এক কবিবন্ধু বলেন - আমার নামটি এলেই না কি তাঁর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মনে পড়ে। আমি ধন্য; অন্তত কিছু নজরুল-ভক্তকে বার বার কবির নামটি স্মরণ করিয়ে দিতে পারছি। আমার নাম সম্পর্কে একটু বলতে হয় – নামটিতে নজরুলের দুই ছেলেরই উপস্থিতি রয়েছে। অবশ্য তার একটি আমার মা-বাবা’র দেয়া নাম বটে। কাব্যচর্চায় কেউ যদি আমাকে নজরুল প্রভাবিত বলেন, কিছু মনে করবো না বরং গর্ব অনুভব করবো। ছেলেবেলায় এতবড় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিও দাঁড়ি-কমাসহ মুখস্ত আবৃত্তি করে বছরে কম করে দু’টি প্রাইজ আনতামই।
আমার বিশ্বাস; বাঙ্গালী কাব্যপ্রেমিক মাত্রেই কমবেশি নজরুল ভক্ত। যত আধুনিক ধারার কবিতাই লেখা হোক না কেন বেশির ভাগ কবিই নজরুলের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন না। এটা পশ্চাদপদতা না কি মডেল তা জানি না তবে, একজন লেখক পাঠকহৃদয়ে কতটা ঠাঁই করে নিলে পাঠকের লেখনীতেও জানতে বা অজান্তে প্রভাব রয়ে যায়! আবার এক শ্রেণির ঊন্নাসিক কিছু কবির সাক্ষাৎ পাই যারা, রবীন্দ্র নজরুল জীবনানন্দের প্রভাবকে সেকেলে বলে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারলে নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণিভূক্ত প্রমাণ করার প্রয়াস পান। সেই বন্ধুদের উদ্দেশ্যে নজরুল বিষয়ে দু’টি কথা বলতে চাই:
জ্ঞানী গুণীজন প্রতিনিয়তই নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করছেন, নিয়মিত নজরুল বিষয়ে লেখালেখি হচ্ছে। আমি সেসব কিছুই করছি না। কেবল আজকের কবিকূলকে একটি বিষয় স্মরণ করাতে চাই – আজ এই ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ার যুগে আমরা অকবি হয়েও একটা কিছু লিখেই (তা কবিতা হোক বা না হোক) বিভিন্ন মাধ্যমে স্বাধীনভাবে প্রচার করে মিনিটে মিনিটে পাঠকের প্রতি্ক্রিয়া, আলোচনা, সমালোচনা ও সংশোধনের নির্দেশনা সহ গঠনমূলক কিছু উদ্দীপনা পাচ্ছি।
আমরা সেই ভাগ্যবান; মিডিয়া-পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে আর মাসের পর মাস সম্পাদকের বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। একদিনে যতগুলো খুশি লেখাও কিছু পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার কোন সমস্যা নেই। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমসহ বিভিন্ন ব্লগ-পোর্টালে প্রকাশ করে নিজের লেখার মানটি সাথে সাথেই মোটামুটিভাবে যাচাই করার সুযোগও পাচ্ছি। কিন্তু একবার নজরুলের কাব্য জীবনের কথা ভাবুন তো!
জীবনানন্দ দাশ কিংবা নজরুলের প্রেক্ষাপট ছিল - দারিদ্রতা কবলিত প্রতিকূল পরিবেশে থেকে সাহিত্যকে ভালোবাসা। পক্ষান্তরে মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য সাধনা করেছেন বরাবর স্বচ্ছল ও বনেদী পরিবারের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। বলা যায়- ‘সোনার চামুচ মুখে নিয়ে’। যদিও শেষ জীবনে মাইকেলকেও চরম দরিদ্রতম পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব সামান্য পূঁজি নিয়েই নজরুলকে কেবল প্রকৃতিগত মেধা, নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও সাধনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হয়েছে। কত চড়াই উতরাই পাড়ি দিয়ে কত প্রতিকূল পারিবেশে চরম দারিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, তৎকালীন সনামধন্য হিন্দু কবিদের মোকাবেলা করে তবেই তিনি একটি কবিতা কোন পাত্রিকায় প্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন।
স্মর্তব্য; তৎকালীন মুসলমানরা শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রেই ছিল পশ্চাৎপদ। মুসলমানরা (নেড়া কিংবা যবন) ছিল সর্বক্ষেত্রে অচ্যুত বিশেষ। তার উপর কোন নেড়া/যবনের সাহিত্যচর্চা! এ যে কল্পনারও অতীত! কারো কারো বিবেচনায় তা ছিল সাহিত্যিকদের জাত-কূল খোয়াবারই নামান্তর! একজন যবন কবি হিসাবে ডি এল রায়, সজনীকান্ত দাস সহ তৎকালীন বিখ্যাত কবিদের কত টীকা-টিপ্পনী সয়ে নিত্য দিনের অসম্মানজনক সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে কিংবা দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে তাঁকে কীভাবে আগাতে হয়েছে? যা - তিনি ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় এভাবে তুলে ধরেছেন –
“...বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।...”
