বন্ধুরা, গত পর্বে বানানে ‘ষ’ এর বাধ্যতামূলক ব্যবহার (ষ-ত্ব বিধান) সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজ আলোচনা করব ‘ণ’ এর বাধ্যতামূলক ব্যবহার (ণ-ত্ব বিধান) সম্পর্কে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে; বানানের ক্ষেত্রে ‘ষ’ এবং ‘ণ’ এর ব্যবহারের বিভ্রম কাটিয়ে উঠতে পারলে বানান-সমস্যার অর্ধেক সুরাহা হয়।
ণ-ত্ব বিধান:
মূল নিয়ম: ণ-ত্ব বিধান (মূর্ধন্য-ণ এর নিয়ম) কেবলমাত্র তৎসম শব্দের (যে সকল শব্দ সংস্কৃত থেকে অবিকৃত অবস্থায় এসেছে) ক্ষেত্রে ‘ণ’ হবে।আর অ-তৎসম(অর্ধ-তৎসম বা তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দ)-এর ক্ষেত্রে সর্বদাই দন্ত-ন ব্যবহৃত হবে।
তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ণ-এর নিয়ম:
যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের বর্ণগুলোর (ট ঠ ড ঢ ণ) পূর্বে মূর্ধন্য-ণ হবে, যেমন:
ণ্ট (ণ+ট) ঘণ্টা, নিষ্কণ্টক, বণ্টন
ণ্ঠ (ণ+ঠ) অবগুণ্ঠন, উৎকণ্ঠা, লুণ্ঠন
ণ্ড (ণ+ড) কলকুণ্ডলি, ঠাণ্ডা, লণ্ডভণ্ড
ণ্ঢ (ণ+ঢ) ঢুণ্ঢি, ঢেণ্ঢন (তেমন প্রচলিত নয় এই শব্দগুলো)
ণ্ণ (ণ্ণ) অক্ষুণ্ণ, ক্ষুণ্ণ, বিষণ্ণ
লক্ষণীয় ব্যতিক্রম;
ক্ষুন্নিবৃত্তি (ক্ষুৎ+নিবৃত্তি) এবং ক্ষুণ্ণি শব্দের উৎস এক নয়। প্রথমটি সাধিত (উপসর্গ, সন্ধি বা সমাসযোগে গঠিত) শব্দ, যেখানে ৎ+ন=ন্ন, ‘ন’-এর দ্বিত্ব হয়েছে> ক্ষুন্নি। কিন্তু ওয়ারেন্ট, কমান্ডার, পান্ডা যেহেতু বিদেশি শব্দ, এদের বানানে দন্তে-‘ন’-ই হবে।
অ-তত্সম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে পণ্ডিতবর্গ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ন্ঢ হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।
ঋ, র, ষ থাকলে - মূর্ধন্য-ণ হবে যেমন:
ঋ বা ঋ-কারের পর: ঋণ, ঘৃণা, মৃণাল ইত্যাদি।
র, র-ফলা এবং রেফ এর পর: অরণ্য, আহরণ, উদাহরণ, ভ্রূণ, মিশ্রণ, স্ত্রৈণ, অর্ণব, পূর্ণিমা, বিশীর্ণ ইত্যাদি।
লক্ষণীয় ব্যতিক্রম;
এই নিয়মানুসারে রেফ এর পর মূর্ধন্য-ণ হয় বলে তৎসম শব্দে রেফ-যুক্ত দন্ত-ন সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু কিছু শব্দে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায় যেমন: অহর্নিশ (অহ+নিশ), দুর্নীতি (দুর্+নীতি), দুর্নাম (দুর্+নাম)।
ষ' এর পর: অন্বেষণ, নিষ্পেষণ, ভাষণ
লক্ষণীয় ব্যতিক্রম;
ষ এর সাথে ণ যুক্ত হলে, যুক্তবর্ণের চেহারা হবে ষ্ণ: কবোষ্ণ, বৈষ্ণব, উষ্ণীষ।
ক্ষ=(ক+ষ), সুতরাং ক্ষ এবং ষ এর নিয়ম একই: ঈক্ষণ, তীক্ষ্ণ, সমীক্ষণ।
