(প্রথম পর্ব)

বিষয়: আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব-২০২২  

কবি বন্ধুগণ, প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন। আশা করি করোনার দুবছরের ঝাপটা সামলিয়ে দয়াময় স্রষ্টার কৃপায় সবাই ভাল আছেন। নানান কারণেই দীর্ঘদিন আত্মগোপনে আছি। তবে  সময় এবং নেট সুবিধা থাকলে কবিতা পাতায় যাই এবং চোখ বুলিয়ে নীরবে চলে আসি। কোন পোস্ট দিই না। তাই কবিবন্ধুদের সাথে আলাপচারিতার সুযোগ হয় না।

শত কবিতা পড়ে আছে, নানান কারণে পাতায় পোস্ট দেয়া হয় না। গত আড়াই বছরে কবিতা পাতায় দু'টি ফরমায়েশী কবিতার পোস্ট দিয়েছি মাত্র। স্বভাবতই অনেকেই আমাকে চেনেন না আবার চেনা-জানা কবিগণ এখন আর কবিতা পাতায় খুব একটা আসেন না। কেউ কেউ এলেও দীর্ঘদিন না দেখার কারণে ভুলেই গেছেন হয়তো। আর এটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলা-কবিতার পুরনো দিনগুলো যেন ইতিমধ্যেই স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেছে।

এক সময় কবিতা পাতায় পোস্ট দেয়া ছাড়াও বাংলা-কবিতার প্রাণ 'আলোচনা' পাতায় লিখতাম। কবিবন্ধুদের সাথে লেখার ভাল-মন্দ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতো। কবিতার ভাষায় লিখা মন্তব্য প্রতি-মন্তব্যে নতুন নতুন যুগল কবিতার সৃষ্টি হতো। সেসব চয়ন করে ইতিমধ্যে আমার ৪ খণ্ড কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ৫ম খণ্ডটি প্রকাশের মুখেই এক দুর্ঘটনায় তা হারিয়ে যায়। দীর্ঘদিন সেসব মধুর অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত। অনেকদিন পর নতুন কিছু অভিজ্ঞতার কথা লিখতে বলা যায় বাধ্যই হচ্ছি। লেখাটি দীর্ঘ হওয়ায় পর পর দুই পর্বে পোস্ট দিচ্ছি।

ফেব্রুয়ারি ২০২০, ঢাকাস্থ আন্তর্জাতিক কবিতা সম্মেলনের পর করোনার কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে গেলে কবিদের গতিবিধিও কেমন যেন ঝিম ধরে যায়। প্রায় আড়াই বছর পর পশ্চিম বঙ্গের উদ্যমী আয়োজকবৃন্দ বাংলা-কবিতার ব্যানারে  'আন্তর্জাতিক' কবিতা উৎসব শিরোনামে কবিতা উৎসবের ঘোষণা দেন। যদিও অনুষ্ঠানটি এপ্রিল ২০২০-এ অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এবার ঘোষণা এলে সবার আগে নিজের অক্ষমতাটাই যেন আবিস্কার করলাম।

একেতো কভিড ভ্যাকসিন নিইনি তাই ভিসা প্রাপ্তির উপায় নেই। তার উপর ব্যক্তিগত কিছু অপ্রতিরুদ্ধ সমস্যা এড়িয়ে আমার যোগদানের কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তাই বারবার অনেকের আকুল আমন্ত্রণ সত্ত্বেও যোগদানের ঘোষণা দিইনি। নিজের সীমাবদ্ধতা বোঝাতে পারবো না বলে কিছুটা এড়িয়েও গেছি। আবার যোগদানেচ্ছু কবি বন্ধুদের কর্মকাণ্ড দেখে মন মানছিল না তাই তলে তলে প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। আয়োজক বন্ধুদের বলেছিলাম; আমার আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ তবে একান্তই কেউ না গেলে যেভাবেই হোক আমি হাজির হয়ে তাঁদের ঘোষিত 'আন্তর্জাতিক' কবিতা উৎসবের মর্যাদা রক্ষা করতে চেষ্টা করবো। তাই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কভিড ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট যোগাড় সহ ভিসা নিশ্চিত করে অপেক্ষা করছিলাম।

দেখলাম;  অনেক উৎসাহী কবিই বেশ আড়ম্বরে নাম লিখিয়ে অনুষ্ঠানে যোগদানের ব্যাপারে বেশ তোড়জোড় চালাচ্ছিলেন (শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে তা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আঁচ করতে পারছিলাম)। এমন কি আমার যোগদানের কোন সম্ভাবনা বা ঘোষণা না থাকা সত্ত্বেও অপরিচিত কোন কবি স্বপ্রণোদিত হয়ে পাতায় আরো অনেককে জড়িয়ে আমার উপস্থিতিও নিশ্চিত করে ফেলেছেন, সেসব পড়ে কেবল হতবাক ও বিব্রত হয়েছি!

