প্রবাস, দূরাভাস, দূরালাপনী, দূরদৃষ্টি, দূরসম্পর্ক ইত্যাদি।
আজ তাহলে এখানেই থামছি। অন্যদিন অন্য কোন প্রসঙ্গ নিয়ে আবার হাজির হব। ততক্ষণ আসুন সবাই বেশি বেশি চর্চা করি। সবাইকে ভালবাসা ও শুভেচ্ছা রইল।