আমি এক ‘ক্রিটিক’ – খাস বাংলায় যাকে বলা যায়; খুঁতসন্ধানী, সমালোচক বা নিন্দুক। তাতে নিজের খুঁতটাও সমভাবে দেখতে চাই কিন্তু মজার ব্যাপার; দেখতে পাই না! এই আসরে এসে যখন দেখলাম প্রায়শই কোন না কোন সজ্জন বন্ধু আমার ত্রুটিগুলোকে ধরিয়ে দিচ্ছেন; আমি স্বাগত জানালাম – এবং শিখলাম। আরো শিখতে বাড়তি ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। নিজেকে সংশোধনীর প্রবল ইচ্ছার কারণে ইতোমধ্যে অনেক কিছুই আয়ত্তে আনতে পেরেছি। যা – আমি বিগত অর্ধ শতাব্দীতেও অর্জন করতে পারি নি। এই পাতার বন্ধুরা আমায় অনেক দিয়েছেন - বানান, যতি-চিহ্নের ব্যবহার, বাক্যরীতি ও সম্পাদনার যে ত্রুটিটুকুই আমার মধ্যে ছি’ল তার অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠেছি – মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে।
এই আসরে ৬০০০-এর বেশি লেখক আছেন, প্রতিদিন কমবেশি শ'খানেক পোস্ট আসে। তার মধ্যে একেবারেই কাঁচা হাতের মান-বহির্ভূত লেখা কদাচিৎ চোখে পড়ে। সে সংখ্যাটাও গড়ে ৫ শতাংশের বেশি নয়। তাদের সংশোধন করেও কোন লাভ নেই। এছাড়া আসরে অনেক সুশিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী লেখক আছেন যারা চর্চার অভাবে, যাচাইয়ের অভাবে বা নিতান্ত খামখেয়ালীতেই ভুল করে যাচ্ছেন। সে সব ভুল নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের একমাত্র স্থান এই পাতা। মন্তব্যের সুবাদে ভুল-ত্রুটির আলোচনা, বানান সংশোধনী ইত্যাদি জানতে পারছি। তাতে অন্যেরটা দেখেও নিজে শিখতে পারছি।
অন্যত্র ছাপার অক্ষরে বা ইন্টারনেটে আমরা যা পড়ি তার সবই যে শুদ্ধ তা কিন্তু নয়। এমন কি পত্র পত্রিকা এবং প্রসিদ্ধ লেখকের লেখাতেও অহরহই অনেক ভুল দেখতে পাওয়া যায়। সে-সব পড়ে কিন্তু কেউ মন্তব্য রাখতে পারে না, সংশোধনীরও অবকাশ নেই। কারো যদি নিজেকে সংশোধনের ইচ্ছা থাকে তা'হলে এই আসরই হ'ল একমাত্র উপযুক্ত স্থান যেখান থেকে কেউ নিজেকে ক্রমান্বয়ে পরিশুদ্ধ করে তুলতে পারেন (অন্তত আমি তা-ই মনে করি)। সুতরাং আমরা চাইব; পাতায় এই চর্চাটা অব্যাহত থাকুক। এক বন্ধু অপর বন্ধুকে যেন সর্বদাই সহযোগীতার হাতটি বাড়িয়েই রাখি।
বন্ধুরা, এই লেখাটি কোন শিক্ষামূলক ‘গাইড’/ব্যাকরণ বা নিয়ম শেখার নির্দেশনা নয়। নিজে এখনো পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ হয়ে উঠি নি, তবু অতীতের যে-সব ত্রুটিগুলোর কিছু ধরতে পেরেছি - সে’ আলোকেই বানান, যতিচিহ্নের ব্যবহার, বাক্যরীতি ও সম্পাদনার বিষয়ে পাতার বন্ধুদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি শেয়ার করার মানসে এই লেখার অবতারণা যেন; এভাবেই নানান চর্চায় দিন দিন আমরা পরিশীলিত হতে পারি।
বরাবর পাতায় আমি লেখার চেয়ে পড়ি বেশি। যেহেতু কবিতার পাতা, তাই এখানে কবিতার রসাস্বাদনেরই চেষ্টা করি। পাশাপাশি বানান ও বাক্য-বিন্যাস নিজের জানাটার সাথে পরখ করি। বুঝতে না পারলে শুধুই স্তুতিবাচক মন্তব্য দেই না। প্রিয় লেখক বা ভাল লেখা হলে প্রয়োজনীয় মতামত দেই, তাতে মন্দটাও বাদ যায় না। সন্দেহ হলে যাচাই করে নেই এবং লেখককে প্রয়োজনীয় সংশোধনীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এতে অনেক কবি বন্ধু আবার আমার উপর নাখোসও হন(ক'দিন আগে পছন্দের এক বিশিষ্ট কবির পাতায় কিছু লিখলে জবাবে জানালেন; আমাকে দেখলেই নাকি ভয় হয়...ইত্যাদি। তিনি এখন আর আমার পাতায় আসেন না)।