ভাবছিলাম নিজের সীমাবদ্ধতা থাকায় একদিকে ভালই হলো; ২০১৯ এর মত সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে অর্গানাইজ করার ঝক্কি পোহাতে হবে না আর। যখন এত এত কবি যাচ্ছেন এবার আমি না গেলও ক্ষতি নেই। কিন্তু যতই দিন এগোচ্ছে হতাশার সাথে লক্ষ্য করেছিলাম; যোগদানেচ্ছুরা আস্তে আস্তে কেমন যেন নেতিয়ে যাচ্ছেন।

ফলশ্রুতিতে আয়োজক কবিদের পক্ষ থেকে বারবার  তাগিদ আসছিল; যে করেই হোক, যেন উপস্থিত থাকি। বুঝতে পারছিলাম; এপার বাংলার কবিদের যোগদানের অসার ঘোষণা এবং কারো কারোর নিস্ফল আশ্বাস আর কারোর নীরবতায় আয়োজকবৃন্দ শঙ্কিত হয়েছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কেউ না এলে কবিতা উৎসবটি ঘোষণা অনুযায়ী 'আন্তর্জাতিকতার' মর্যাদা হারাবে। অথচ ঘোষণা করা হয়ে গেছে- 'আন্তর্জাতিক' কবিতা উৎসবের!

হাস্যকর ও প্রহসনের মত বিষয় হলেও যোগদানেচ্ছু অতি উদ্যমী কবিদের কেউ আবার ভারতের অনুষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশনের জন্য বাংলাদেশী 'বিকাশ' একাউন্ট পর্যন্ত খোঁজ করছিলেন! এদের কাণ্ড দেখে আমি শেষ পরিণত আঁচ করতে পারছিলাম কারণ ইতিপূর্বে এজাতীয় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এদিকে বড়সড় তালিকার যোগদানেচ্ছু কবিবর্গের জন্য আয়োজকরা মোমেন্টো তৈরি, হোটেল বুক করা সহ খাবারের অর্ডার দেয়া ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করে বসে আছেন।

আমাদের কবিবন্ধুদের প্রস্তুতির ধরন ও কাণ্ডজ্ঞানহীন আস্ফালনে বুঝতে পারছিলাম; শেষ পর্যন্ত সবাই গল্পের সেই 'রাজার পুকুরে দুধ দেয়া'র মত কাণ্ড করে বসলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই (শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা ই)! তাতে অনুষ্ঠান থেমে থাকবে না, এপার বাংলা থেকে কেউ উপস্থিত না হলে আয়োজকরা বিব্রত হবেন মাত্র। পরবর্তীতে এজাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের আগে যে কেউ হয়তো দু'বার ভাববেন।

কেউ কি ভেবে দেখেছেন, আমাদের দায়িত্বজ্ঞান হীনতায় তাঁদেরকে আমরা কতবড় অসুবিধায় ফেললাম? ঘোষণাকারী বন্ধুরা একবার ভেবে দেখবেন - আপনি আয়োজক হলে এমন অবস্থায় আপনার কী হাল হতো? কেউ কেউ অবশ্য শেষ মুহূর্তে নানান অজুহাত দেখিয়ে নানাভাবে চক্ষুলজ্জার দায় সেরেছেন, কেউ আবার লজ্জা বিসর্জন দিয়ে তাঁদের ব্যাজ মমেন্টো ইত্যাদি চেয়ে পাঠিয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকরা সেসব তাদের পাঠিয়েছেনও কিন্তু কারোর কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন বা অন্যান্য খরচের টাকা না পেয়ে তাঁরা নিজেদের পকেট থেকে গচ্ছা দিয়েছেন। কবি হিসাবে এটা আমাদের জন্য কত লজ্জার- একবার ভাবুন তো!

