যুগ বাস্তবতার প্রতিযোগীতায় সদা-ব্যস্ত এই আধুনিক বিশ্বের জটিল সময়ে আমরা যারা কাব্যচর্চা করি – কবিতার পাঠক অথবা লেখক; তারা বুঝি এক বিশেষ প্রজাতির জীব! নির্মোহ দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে সমাজে তাদের এক ধরণের স্বতন্ত্র পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়: তারা খানিকটা খ্যাপাটে, পাণ্ডিত্যপূর্ণ মনোভাব পোষণকারী, ভাবুক প্রকৃতির বিশেষ শ্রেণীভুক্ত মানুষ বলেই সমধিক পরিচিত। স্বভাবতই তারা একটু স্পর্শকাতর আবেগের ধারক-বাহক হয়ে থাকেন! তাদের কেউ কেউ সমাজে কিঞ্চিৎ সমীহ পেলেও অথিকাংশই অবজ্ঞা-মিশ্রিত করুণার ‘পণ্ডিত’ ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন।
একটা সময় ছি’ল, যখন সমাজে কবিদের একটা বিশিষ্ঠ আসন দেয়া হ’ত। অশিক্ষিত কিংবা কম-শিক্ষিত জনও কবিতা উপভোগ কর’ত, কবিতা মুখস্ত কর’ত, নিত্য জীবনের প্রাত্যহিক কর্মে-আচরেণে সে-সব কবিতা ‘কোট’ করে কবিতার মর্মার্থ অনুধাবন করে শিক্ষা নেয়া হ’ত, শিক্ষা দেয়া হ’ত, জীবনাচরণে সে-সব অনুসরণ করা হ’ত। যেমন; ‘চির-সুখীজন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে..’, ‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে/দাদা বলে ডা’ক যদি গলা দে’ব টিপে...’, ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দি’ল উদার হতে ভাই রে/ কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাই রে...’, ‘যে-জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার জ্বলিবে না আর নিশিথে প্রদীপ ভাতি...’, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নি:শ্বাস/ ওপারেতে সকল সুখ আমার বিশ্বাস...’ ইত্যাদি, এমন হাজারো শিক্ষণীয় কবিতা বা কবিতাংশ মুর্খ-শিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের মুখে-মুখে ঠাঁই পে’ত।
কালের বিবর্তনে আজ কবির সংখ্যা বহুগুন বেড়েছে, কাব্যের বোধ-ব্যাপ্তিতে ও গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তনও এসেছে, প্রতিদিনই হাজা’র কবিতার জন্ম হচ্ছে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবেই কবিতার গণ-সম্পৃক্ততা যেমন কমেছে কবি এবং কবিতার কদরও কমেছে। কেউ আর এখন কবিতা মুখস্ত করে না, কবিতাংশ ‘কোট’ করে নিত্য জীবনের কোন কাজে লাগায় না। কাব্যমোদি পাঠক বড়জোর একবার পড়েই তা ভুলে যান। এমন কি কবি তার স্ব-রচিত বিখ্যাত কবিতাটির দু’টি লাইন নিজেও ঠিক-ঠিক মুখস্ত বলতে পারেন না। এটা কি কবিতার জন্য সুংবাদ না দু:সংবাদ তা বিবেচনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। বিয়য়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে বৈকি।
এবার আসা যাক কবিতার পাঠক ও সমঝদার কারা। আগের যুগে যেমন অল্প ক’জন বিশিষ্ঠ ভাগ্যবান কবিতা লিখে বহু কষ্টে ‘কবি’ খেতাব অর্জন করতেন আর শিক্ষিত-মুর্খ নির্বিশেষে ব্যাপক পাঠককুল তা পাঠ করতেন বা অন্যের মুখে শুনতেন, নিত্য-জীবনে সে-সব কবিতার মর্মার্থ চর্চা করতেন, এখন হয়েছে ঠিক উল্টোটি। এখন যারা লেখক তারাই পাঠক। কবি হওয়ার জন্যে তেমন কাঠ-খড় পোড়াতে হয় না। একটা কিছু লিখে দিলেই কবিতা হয়ে যায়, লেখক ও দিব্বি ‘কবি’ বনে’ যান। সাধারণ জনগোষ্ঠীর অতি নগণ্য অংশ হয়’ত এখন কবিতা পড়েন তা কেবলই তাৎক্ষণিক পুলক উপভোগ করতে। আর তাদের বেশির ভাগই ছাত্র বা শিক্ষিত নবীন/যুবক – যাদের বয়েস অধিকাংশই চল্লিশের নিচে।
উল্লেখিত সংখ্যার বাইরে কবিতার সমঝদার এত নগণ্য যে, তা উল্লেখ করার ম’ত নয়। যা-ও দু’চারজন আছেন তারা নেহায়েত প্রাণের তাগিদে কবিতার-মোহ ত্যাগ করতে পারেন না বলেই যেন কবিতা পড়েন। তাদের বেশির ভাগই আবার নিজে দু’চারটি কবিতা লিখেনও। আজকাল উচ্চ-শিক্ষিত ব্যক্তি-মণ্ডলীও কবিতা পড়েন না বা উপভোগ করতে পারেন না। তার কারণ কি? কারণ, আজকাল কবিতার মধ্যে জীবন ও প্রাণের সম্পৃক্ততা প্রচ্ছন্ন থাকে অথবা থাকেই না, যার সুক্ষ্ণ আবরণ ভেদ করে অনেকের পক্ষেই কবিতার মুলরস উপভোগ করা হয়ে উঠে না। আমার জানাশোনা অনেক উচ্চপদস্থ ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি আছেন যারা কবিতার কথা শুনলেই উপহাস করেন, অনেকেই আবার ভাবেন ওটা আবেগপ্রবণ অসুস্থ মানুষের নেশা বিশেষ। কেউ আবার বাড়িয়ে বলেন; বিজ্ঞান বুঝি, অঙ্কও খানিক বুঝি কিন্তু কবিতা- ওরে বাবা, মাফ চাই। ওতে আমার মাথা ধরে। কেউ বা আবার বলেন ওটা মাথায় ঢুকে না, মাথার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে যায়...
কবিতার নারী পাঠকের সংখ্যা তো করুণ-ভাবেই কম। মাঝবয়েসী কর্মজীবী পুরুষ কিংবা নারীর ৯৮ ভাগই কবিতা পড়েন না। পেশাগত দায়িত্ব আর সংসারের নিত্য টানাপোড়েনে তাদের কাব্যচর্চার সময় এত কমে গেছে যে, তারা বরং ভাবেন; ততক্ষণ টিভি দেখলে(খেলা, সিরিয়াল, টকশো, রেসলিং- যা খুশি) সময়টা ঢের ভাল কাটবে... আসলে কবিতা যে-টুকু টিকে আছে তা অনূর্ধ্ব চল্লিশের লেখক পাঠকের চর্চায়। এই সাইটেই দেখবেন (পাঠকের ধারণা পাই না, তবে চল্লিশোর্ধ্ব লেখকের সংখ্যা খুবই কম)।
তা হলে সহজেই অনুমান করা যায় যে; ব্যাপক জনগোষ্ঠী এখন কবিতা ভুলে গেছেন। তার কারণ কি? এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায়ই বা কি? বিজ্ঞ কবিকুল বিষয়টা ভেবে দেখবেন কি? কি করলে এই অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে? আলচনায় অংশ গ্রহণ করার জন্যে সবাইকে আগাম ধন্যবাদ, প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।