কবিতার অনুবাদ নিয়ে কথা বললে খানিকটা বিতর্ক এসে যায়। কারো কারোর দাবি; সাহিত্যের অনুবাদে বড়জোর ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মিটে’। এতে মূল রচনার আসল স্বাদটি পাওয়া যায় না। গান বা কবিতার ক্ষেত্রে কথাটা অনেকাংশেই ঠিক। গান বা কবিতার অনুবাদ আসলেই কঠিন। বলা যায় প্রায় অসম্ভব। হ্যাঁ, ভাবানুবাদ হতে পারে।
অনুবাদ - সাহিত্যের এক শক্তিশালী মাধ্যম। মূল সুরটির শতভাগ প্রতিফলিত না হলেও অনুবাদের মাধ্যমে ভাষান্তরিত বিদেশী কবিতা কাব্য সুষমায় মণ্ডিত হয়ে যত বেশি অনুদিত হবে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারও তত বেশি সমৃদ্ধ হবে। কাজেই, অনুবাদই বলি আর ভাবানুবাদই বলি বিদেশী কবিতার বাংলা সংস্করণে দোষের কিছু তো নেইই বরং এটাকে মহৎ কর্ম বলে জ্ঞান করতে পারি।
যেকোন সাহিত্যের মান ও শ্রীবৃদ্ধিতে অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাহিত্যের পুষ্টিসাধনে অনুবাদের ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীর সমৃদ্ধতর ভাষা থেকে বৈচিত্রপূর্ণ ভাব ও তথ্যাবলী চয়ন করে আপন ভাষার বহন ও সহন ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা এবং ভাষা তথা সাহিত্যকে সমৃদ্ধকরণই অনুবাদ সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য। যেকোন উন্নতমানের সাহিত্য থেকে নতুন ধারার ভাব বোধ শব্দ উপমা বাক্য বা জীবনধারার বিশিষ্টতা ধার নিয়ে আপন সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করায় অনুবাদের বিকল্প নেই। এই ধার করাতে কোন দোষ নেই বরং গৌরব আছে।
অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ব-সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ভাব ও বক্তব্য সহজে আয়ত্তে আসে। রচনার মূল ভাষাটি না জেনেও অনায়াসেই ভিনদেশী সাহিত্যের সাথে পরিচিত হতে পারছি। সুতরাং, ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে অনুবাদ সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক উপাদান – কোন সন্দেহ নেই।
অনুবাদ সাহিত্যের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। যেকোন সমৃদ্ধ ভাষা বা সাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমে অনুদিত ভাষায় হরেক বিষয়ের প্রতিশব্দ তৈরি করা যায়, অন্য ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় শব্দ ও বোধ ধার করা যায়। এভাবেই সভ্য জাতির ভাষা-সাহিত্য গ্রহণে-সৃজনে ঋদ্ধ হয়েছে। সেই আঙ্গিকে আমাদের বাংলা ভাষাও পিছিয়ে নেই। অনুবাদের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ, শ্রেষ্ঠ দার্শনিক চিন্তারাজি, বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী, সমাজতত্ত্ব ও মানবচিন্তার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো খুব সহজেই আয়ত্ব করতে পারছি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য শুদ্ধতম আক্ষরিক অনুবাদ কাম্য হলেও সাহিত্যের অনুবাদ শিল্পসম্মত হওয়া চাই, আক্ষরিক হলে চলে না। গান কিংবা কবিতার অনুবাদ তাই এক কষ্টকল্পিত ব্যাপারও বটে।
কথায় কথায় আমরা বলি অনুবাদ কবিতা। কবিতা কোন গদ্য রচনা বা প্রবন্ধ নয় যে আক্ষরিক অনুবাদে বুঝিয়ে লেখা যাবে। অনেক সময় নিজের ভাষায় রচিত অনেক কবিতাই আমরা বুঝতে পারি না। কবিতায় থাকে ভাব, ছন্দ আর লয় - যাকে আক্ষরিক অনুবাদ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা যায় না। যেকোন ‘ভাব’ ভাষান্তরিত হলে অনুদিত ভাবার্থের মাঝে কিছু না কিছু অন্তরায় থেকেই যায়। যেমন; আমাদের বাগধারায় প্রচলিত বাক্য এবং সমাজের রীতি-নীতি অপর ভাষা বা সংস্কৃতির সাথে পরিচিত নয় বিধায় ভাষান্তরের বর্ণীত আবহে কখনোই এর মূল রূপটি ভিনভাষী অনুবাদক যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। মূল সুরের অনুপস্থিতিতে অন্য কোন উপমা দিয়ে অনুবাদ করা গেলেও তাতে মূল ভাবের আদি রসে টান পড়বেই।
বিষয়ভিত্তিক সমস্ত অনুবাদের মধ্যে কবিতা এবং গানের অনুবাদ বেশি কঠিন। কেননা, কবিতা এবং গানে ভাবের প্রকাশটা ঘনীভূত; অল্প কথায় বেশি ভাবের প্রকাশ থাকে। গান বা কবিতা রূপক উপমায় বৈচিত্র্যময়। গান বা কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ অনেকাংশেই স্থান, কাল, পাত্র ও সমসাময়িক সমাজ নির্ভর। সুতরাং, কবিতার অনুবাদ কথাটা বোধহয় ঠিক না। তবে যোগ্য কবির হাতে কবিতার ভাবানুবাদ সম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো; যিনি ভাবানুবাদটি করছেন তিনি কবিতাটিকে কতটুকু আত্মস্ত করতে পেরেছেন, সেই কবিতাটি তিনি কতটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম?