এতসব নিরাশার মাঝে একটু আশা; শুনতে পাই কবি সরদার আরিফ উদ্দিন অনেকটা নীরবেই ভিসার চেষ্টা করছেন। জানতে পারলাম, নিজের দিক ম্যানেজ করতে পারলে তিনি যেতে পারেন তবে নিশ্চিত নন। এরমধ্যে শেষ পর্যন্ত কেউই যদি না যায় তো 'আন্তর্জাতিক' বিশেষণটাই না বৃথা হয়ে যায়! তাই আমি তাঁকে অনুপ্রাণীত করে নিজেও আসার ব্যাপারে জোর বাড়ালাম। আমার জোর পেয়ে তাঁর আগ্রহ আরো বাড়লো।

শেষ মুহূর্তে যখন বুঝলাম আর কারোরই যাবার সম্ভাবনা নেই তখন ব্যাক্তিগত সব সমস্যাকে জোর পূর্বক ঝেড়ে ফেলে মাত্র দুই দিনের প্রস্তুতিতেই কবি সরদার আরিফকে সাথে নিয়ে ট্রেনে টিকেট কেটে চলে আসলাম কলকাতায়। সেখান থেকে যেতে হবে দীঘা।

অনুষ্ঠানটি আদিতে স্থির হয়েছিল কোলকাতা থেকে প্রায় দুইশ কিলোমিটার দূরে সৈকত শহর দীঘাতে। অথচ শেষ মুহূর্তের জটিলতায় স্থান পরিবর্তন করে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহকুমা শহর কাঁথিতে নিয়ে আসা হয়। অতিথিদের আবাসন, খাওয়া-খাদ্য আর অনুষ্ঠানের্ ব্যবস্থা করা হয় একই ক্যাম্পাসে। তাই প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও আয়োজক বা যোগদানকারীদের কোন সমস্যা হয়নি। ছিমছাম পরিবেশে বেশ আয়েসের সাথেই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান চলা সহ বারবার রিফ্রেশমেন্টেরও বিশেষ সুবিধা পাওয়া গেছে।

আর এই অসাধ্য সাধনের অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন অনেক গুণে গুণান্বিত ও করিৎকর্মা কবি, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত 'মুজিব বলছে' কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা টগবগে নবীন ও তরুণ তুর্কি - কবি বিশ্বজিৎ শাসমল। তাকে সর্বতো সহযোগী করেছেন সর্বকবি চিত্তরঞ্জন সরকার, বিভূতি দাস, সৌমেন বন্দোপাধ্যায় প্রমুখসহ বিশ্বজিৎ শাসমলের এক ঝাঁক তরুণ ও নিবেদিত প্রাণ ভক্ত-বন্ধু। কবি বিশ্বজিতের ভাষায়; 'বিনাশ্রমের এই স্বেচ্ছাসেবী বন্ধু অনুচরদের সহযোগী না পেলে এ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না'। এই অবসরে আয়োজক বন্ধুদের পাশাপাশি আমি সেইসব সাহিত্যমোদি স্বেচ্ছাসেবী তরুণদেরকেও প্রাণের অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

অনেক প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে কবি বিশ্বজিৎ শাসমলের আন্তরিক নিষ্ঠা ও একরোখা জেদের কারণেই দীর্ঘ আড়াই বছরের অধিক কাল পর করোনার চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে বাংলা-কবিতার ব্যানারে আর একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হওয়ার সাফল্য যোগ হলো।

একেবারে হতাশ হবার মুখে আয়োজকবৃন্দ আমাদের পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন! কবি বিভূতি দাস সাথে কবি প্রণব লাল মজুমদার (সস্ত্রীক) রেলস্টেশনে পৌঁছে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করে আমাদের বরণ করলেন। অথচ তাঁরা আগের দিনই অনুষ্ঠান স্থলে চলে যাবার কথা। আমাদের সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই থেকে যান। পরদিন ভোরে আমাদের সাথে করে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যান এবং সকল প্রকার সুখ-সুবিধা নিশ্চিত করেন। তাঁদের এই আন্তরিকতা আর ত্যাগ স্বীকারের কথা ভুলবার নয় কিংবা শুধুই ধন্যবাদ জানিয়ে ঋণ শোধ করবার নয়।
(চলবে)