পৃথিবীর সকল জাতি-গোষ্ঠীর প্রায় প্রতিটি সমাজেই আলাদা আলাদা কিছু মূল্যবোধ ধারণ করে ও লালন করে থাকে। আমাদের রক্ষণশীল এই সমাজেও কিছু মূল্যবোধের চর্চা হয় অথবা আমরা সামাজিক প্রয়োজনে, পারিবারিক সৌষ্ঠব রক্ষার খাতিরে এবং নিজেদের স্বার্থে সেই মূল্যবোধগুলোকে ধারণ ও লালন করে থাকি। এটাই কৃষ্টি, এটাই সামাজিক রেওয়াজ।
কেউ কেউ যখন শিল্প-সাহিত্যের উন্মুক্ত বিকাশের লক্ষ্যে সেই মূল্যবোধগুলোর আড়াল-আব্রু খসিয়ে নগ্ন করে উপস্থাপন করেন তখনই তাকে অশ্লীলতার তকমা দিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সে বিতর্ক যেন আর ফুরাতে চায় না - এর পক্ষে বিপক্ষে মতামত/বাহাস চলতেই থাকে। এতে সাহিত্যের ক্ষতি বৈ উপকার কিছু হয় না। শৃঙ্খলার স্বার্থে তাই কবিতা পাতায় কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
কবি ইমামুল ইসলাম মুরাদ তাঁর 'বিষাক্ত চুম্বন' কবিতায় শিল্পসজ্জাত ভাষাসুষমার কারুকার্যে মুড়িয়ে মানবজীনের সেই আদিরসের অধিরূপটি সুনিপুণভাবে শ্রবণসহিষ্ণু ভাষায় চমৎকারভাবে উপস্থাপন করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। যা নিয়ে দু'কথা লেখার লোভ আমি সম্বরণ করতে পারিনি। সুলেখক প্রবুদ্ধ কবিকে হার্দিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।
৩০ বছর বয়েসী এই কবির জন্ম হাওরের দেশ তথা শাহ্ আব্দুল করিমের জন্মপীঠ সুনামগঞ্জে। বাংলা-কবিতায় নিবন্ধিত হয়েছেন মাত্র ৮ মাস। এ পর্যন্ত তিনি ৭৯টি কবিতার পোস্ট দিয়েছেন। "নীলোৎপল" নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের তথ্যও পাওয়া গেছে। নবীন এই কবির সাথে আজ এই কবিতার মাধ্যমেই পরিচয়। গতকাল প্রথমবারের মতো তাঁর এই একটিই মাত্র কবিতা পড়েছি। শত ব্যস্ততায়ও কবিতাটির ভাব-বক্তব্যের আবেদন আমাকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ দেয়নি। এ কবিতার মন্তব্য বা ব্যাখা যখন-তখন করা যায় না। তাই এই গভীর রাতে বসে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। বলা যায়; আমার কাব্যবোধের দায় শোধ করছি।
একজন দক্ষ শিল্পী বা কবি যদি মানবজীবনের আদিরসের অধিরূপের শাশ্বত কাহিনীচিত্রটিকে সুনিপুণ উপস্থাপনায় মনোগ্রাহী এবং শ্রবণসহিষ্ণু করে পরিবেশন করতে পারেন। তখন সেখানে আর শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্নে কোন বিতর্কের অবকাশ থাকে না। আমার মনে হয়েছে কবি যেন সেই কাজটি সুচারুরূপে করে দেখিয়েছেন। পাঠকের অনুধাবনের স্বার্থে কবির কবিতাটি এখানে তুলে ধরছি:
"বিষাক্ত চুম্বন"
"আমাকে যদি কেউ বলে,- কাল সর্পিণীর ছোবল খেতে?
আমি সহাস্য বদনে এককোটি বার খেতে পারবো!
নীলপদ্মের মতো যদি সমস্ত শরীর বিষে প্রগাঢ় নীল হয়ে যায়;
সে বিষ শরীরে ধারণ করে পরম সুখে বেঁচে থাকতে পারবো।
মহানন্দা, তবুও তোমার চুম্বন খেতে পারবো না!
সর্পিণীর দন্তাঘাতের চেয়েও অত্যুগ্র বিষাক্ত
তোমার এক-একটি চুম্বন,
ত্বরিত গতিতে হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চারিত হয়
তীগ্ম-বিষ-ক্রিয়া;
আমি ছটফট করতে থাকি অসহ্য মরণ যন্ত্রনায়;
চিৎকার দিতে-দিতে দেখি,তোমার বহুরূপী কাঁকলাস রূপ!!"
