বয়সে তরুণ জামালপুরের কবি কামরুল ফারুকির জন্ম ১৯৮৯। পেশায় একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। বাংলা-কবিতায় আছেন ৮ বছর ১০ মাস। উক্ত সময়কালের মধ্যে সংখ্যার বিচারে তাঁর পোস্টকৃত কবিতার সংখ্যা বেশ কম - মাত্র ১৫০টি তবে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন বেশ। তাঁর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা আছে পাতায়। আজ তাঁর সাম্প্রতিক কবিতা 'দীর্ঘশ্বাসের সমান' নিয়ে আলোচনা করছি। পাঠকের সুবিধার্থে মূল কবিতাটি তুলে দিচ্ছি -
"দীর্ঘশ্বাসের সমান"
দীর্ঘশ্বাসের সমান আয়ু নিয়ে ঢুকে পড়েছি আহ্নিক গতির আবর্তে।পথ চলতে চলতে ভেবেছি মানুষ তার ছায়ার সমান অবয়ব,আলোর পরিভ্রমণে অবশেষে দেখেছি উর্ধ্ব-পতন।
ফড়িঙের লেজ ধরতে ধরতে বালককে কখনও যেতে হয় ডাইনোসরের টেবিলে।পরিপাকতন্ত্র শেখার আগেই শরীর থেকে বেরোয় তরলীকৃত গন্ধ।
তিলে ফোটা নারীও হতে পারে অন্ধ ও প্রতারক।সমস্ত পাহাড় বহন করে তেলহীন চোখ-পাপড়ির মত নীলামে উঠতে পারে হাতঘড়ি।
কবিও কি শিকারী নয়?জলে ভেজা কালো চোখেই হতে পারে জাহাজডুবি।
সে স্বপ্ন প্রত্যাগত। হৃদয় তো দূরবর্তী ব্যাপার এখনও খাতায় জমেনি একটুকরো কবরের মাটি।
এবার আলোচনা:
অনেক ভাবের সমাবেশে রচিত কবিতাটি খুব বড় না হলেও ঠিকমতো পড়তে হলে অনেক সময় কাড়ে। আর ভাবতে গেলে তো অতলান্তে হারিয়ে যেতে হয়। দুর্বোধ্য না হলেও বেশ দুরূহ ভাবের কবিতাটি পাঠ করে বোঝার সাধ্য আমার নেই তবে ভাববার মতো দু'টি বাক্য মনে ধরেছে। কবিতাটি থেকে দু'টি মাত্র বাক্যাংশ আলোচনার জন্যে চয়ন করেছি।নিজের ভাবনামতো বোঝার চেষ্টা করেছি। আপাতত তাই নিয়ে আলোচনা করছি:
১) "দীর্ঘশ্বাসের সমান আয়ু নিয়ে ঢুকে পড়েছি আহ্নিক গতির আবর্তে":
* জাগতিক সময় পরিমাপে আহ্নিক গতির দৈর্ঘ্য ২৪ ঘন্টা বা ৮৬,৪০০ সেকেন্ড। আরো সূক্ষ্ম পরিমাপে হিসাব করলে নগণ্য সেকেন্ড বেশি। অন্যদিকে একটা দীর্ঘশ্বাসের দৈর্ঘ্য সেকেন্ড যোগ কিছু পল মাত্র। পার্থিব হিসাবে একটা আয়ু যদি হয় সেই 'দীর্ঘশ্বাসের সমান' তাহলে এক পার্থিব দিবসের দৈর্ঘ্যের সাথে একটা দীর্ঘশ্বাসের অনুপাত দাঁড়ায় কম-বেশি ১ঃ৮৬,৪০০। এবার যদি তুলনা করা হয় এক পার্থিব বছরের সাথে? অনুপাত হবে ১ঃ৩,১৫,৫৭,৬০০।
অর্থাৎ পার্থিব বছরের বিপরীতে এক দীর্ঘশ্বাস প্রলম্বিত আয়ুর দৈর্ঘ্য ৩,১৫,৫৭,৬০০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র! এই আয়ু তথা সময়টা কিন্তু মহাকালের কাছে এক ক্ষুদ্রতম নগণ্য অংশ। এই সময়টা যত তুচ্ছতমই হোক তা কালেরই অংশ! 'দীর্ঘশ্বাসের সমান' জীবনটা মানুষের বিবেচনায় তুচ্ছ হলেও গণ্য, কিন্তু কালের কাছে তা অতি অতি অতি নগণ্য থেকে আরো নগণ্যতর নয় কি?
এখন প্রশ্ন - এই 'দীর্ঘশ্বাসের সমান' জীবন এতো নগণ্য যে, তাকে জীবনই বলা যায় না! তাহলে আগামী মহাকাল তথা যে সময় এখনো বর্তমানের সামনে রয়েছে তার কাছে আমাদের এই ৭৩ বছর গড়আয়ুর জীবনের হিসাবটি কি উপরোক্ত হিসাবের চেয়ে বেশি কিছু? আর মহাকালের তুলনায় ক্ষুদ্রতম সেই জীবন নিয়ে আমাদের কত তোলপাড় কত আয়োজন!!!
