কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর জমিদারীর কাজে পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে অবস্থান করার সময় ‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতাটি রচনা করেন। কুষ্টিয়ার বাউল শিল্পী গগন হরকরা (বাউল গগনচন্দ্র দাস)-এর ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরের অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই গানটির সুর করেন।
১৯০৫ সালে ‘সঞ্জীবনী’ ও ‘বঙ্গ দর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শিল্পী গোপালচন্দ্র সেনের কণ্ঠে গানটি প্রথম রেকর্ড করা হয় এবং ১৯০৫ সালের ০৭ আগস্ট কোলকাতায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী একটি সমাবেশে প্রথম এই গানটি গীত হয়। গানটি ’গীতবিতান’ গ্রন্থের স্বদেশ অংশে অন্তর্ভূক্ত।
সংগ্রামী চেতনা ও উজ্জীবনী শক্তি হিসাবে কবিতাটির প্রভাব অপরিসীম। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আদর্শগত চেতনা হতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান হিসাবে এই কবিতাটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান ১৯৭০ সালে তাঁর নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটির ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালের ০৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীনবাংলা সংগ্রাম পরিষদে’র ইশতিহারে গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ঐতিহাসিক ০৭ মার্চের ভাষণের প্রাক্কালেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। একই বছর ২৩ মার্চ ‘স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি গীত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত মর্যাদা দিয়ে গাওয়া হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায় গানটির বর্তমান প্রচলিত যন্ত্রসুরটি করেন। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে পাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
স্বাধীনতার পর সাংবিধানিকভাবে (অনুচ্ছেদ ৪.১) গানটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রূপে ঘোষিত হয়। গানটির মোট চরণ সংখ্যা পঁচিশটি হলেও প্রথম দশ ছত্র কণ্ঠসঙ্গীত হিসাবে এবং প্রথম চার ছত্র যন্ত্রসঙ্গীত হিসাবে ও সামরিক বাহিনীতে পরিবেশনের বিধান রাখা হয়।
২০০৬ সালে বিবিসি’র শ্রোতা জরিপে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা গান’হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেয়া ২০৫টি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে তুলনামূলক বিচারে (দৈনিক গিার্ডিয়ান পত্রিকার মতে) বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত দ্বিতীয় বলে বিবেচিত হয় (প্রথম হয়েছিল উরুগুয়ের জাতীয় সঙ্গীত)।
২০১৩ সালে ৪৩তম বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ২৭ হাজার ১১৭ জনের অংশগ্রহণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব পতাকা গড়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। আবার ৪৪তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে ২৬ মার্চ ২০১৪, স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক গণনা অনুসারে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জনের অংশগ্রহণে লাখো কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...' গানটি গেয়ে আরেকবার গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ৷ স্মর্তব্য, স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক গণনার বাইরেও লক্ষ লক্ষ লোক এত অংশ নেয়।
(সূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া এবং সচলায়তন ব্লগপোস্টের ‘সবুজ পাহাড়ের রাজা’র পোস্ট থেকে)