সে যুগের ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার - আসল নাম ফ্রঁসোয়া-মারি আরুয়ে (১৬৯৪-১৭৭৮) কিন্তু কবি ছিলেন না। তবু তাঁর নথিপত্র ঘেটে এমন প্রণিধানযোগ্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ পঙ্ক্তি পাওয়া যায় যেখানে তিনি কবিতা সম্পর্কে খুব দামি কথা বলেছেন - "কবিতা অনুবাদ অসম্ভব কাজ, তুমি কি সঙ্গীত অনুবাদ করতে পারো"? এমন কি, রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো যারা মূল বাংলায় পড়েছেন তারা কেউই এর অনুবাদে সন্তুষ্ট হতে পারেন না - তা ইংরেজ কবি ইয়েটসই করুন বা অন্য কেউ। যেমন, রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ট উপন্যাসগুলোর অন্যতম 'ঘরে বাইরে' এর অনুবাদ সমালোচনায় ই. এম. ফারস্টার মন্তব্য করেছেন - "এর বিষয়বস্তু এত সুন্দর! কিন্তু অনুবাদে এর মনোহারিত্ব হারিয়ে গেছে, কিংবা অনুবাদের পরীক্ষাটা সফল হয়নি"।
অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে বিতর্ক আছে, ছিল চিরকালই। এর মূলে স্থান-কাল-পাত্র ছাড়াও ভাব এবং ভাষাগত কারণও রয়েছে। মূল সাহিত্য কর্মটি যে সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে কিংবা যে সামাজিক আবহে গড়ে উঠে অন্য ভাষায় রূপান্তরে সেই সমাজ কৃষ্টি বা সময়ের সাযুজ্যতা থাকে না তাই, এর হুবহু সৃজন কখনোই সম্ভব নয়। অন্য কোনো ভাষাভাষীর সাহিত্যের অনুবাদ যখন আমাদের কাছে আসে তখন সেই সমাজের ব্যক্তিমনের অনুভূতি ও মিথস্ক্রিয়াগুলো সন্দেহাতীতভাবে ধরা পড়ে না। আর যদি তা কোন অনুবাদের অনুবাদ হয়, তখন দ্বিতীয় অনুবাদকের জন্য কাজটা আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। অনুবাদক তখন বড়ই সঙ্কটে পড়েন।
উপর্যুক্ত সমস্যা সত্ত্বেও অনুবাদ কর্মটিকে এক সাহসী পদক্ষেপ হিসাবে গন্য করা যায়। অনুবাদের মাধ্যমে আমরা এখন হালের বৈশ্বিক চিন্তা, দর্শন বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে নিজের মাতৃভাষাতেই জানতে পারছি। এর সবই সম্ভব হচ্ছে অনুবাদকের চর্চার গুণে। একজন সার্থক অনুবাদক সাহিত্যকর্মের যত্নপ্রসূত অনুবাদ করেন এবং নিজ মাতৃভাষায় মূল রচনাটির অন্তর্নিহিত সারসত্তা নিংড়ে আনতে পারেন তিনিই পাঠককে সাহিত্য রসের আস্বাদন দিতে পারেন। সেই নিরিখে, কোন অনুবাদক কতটা সার্থক তা ভাববার অবকাশ থেকেই যায়।
অনুবাদকের চিত্তবৃত্তিক অবস্থা, মননশীলতা, পক্ষপাতহীন সুক্ষ্ম বিচার শক্তি এবং বাংলায় প্রকাশ শক্তির ক্ষমতা ইত্যাদিই হলো সার্থক অনুবাদের মূল অনুঘটক। তারপরও মোটা দাগে বলা যায়; কবিতার অনুবাদ নয় বরং ভাবানুবাদের জন্য কবির নিম্নোক্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ থাকা চাই -
এক - মূল কবিতার ভাষা সম্পর্কে অনুবাদকের স্বচ্ছ ধারণা ও সেই ভাষায় তার স্বচ্ছন্দ বিচরণের ক্ষমতা ও দক্ষতা।
দুই - সেই কবিতার ভাবটির নব্বই ভাগেরও বেশি অনুবাদক কবির আত্মস্ত হওয়া বা কবিতার গভীরে প্রবেশ করার দক্ষতা।
তিন - অনুবাদক কবির কাব্যিক বোধ ও মেধার সুউচ্চ প্রকাশের নিপুণ দক্ষতায় তাল লয় ও ছন্দের মেলবন্ধনে যেন মূল কবিতার সুরটি ঠিকঠাক অনুরণিত হয়।
অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে অতি সহজেই আমরা বিশ্ব-সাহিত্যের সাথে পরিচিত হতে পরছি। যথার্থ অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডার দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। যত বেশি অনুবাদ হবে আমাদের সাহিত্যও তত বেশি প্রাচুর্যময় হবে। সুতরাং, সাহিত্যপ্রেমী যোগ্য অনুবাদক আমাদের সামনে বিশ্ব-সাহিত্যের রত্ন ভাণ্ডারকে আরো উন্মোচন করে দিবেন; তেমনটিই প্রত্যাশা।