এত প্রতিকূলতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও তাঁর লেখনী থেমে থাকেনি। তাঁর রেখে যাওয়া কয়েক হাজার উঁচুমানের কবিতাই তার প্রমাণ। সেই তুলনায় আমরা কত ভাগ্যবান! 'ইন্টারেক্টিভ মিডিয়া'য় লিখে সাথে সাথেই পাঠক পাচ্ছি। জানতে পারছি লেখাটি নিয়ে পাঠকের প্রতিক্রিয়া, সমালোচনা - যা থেকে এক একটা আলোচনার জন্ম হচ্ছে! তাতে আমরা প্রশিক্ষিত না হয়েও নানান কবির সংসর্গে মূল্যবান পরামর্শ ও উপদেশ পাচ্ছি। সুতরাং, আগের যুগের কবিদের তুলনায় আমরা খুবই ভাগ্যবান নই কি?
এই আসরসহ নানান ইন্টারেক্টিভ মিডিয়া’য় যারা লিখেন সবাই নবিশি লেখক। বেশিরভাগই সবাইকে নানানভাবে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। এর মাঝেও কেউ আবার এইসব নবিশি লেখিয়েদের কাব্যমান নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করে হতোদ্যম করতে দেখা যায়! সাহিত্যচর্চার স্বার্থে এটা শোভনও নয়, উচিৎও নয়। সাহিত্যকে ভালোবেসে যারা সাহস করে দু'চার কলম লিখতে প্রয়াস পাচ্ছেন তাঁদের নিরুৎসাহিত করা নয় বরং আসুন গঠনমূলক সমালোচনা এবং ভুলত্রুটি সংশোধনীর ইঙ্গিতসহ উৎসাহিত করি।
রবীন্দ্রনাথ কিছু একদিনেই কবিগুরু বা বিশ্বকবি হয়ে উঠেননি। এইসব নবিশি লেখিয়েদেরই কেউ একজন হয়তো একদিন নজরুল রবীন্দ্রনাথ বা আরো বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারেন! কে জানে সেই ভবিষ্যতের কথা? আবর্জনা সদৃশ্য শত শত লেখনী থেকে যদি সাহিত্য-বাগানে দু'একটি গোলাপ গাঁদা পদ্ম বেলী ফোটে ক্ষতি কি? বাংলা সাহিত্য-ভাণ্ডারে সেসবের অবদান মোটেও সামান্য নয় কিন্তু!
মাইকেল রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের যুগে ঈশ্বর প্রদত্ত জ্ঞান-মেধাকে কাজে লাগিয়ে সাধনার মাধ্যমেই তাঁরা স্ব-স্ব আঙ্গিকে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। এখনো অনেকের মাঝেই ঈশ্বর প্রদত্ত জ্ঞান-মেধা রয়েছে। তার উপর বাড়তি আশীর্বাদ - প্রযুক্তির সুবিধায় বেশি বেশি চর্চা করার অবাধ সুযোগ এখন যা রয়েছে আগে তার কিছুই ছিল না। প্রত্যয়ী হলে আর চর্চা সাধনা থাকলে ভালো কিছু করা বা হওয়ার সুযোগ সম্ভাবনা এখন বরং আগেরচে'ও বেশি, একটুও কম নয়। সুতরাং, একজন লেখককে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে, হৃদয়গ্রাহী ও নজরকাড়া সৃষ্টির অবদান রাখতে হলে আত্ম-প্রত্যয়ী হওয়া চাই, বেশি বেশি চর্চা করা চাই।