একই শব্দে ঋ/র, র-ফলা, রেফ/ষ, ক্ষ
এদের যে-কোনোটির পরে যদি স্বরবর্ণ, ক-বর্গের বর্ণ (ক খ গ ঘ ঙ), প-বর্গের বর্ণ (প ফ ব ভ ম), য য় হ ং এই সব বর্ণের এক বা একাধিক থাকে, তবে তার পরে মূর্ধন্য-ণ হবে। রোপণ (র+ও+প+ন্), শ্রাবণ (শ+র+আ+ব+ন্)
লক্ষণীয় ব্যতিক্রম;
ঋ/র, র-ফলা, রেফ/ষ, ক্ষ/ এর পরে অন্য বর্গের বর্ণ থাকলে মূর্ধন্য-ণ হবে না যেমন: দর্শন, প্রার্থনা।
সন্ধিজাত বা সাধিত শব্দের ক্ষেত্রেও ‘ন’ হবে যেমন: নিষ্পন্ন (নি:+পন্ন)।
কিন্তু শব্দের শেষ বর্ণটিতে হসন্ত-উচ্চারণ থাকলেও এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়: শ্রীমান্।
‘পরি, প্র, নির’ এই ৩টি উপসর্গের পর ‘ণ’ হয় যেমন: পরিণয়, প্রণাম, নির্ণয়।
লক্ষণীয় ব্যতিক্রম; পরিনির্বাণ, নির্নিমেষ।
র বা র-ফলা'র পর, পদের শেষে ‘অয়ন’ উচ্চারণ থাকলে - এর ‘ন’ মূর্ধন্য-ণ হবে যেমন: উত্তরায়ণ, চান্দ্রায়ণ, রবীন্দ্রায়ণ।
কিছু শব্দে আবার ‘র’ এর প্রভাবে ‘ন’ মূর্ধন্য-ণ-'তে পরিণত হয়ে যায় যেমন: অগ্রণী, গ্রামীণ। বিশেষ ব্যতিক্রম; অগ্রনেতা।
‘গণ’ ধাতু সহযোগে গঠিত শব্দ সমূহে ‘ণ’ হবে যেমন: গণিত, গণনা, গণ্য; গণৎকার; গণশক্তি, জনগণ, গণসংগীত।
নিত্য মূর্ধণ্য-ণ: স্মরণ রাখতে হবে যে, এসব শব্দগুলো বরাবরই ‘ণ’ হবে যেমন: অণু, কণা, কোণ, ফণা, বেণী, শাণ, কঙ্কণ, বাণ, ভণিতা, শোণিত, ঘুণ, বীণাপাণি, লাবণ্য, বিপণি, মাণিক্য, চাণক্য, গণেশ প্রভৃতি।
আমার কৈফিয়ত: যদিও লেখাটা ব্যাকরণের আশ্রয়েই লিখেছি। তবু আমি কোন ভাষা বিশেষজ্ঞ বা ব্যাকরণের পণ্ডিত নই। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে আমার মত করে সহজ ভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াসী হয়েছি মাত্র (এখানে কোনটাই আমার নিজস্ব মতামত নয়)। ভাষার মত স্পর্শকাতর একটা বিষেয়ে আমার সংকলনকে যেন কেউ ব্যাকরণ বা বানান শিক্ষার গাইড মনে না করেন। অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে এই লেখায় কোন ভুল পরিলক্ষিত হলে দয়া করে্ আলোচনায় তুলে ধরুন। আমি তা সংশোধন করে নেবো।
ব্যাকরণ বিষয়টা বরাবরই কঠিন। নিবিষ্ট পাঠে তাকে মননে ঢোকাতে হয় আর চর্চার মাধ্যমে অভ্যস্থ হতে হয়। বিষয়টা শেখার পর চর্চা না করলে আবার ভুলেও যেতে হয়। কাজেই নিয়মগুলো পড়ার পাশাপাশি যদি চর্চা করতে পারি তাহলে নিশ্চিত; উপকার পাবোই। আমরা জানি; শুদ্ধ বানানের জন্য চর্চার কোন বিকল্প নেই। কাজেই - সবাইকে বেশি বেশি চর্চা করতে হবে। সবাইকে ধন্যবাদ।
(উইকিপিডিয়া সহ নানান তথ্যসূত্র অবলম্বনে সংকলিত)