বিষয়: আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব-২০২২
যথাযথ পরিকল্পনায় স্বপ্ন দেখলে আর সেই স্বপ্নে বিভোর হলে স্বপ্ন সফল হয়, কখনো বৃথা যায় না। যেমন, আগের পর্বে বলেছিলাম; অনেক প্রতিকূলতা আর চ্যালেঞ্জের মুখে কবি বিশ্বজিৎ শাসমলের আন্তরিক নিষ্ঠা ও একরোখা জেদের কারণেই দীর্ঘ আড়াই বছরের অধিক কাল পর বাংলা-কবিতার ব্যানারে আর একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হওয়ার সাফল্য যোগ হয়েছে। বাংলা-কবিতার ইতিহাসে এটি এক মাইল ফলক বটে!
অনুষ্ঠানটি মূলত স্থির হয়েছিল কোলকাতা থেকে প্রায় দুইশ' কিলোমিটার দূরে সৈকত শহর দীঘাতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তের জটিলতায় স্থান পরিবর্তন করে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহকুমা শহর কাঁথিতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে একই ক্যাম্পাসে অতিথিদের আবাসন, খাওয়া-খাদ্য আর অনুষ্ঠানের সুচারু ব্যবস্থা করা হয়। তাই প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও আয়োজক বা যোগদানকারীদের কোন সমস্যা হয়নি। ছিমছাম পরিবেশে বেশ আয়েসের সাথেই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান চলায় বারবার রিফ্রেশমেন্টের সুবিধাও ছিল।
১৪ আগস্ট ২০২২ রবিবার সকালের নাস্তা পর্ব শেষে সকাল সাড়ে দশটায় 'লজ ইন্দ্রপুরি'-এর সম্মেলন কক্ষে প্রবীণ কবি চিত্তরঞ্জন সরকার মহোদয়ের সভাপতিত্বে যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হয়। কবি বিভূতি দাস ও কবি সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোমুগ্ধকর সঞ্চালনায় দিনব্যাপী অনুষ্ঠান এগিয়ে চলে। কবিতা পাতায় লেখালেখির সূত্রে কবিদের সাথে পরিচয় থাকলেও বাস্তবে চাক্ষুষ পরিচিতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চল থেকে আগত কবিবর্গকে পরিচয় পর্বের মাধ্যমে একে একে ফুল দিয়ে বরণ করলে সবাই আসন গ্রহণ করেন। সভাপতির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুরুতেই উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। সভার কার্যক্রম পরিচালনা করেন কবি সৌমেন বন্দোপাধ্যায় ও কবি বিভূতি দাস। নেপথ্যে সার্বিক তদারকি ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন কবি বিশ্বজিৎ শাসমল। এ পর্বে সম্মেলন উপলক্ষ্যে ‘বাংলা-কবিতা’র এডমিন - কবি পল্লব আশফাকের শুভেচ্ছা বক্তব্যের অডিও ভাষণের ধারাবাহিকতায় কবি কবীর হুমায়ূন (এডমিন-৩) এর অডিও বক্তব্যও শোনানো হয়।
বাংলা ভাষায় রচিত কবিতার চর্চা ও আমাদের এই ‘বাংলা-কবিতার আসর’ নিয়ে সাহিত্য বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন যথাক্রমে কবি যাদব চৌধুরী, কবি অরূপ গোস্বামী, কবি সরদার আরিফ উদ্দিন, কবি বিভূতি দাস, কবি বিকাশ দাস, এবং আমি অনিরুদ্ধ বুলবুল। নিম্নবর্ণিত আলোচকদের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অনুষ্ঠান এগিয়ে চলে