ভাববার মতো আরো কত বিষয়ই না রয়েছে এই কথা ক'টির আড়ালে! এই আলোচনাকে আরো সামনে নেয়া যেতো কিন্তু আর না ই গেলাম সেদিকে। কবিতার মতোই প্রচ্ছন্নে ঢাকা থাক!
২) "জলে ভেজা কালো চোখেই হতে পারে জাহাজডুবি":
* বাক্যাংশটি এমন এক রূপক যা কল্পনায় বহুদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় তবে আপাতত একে প্রেমের আবহে ভেবে দেখি। জলে ভেজা কালো চোখ - অনায়াসে সরোবর থেকে নদী সিন্ধু অথবা সাগরের সাথে তুলনাযোগ্য! আর যদি আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগর ভাবতে পারি তাহলে সেই চোখে মহাসাগরের সম্ভাব্য সবকিছুই তো ভাবা যায়! মহাসাগরের নীল জলের কালো বুকে কত কী দুর্ঘটনাই তো ঘটে চলেছে প্রতিরোজ! যার সবই সাধারণের অজানা আর দৃষ্টিসীমার আড়ালে থেকে যাচ্ছে! একমাত্র জাহাজডুবি হলেই (অধুনা প্রযুক্তির কল্যাণে) মানুষ তার খণ্ডিত অংশ জানতে পারে। তাহলে জলে ভেজা কালো চোখের ওই মহাসাগরেও তো প্রতিরোজ ঘটছে কত প্রেমের জাহাজডুবির মতো ঘটনা কিংবা আরো কত ঘটন-অঘটন...! তার ক'টির খবরই বা মানুষ জানে? সে খবরও তো মনুষ্য দৃষ্টিসীমার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে!
এছাড়া, আরো বেশ কিছু বাক্যাংশ বা শব্দগুচ্ছ কবিতাকে দিয়েছে ভাবনার সমূহ খোরাক যেমন; 'আলোর পরিভ্রমণে... উর্ধ্ব-পতন'।' আহা, 'উর্ধ্ব-পতন'; কী দারুণ উৎপ্রেক্ষা! 'তিলে ফোটা নারীও হতে পারে অন্ধ ও প্রতারক'। 'তিলে ফোটা নারী'কে আমার মনে হয়েছে; মুখশ্রীর রমণীয়তা বর্ধনে একটি কালো তিলও হতে পারে সৌন্দর্য্য সুষমায় অনন্যতার তুচ্ছ অথচ উৎকৃষ্ট অনুষঙ্গ। হতে পারে সেই নারী নিরেট এক 'অন্ধ প্রতারক' কিংবা হৃদয়ের ব্যাপারটাও হয়তো সেখানে একেবারেই গৌণ। তাই কবি বলেছেন; 'হৃদয় তো দূরবর্তী ব্যাপার'...
অন্য পাঠকের প্রতিক্রিয়া ভিন্নতর হবে - এটাই স্বাভাবিক, এটাই বিমূর্ত কবিতার বিশেষত্ব। ভাবনার পুষ্ট বীজ সমৃদ্ধ শব্দের প্রয়োগ আর রূপক উপমার প্রসারমান দৃশ্যকল্পের নান্দনিক ব্যবহারই কবিতাকে করে তোলে গরিয়সী ও আকর্ষক। আমার বিবেচনায় কবিতাটি সেসব শর্ত পূরণ করেছে।
ভালোর পাশে যেমন মন্দের অবস্থান আর আলোর পাশে অন্ধকার - এই কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অন্ধকার এই আলোচনার পদবাচ্য নয়। মুক্ত গদ্যের ফর্মে লেখা কবিতাটি পড়ে সমঝদার ও ধৈর্যশীল পাঠক ভাবনার খোরাক পাবেন তবে 'উপভোগের নিমিত্তে কবিতা পাঠকারী' পাঠক ততটা উপভোগ করতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। এও সত্য; সব কবিতা সবার কাছে সমানভাবে উপভোগ্য বা সমাদৃত হয় না। এ জাতীয় বিমূর্ত কবিতার গভীরতা নির্ণয় কিংবা ভাবের সুবোধ্যকরণ সত্যি এক দুরূহ কর্ম বটে।
বানান মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। 'ঊর্ধ্ব' এবং 'নিলাম' (উচ্চমূল্য ধার্য করণার্থে দাম উন্মুক্ত করা) বানান দু'টি ছাড়া তেমন কোন ভুল চোখে পড়ছে না। তবে কবিতায় যতিচিহ্ন প্রয়োগে টাইপো সমস্যা রয়েছে। এছাড়া তেমন কোন বিশেষ ত্রুটি চিহ্নিত করতে পারছি না।
কবিকে আন্তরিক অভিনন্দন!