আমার সীমিত বোধে কবিতাটির যেটুকু পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি তা ই পাঠকের সাথে শেয়ার করছি:
দেহ-মন তোলপাড় করা (মহা আনন্দের সেই 'মহানন্দা') গোপন প্রিয়ার এক-একটি চুম্বন যেন বিষাক্ত নাগিনীর দংশনের চেয়েও প্রলয়ঙ্করী যা; হৃদয়ের প্রতিটি রন্ধ্রে ত্বরিদ্গতিতে সঞ্চারিত হয়ে এর সুতীব্র বিষ-ক্রিয়ায় প্রাণে-মনে কামনার ঝড় তোলে। সে যে কী এক সংক্রামক ব্যাধি; দংশিত ব্যক্তিকে উন্মত্ত করে আর ক্ষণে ক্ষণে রঙ-বদলানো সেই গিরগিটি রূপ মানবী-রত্নটির কলা-চাতুর্য পরিদর্শনে আক্রান্ত ব্যক্তি এক অসহ্য মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। সেই চুম্বন যে কী এক প্রলয়ঙ্করী নেশা-বিষ - একমাত্র সে ই বোঝে যে কখনো সেই মহানন্দার চুম্বনের স্বাদ পেয়েছে!!
এ যন্ত্রণার কোন তুলনা না হয় না, এমন সুখ-যন্ত্রণার আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই কারোরই জীবনে। ওফ্ কবি, কী দুর্দান্ত শব্দ কারিশমায় জীবনের একমাত্র সুখ-যন্ত্রণার অমীয় সুধাটি কবিতার ভাষায় বপন করে গেলেন! তা জৈবিক চাহিদাসম্পন্ন কোন প্রেমিক কখনোই ভুলবে না।
কিছুটা রূপকের আড়ালে প্রাঞ্জল ভাষাশৈলীর শিল্পীত আকর আমাকে কবিতাটি এভাবে অনুভব করতে প্রলুব্ধ করেছে। আমার অনুভব অন্য কারোর সাথে না ও মিলতে পারে। ক্ষতি নেই তাতে। কারণ একই কবিতাকে ভিন্ন পাঠক ভিন্ন দৃষ্টিতে গ্রহণ করতেই পারেন। পদ্য-ছড়া এসব বোঝা যায়, বুঝতে হয় কিন্তু কবিতা বুঝলে ভালো, মূলত তাকে হৃদয়ে অনুভব করতে হয়। আর সেটি ভিন্ন জনে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করবে এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত।
একটা কবিতা নিয়ে আলোচনার অর্থ শুধুই প্রশংসা বা স্তুতিবাদ নয়। পাঠকের চোখে পড়া সঙ্গতি অসঙ্গতিকেও তুলে ধরতে হয় যাতে পরবর্তী রচনায় কবি আরো সচেতন ও সতর্ক হতে পারেন। এই কবিতায় কবি অতি সুনিপুণভাবে গিরগিটির প্রতিশব্দ হিসাবে বাংলা ভাষায় কম ব্যবহৃত 'কাঁকলাস' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাতে কবির শব্দভাণ্ডারের পরিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবে 'তীক্ষ্ণ-বিষক্রিয়া' শব্দগুচ্ছকে কবি 'তীগ্ম-বিষ-ক্রিয়া' লেখেছেন। বানান মোটামুটি শুদ্ধ হলেও কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে যেমন; 'ত্বরিত গতিতে'; 'যন্ত্রনায়'... হবে >> তড়িৎ গতিতে বা তড়িদ্গতিতে; যন্ত্রণায়... নিখুঁত কবিতার স্বার্থে বিশুদ্ধ বানান অপরিহার্য। আশা করি কবি সে বিষয়ে আরো মনোযোগী হবেন। এছাড়া আমার মনে হয়েছে; 'দন্তাঘাতের' পরিবর্তে 'আশীবিষ' শব্দটি আরো বেশি পরিণতি পেতো। আর, কবিতার বিশুদ্ধ আবৃত্তির স্বার্থে যতিচিহ্ন প্রয়োগে আরো একটু সচেতনতার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
সুন্দর এই কবিতার কবিকে আবারো অভিনন্দন ।