কবি যাদব চৌধুরীর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল; বাংলা কাব্যে কীভাবে আধুনিকতার আগমন ঘটে আর কীভাবে তা নিরূপিত হয়? সে বিষয়ে তিনি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেন। কবি বিকাশ দাশ তাঁর স্বকীয় ধারায় বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। কবি অরূপ গোস্বামী স্বভাবসুলভ সুন্দর বাচন-শৈলীতে বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় রচিত কবিতার উপর মনোজ্ঞ আলোচনা করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহিত্যের ভূমিকা এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য কীর্তি নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেন কবি বিভূতি দাস। বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রসূত বক্তব্যে কবি সর্দার আরিফ উদ্দিন তাঁর কবিতা পাঠের প্রতি আসক্তি এবং ‘বাংলা-কবিতা’য় আগমনের প্রেক্ষাপট বর্ণনাসহ কীভাবে আলোচনা পাতার প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠেন সে বিষয়টিও মনোগ্রাহীভাবে তুলে ধরেন। বাংলা-কবিতার বাইরের বেশ ক'জন অতিথি কবিও অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। আসরের কবিবর্গের সাথে তাঁরাও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন।
সবশেষে ‘বাংলা-কবিতা’ ওয়েব পোর্টালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা সহ এখানকার কবি, কবিতা ও আলোচনা বিষয়ক নানান তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়ে আমিও কিছু বলার প্রয়াস পাই। ‘বাংলা-কবিতা’র অগ্রগতি ও এর ভাল-মন্দ সুবিধাদি নিয়ে আলোচনা করি এবং আমার বক্তব্য ও মতামত নিম্নরূপ নিবন্ধ আকারে পাঠ করি।
সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গনে বিচরিত কথা-সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে কেন যে বিশেষ অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়নি, তা আমার মাথায় আসে না। তবু তাঁর গানের ভাষায় -‘এবার নিজের কথা বলি, নিজের কথা বলতে বলতে নাও দৌড়াইয়া চলি' অর্থাৎ নিজের ঢোল একটু পিটাচ্ছি। বন্ধুরা, এ বাহুল্যতাকে ক্ষমা করবেন আশা করি।
একেতো গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না তার উপর ডায়াসে বক্তব্য দিতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করি না, বলা যায় এড়িয়েই চলি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আগত হিসাবে কিছু না-বলে রেহাই নেই তাই মনের কথা লিখিত বক্তব্যে পেশ করছি:
উপস্থিত কবি বন্ধুগণ, কবি না হয়েও ‘বাংলা-কবিতা’য় একটু আধটু ভাব প্রকাশের সুবাদে কখন যেন কবির তকমা ধারণ করে বসে আছি ! তাই আজ কবিমহলে কিছু বলতে গিয়ে নিজের অক্ষমতা আর প্রকাশের সীমাবদ্ধতা টের পাচ্ছি বেশ। যদিও আমি ভীত এবং কুণ্ঠিত তবু আপনাদের ভালোবাসার প্রশ্রয়ে দু’টি কথা বলতেই হচ্ছে।
কবিতা নিয়ে কিছু বলতে হলে বলবো; কাব্যিকতা এক বিশেষ ধরনের আর্ট বা শিল্প - যা অদৃশ্য এবং অস্পৃশ্য কাঁচামালে রচিত হয়ে থাকে। আর যিনি কবিতা লিখেন তাঁকে কবি বলা হয়। আমিও আবেগবশত কখনো কবিতার মত কিছু লিখে ফেলি বটে! আদৌ সেগুলো কবিতা কি না জানি না। নিজের লেখা অপর কাউকে দিয়ে পড়াতে কিংবা পড়ে শুনিয়ে বাহবা পেতে কবিকুল আদিকাল থেকেই পছন্দ করেন আর ঐতিহ্যগত ভাবেই তা হয়েও আসছে। সহজে কাউকে দিয়ে পড়ানোর সুযোগ থাকায় আমিও নিজের লেখা দু'একটা লাইন মাঝে মাঝেই কবিমহলে ছুঁড়ে দিই আর ঐতিহ্যগত ভাবেই কবিবর্গের কেউ কেউ সেটি পড়ে অথবা না পড়ে আমাকে উৎসাহিত করতেই হয়তো বাহবাও দিয়ে থাকেন।