‘বানানের ভূত’ বা ‘ছাপাখানার ভূত’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। এই ভূত কমবেশি সবার ঘাড়েই আসীন হয়। একজন যত পণ্ডিতই হোন, সতর্কদৃষ্টি সত্ত্বেও নানান কারণে বিশুদ্ধ লেখকেরও(বানান, শব্দ-প্রমাদ ও যতিচিহ্নের) দু'একটি ভুল হয় না এ'কথা কেউ জোর গলায় বলতে পারবেন না। কথায় আছে - 'ভাত খেতে দু'একটি ভাত ছিটে পড়েই'। তেমনি একজন বিশুদ্ধ লেখকেরও কোন না কোন লেখায় দু'একটি ছোট-খাট ত্রুটি থাকতেই পারে। সেটা দোষের নয়; তবে কোন সতীর্থ যদি সহৃদয়তার সাথে সে বিষয়ে লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তা কখনোই দোষের নয়। আমরা জানি; একজন সতীর্থ ছাত্রবন্ধু কিন্তু তাদের শিক্ষকের তুলনায় ভাল বোঝাতে পারে। এখানেও আমরা একে অপরের কাছে অনেকটা সে-রকমই।
বানান ভুলের বিষয়ে বাস্তবতা থেকে নিজে যে কারণগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি সেগুলো তুলে ধরছি:
চোখে বানানের ছবি এঁকে রাখা: আমি কোনদিন বানান মুখস্ত করি নি বরং জানামত শুদ্ধ বানানের একটা স্বীকৃত ছবি মনে আঁকা রয়েছে। একটা বানান দেখে যদি সে ছবির কিছু ব্যতিক্রম দেখি তখনই সেটা প্রশ্নের উদ্রেক করে। অনেক সময় দ্বিধা কাজ করলেও আগে অলসতা করতাম। এখন করি না বরং যাচাই করে নিশ্চিত হই। সুতরাং ভুলের সংখ্যা কমে এসেছে।
বানানের প্রাচীন রীতি পরিত্যাগ করা: প্রায় অর্ধ-শতাব্দী আগে শেখা বানানের সাথে অধুনিক বানান-রীতি কতক ক্ষেত্রে বেশ সাংঘর্ষিক। যে বিষয়গুলোকে আগে খুব একটা আমলে আনতাম না, নিজের জানা বানানটাই জুড়ে দিতাম, এখন তা করি না বরং যাচাই করে প্রমিত-রীতিটাই অনুসরণ করতে চেষ্টা করি।
বেশি বেশি চর্চা করা: যথেষ্ট পরিমাণে চর্চা ছাড়া শুধুই মুখস্ত করে বানান শুদ্ধ রাখা মুশকিল। প্রায়শই একই বানানের ভুল-শুদ্ধের একাধিক বানান দেখে দেখে অনেক সময় জানা বানানটায় ও বিভ্রম জাগে। বানান সংশোধনীর বিষয়ে পাতায় কেউ সঠিক বানানটি ইঙ্গিত করলে যাকে বানানটি ধরিয়ে দেয়া হ'ল তিনি যেমন উপকৃত হন, যারা সে’টি পড়েন তাদেরও কেউ কেউ তা থেকে শিখতে পারেন। বিজ্ঞাপনের মতই - যে জিনিসটা চোখে ও মননে বেশি বেশি ভাসে তা ই প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। অহরহ ভুল বানান দেখতে দেখতে অনেক সময় ভুলটাকেও শুদ্ধ বলে বিভ্রম ঘটে।
প্রমিত বানান-রীতি অনুসরণ করা: প্রমিত বানান-রীতি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই। বাংলা একাডেমির অভিধানের শেষের দিকে পরিশিষ্ট অংশে প্রমিত বানান-রীতি সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে। সময়াভাবে বা কষ্ট করে কেউ আমরা তা পড়তে যাই না। পড়লেও চর্চার অভাবে আবার ভুলেও যাই - অনেকটাই কম্পিউটার কী-বোর্ড কমান্ডের মত। কাজেই কষ্ট হলেও প্রমিত বানান-রীতি পড়তে হবে ও নিয়মিত চর্চা করতে হবে।
পরবর্তী পর্বে প্রমিত বানান রীতির কিছু কিছু বিষয় পর্যায়ক্রমে এই পাতায় বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার ইচ্ছা আছে। আশা করি আগ্রহী বন্ধুরা খেয়াল রাখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।