'মায়ের ছোঁয়া' শির্ষক কবিতায় কারুকার কবি শাহানারা রশিদ গ্রাম বাংলার চিরন্তনী রূপের মাঝে বেড়ে উঠা শৈষবের স্মৃতিঘন চিত্রটি নিখুঁত আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন! সুন্দর এক সরেস রচনার জন্য রচয়িতা কবিকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।

আগে যা ও মাঝে মাঝে দুএকটি আলোচনা লিখতাম নানান ব্যস্ততায় এখন আর পারি না। কিন্তু এই কবিতাটি স্মৃতির জমিনে এক পশলা সরস বৃষ্টির মতই ভাবালুতায় টেনে নিয়ে গেল আমাকে অর্ধ শতাব্দী পেছনের ছেলেবেলায়। সেই সূত্রেই এই কবিতা নিয়ে নিজের অভিব্যক্তি হালের কবিদের সাথে শেয়ার না করে পারছি না। তাই যথেষ্ট ব্যস্ততা সত্ত্বেও অনেকদিন পর লিখতে বসলাম।

কবি যখন বলেন -
"শীতের পিঠা শিকেয় রেখে মা যখনি ডাকে  
স্মৃতিকাতর হৃদয় তখন বন্দি কি হায় থাকে?'

স্মৃতিকাতর মন তখন সত্যিই ছুটে যায় হারানো অতীতের ধূসর আঙ্গিনায়। সত্যিই তো; বাংলার সবখানেই যেন 'মায়ের-ছোঁয়া'র পরশ রয়েছে। তবে অধুনা সভ্যতার নগরায়ন তার অনেক কিছুকেই মুছে দিচ্ছে। গ্রাম বাংলায় এখন আর তেমন ঝোপ-ঝাড় চোখে পড়ে না। ঝোপ-ঝাড়ে অযত্নে ফলে থাকা নানান বুনোফল তো শেষই হয়ে গেছে। তবু সেকালের স্মৃতিধারী কবির কবিতায় বেথুল ফলের কথায় স্মৃতির সুতো ধরে মন আমার হারিয়ে গেছে কৈশোরের সেই ছায়াঘেরা কুঞ্জ বনে। আর সেইসূত্রে অনেকদিন পর ভীষণ ব্যস্ততা সত্ত্বেও কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি।

কবির কবিতায় বেথুল ফলের প্রয়োগকে অনেকেই না-বোঝে কঠিন বা অর্থহীন ভাবতে পারেন। বস্তুত বেথুল মানে বেতফল: অঞ্চলভেদে যাকে বেত্থুল, বেন্তুল, বেত্তুন, বেথুন, বেথুল, বেতগুলা, বেতগুটি, বেত্তুইন ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। তেল চিকচিকে কাঁটাযুক্ত চিরল পাতার খুবই শক্ত সেই বেতস বা বেতগাছ লম্বা, সরু ও কাঁটাময়। জঙ্গলাকীর্ণ কাঁটাঝোপ আকারে খাল বিল পুকুর ডোবার পাড়ে সেঁতসেঁতে ভেজা মাটিতে আপনিই জন্মায়। বেতগাছ বা বেতস আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়াও এতদঞ্চলের বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, লাওস, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাভা, সুমাত্রার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে খুব দেখতে পাওয়া যায়।

এই বেথুল বা বেতফল বেতের ঝোপে থোকায় থোকায় ধরা লম্বাটে ও গোলাকৃতির (আঙ্গুর আকৃতির অথচ আঁইসযুক্ত) ছোট এবং কষযুক্ত টক-মিষ্টি ফল। এর খোসা শক্ত, ভেতরে নরম শাঁস ও গভীরে শক্ত বীচি থাকে। কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পাকলে সবুজাভ ঘিয়ে রঙের হয়। বেশিদিন আগের কথা নয়, মাত্র পঞ্চাশ ষাট বছর আগের কথা। সেই যুগে গাছে গাছে পাকা গাবফল, বকুল ফল, বুবি, বেথুল, লটকন, বুনো ডমুর ইত্যাদি একসময় গ্রাম বাংলার ছেলেমেয়েদের কাছে খুবই আমুদের বিষয় ও প্রিয় খাবার ছিল। আজ এর সবই প্রায় হারিয়ে গেছে।

আর মা-চাচি, বোন খালা ফুপুদের হাতে তৈরি পিঠা-পুলির বিচিত্রসব খাবার দাবার এবং পাটের শিকে, বাঁশ-বেতের তৈরি নানান গৃহস্থালী সামগ্রীসহ নকশীকাঁথা, সতরঞ্জি, রুমাল, দস্তরখানা, জায়নামাজ বা বালিশের আস্তরে আর কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই কাপড়ে রঙিন সুতায় বোনা ফুলের কারুকাজ ইত্যাদি কেবলই এখন সেকালের গল্প বিশেষ। সেই-সাথে গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্রময় খেলাগুলোও যেমন; পুতুলখেলা, লাঠিখেলা, লুডু, বাঘবন্দী, চিঁ-কুতকুত, বউচি, কানামাছি, হাডুডু, কবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা... কালের আবর্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

চমৎকার এই স্মৃতি জাগানিয়া সুন্দর চিত্রাঙ্কনের জন্য প্রিয় কবিকে আরো ধন্যবাদ জানাই। ভবিষ্যতেও এমনি আরো সব সুন্দর কবিতা উপহার পাবো তেমন প্রত্যাশাই রইল।