শখের বশে শৌখিন কবিদের আসরে নাম লিখিয়েছি বলেই কবিবর্গ সম্মান দেখাতে নামের সাথে 'কবি' শব্দটি জুড়ে দেন। বস্তুত আমি নিজেকে কখনোই কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নই। কেননা, আমি বিশ্বাস করি; তিনিই একজন কবি যিনি যাপনে ও অন্তঃকরণে সর্বাবস্থায় - অপাঙ্গে কাব্যিকতাকে ধারন করতে পারেন এবং লালন করতে জানেন। যিনি হবেন উদার ও অপেক্ষাকৃত কলুষমুক্ত। যেহেতু ওসব গুণাবলীর তেমন কিছুই ধারন করতে পারি না, স্বভাবতই নিজেকে আমি কবি স্বীকৃতি দিয়ে প্রকৃত কবিদের অসম্মান করার স্পর্ধাটি দেখাতে চাই না।
যেহেতু, দোষে-গুণেই মানুষ আর মানুষ মাত্রেই স্খলন-পতন কিছু না কিছু থাকবেই। কবিকুল যেমন এর ব্যতিক্রম নন, আমিও নই। কবিও তো মানুষ, তাঁরও আছে সুখ-দুঃখ, কাম-ক্রোধ, ভাল-মন্দ মিলিয়ে স্বার্থ জড়িত জীবন সংগ্রাম ! কবি হলেই 'সকল ত্রুটির ঊর্ধ্বে' থাকবেন এমনটি বলা যাবে না। তবে স্খলন-পতনের পরিমাণ যত কম হবে একজন কবি অথবা শিল্পীর আদর্শিক অবস্থান ও ভাবধারা হবে তত উন্নত, তত শীলিত আর তিনি হবেন তত বেশি পরিশুদ্ধ।
‘বাংলা কবিতা আসরে’র কবি ও কবিতা নিয়ে এখন আমার কিছু পর্যবেক্ষণ পেশ করছি:
আমার জানা মতে; কবি এবং কবিতার সংখ্যার বিচারে 'বাংলা-কবিতা' ওয়েব পোর্টালটি এমন এক বৃহৎ কবিতাচর্চার জগৎ যেখানে বর্তমানে রয়েছেন প্রায় ষোল হাজারের কাছাকাছি নিবন্ধিত সদস্য তারমধ্যে ১৩ শ'র মত কবি অর্থাৎ ৮% কবি মাত্র নিয়মিত কবিতার পোস্ট দিয়ে থাকেন। আর এ যাবৎ প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৮৬ হাজারের মত হলেও কবিতা বিষয়ক আলোচনা মাত্র ৬ হাজারের কাছাকাছি অর্থাৎ প্রায় ১.৫%। তারমধ্যে অধিকাংশই কবিতা প্রাসঙ্গিক নয় বিধায় ব্যানকৃত। স্মর্তব্য, সাত্যিকারের কবিতা তথা সাহিত্য বিষয়ক আলোচনার সংখ্যা বড়জোর হাজার দুই। অর্থাৎ মোট আলোচনার অনুপাতে প্রায় ৩০% যা কবিতা পোস্টের অনুপাতে মাত্র ০.৫%। সাহিত্যের জন্যে এই পরিসংখ্যানটি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
পাশাপাশি আরো লক্ষণীয় যে; একটি কবিতা (যত ভাল কিংবা মন্দই হোক না কেন) যে পরিমান পাঠকের হিট দেখতে পাওয়া যায়, আলোচনার ক্ষেত্রে (বিশেষ বিষয়ক আলোচনার পোস্ট না-হলে) তা এতই নগণ্য যে কেউ সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা লিখতে চাইলেও আগ্রহ বোধ করেন না। কবিতা তথা সাহিত্যের জন্যে এটা এক অশনি সংকেত। আমি মনে করি আমাদের কবিবর্গ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন এবং সত্যিকার অর্থে কবিতাকে ভালোবাসে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজবেন।
আমি মনে করি, 'বাংলা-কবিতা'র আলোচনা পাতাটির পাঠক যত বাড়বে, লেখক সংখ্যারও ততই উত্তোরণ ঘটবে। আর আলোচনা পাতায় যত বেশি লেখা ও পাঠক আসবে এই আসরের কবিগণও ততই কাব্যমান সমৃদ্ধ হবেন। সৌখিন কবিতার আসরে আমরা ‘জিরো’ থেকে শুরু করেছি বটে রবীন্দ্র নজরুল না হই বা ‘হিরো’ না হতে পারি, কবিতাকে যেন অন্তত মনে প্রাণে ও জীবনে ধারণ করতে পারি। তাতে জীবন শীলিত হবে, বোধ-চেতনার সমৃদ্ধি ঘটবে। নিশ্চয়ই এখানে হারাবার কিছু নেইই, পাওয়ার আছে অনেক কিছুই।
লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্যে সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও ভালবাসা জানাই।