প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য যেমনটা হয় আরকি! মেঘলা আকাশ আর ঝিরিঝিরি বরষণ ধারা সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়া গ্রাম থেকে শহরের পথে। অনেক দোলাচল অনেক টানাপোড়েন উপেক্ষা করে পিঠে পিঠ ব্যাগ চাপিয়ে কু-ঝিকঝিকে চড়ে শহর এলাম। আমাদের ভালোবাসার শহর কোলকাতায়। তারপর আরও তিনটি চরিত্র নাটকে যুক্ত হয়ে চলে এলাম উড়ান স্টেশন দমদম ইয়ারপোর্ট। সেখানে পেয়ে গেলাম সপ্তক। নব আনন্দের উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে উড়ে চললাম ত্রিপুরার আগরতলার উদ্দেশ্যে। সেদিন ছিল ১২ই অগাস্ট ২০২৩ শনিবার, সময় অপরাহ্ন তিনটে বেজে দশ। যখন ঘড়িতে বিকাল চারটে বেজে পনের, আমি ও নবরত্ন তখন আগরতলার উড়ান স্টেশনে এসে অবতরণ করেছি। আমাদের অভ্যর্থনার জন্য অমায়িক বন্ধুবর্গ এলেন সেখানে। তারপর মধুর বাক্য বিনিময় ও গন্তব্যের পথে যাত্রা। চলে এলাম "ওম গেষ্ট হাউস"। সেখানেও অমায়িক কবি ও তার সাথীদের আপ্যায়ন আমাদের শুধু মুগ্ধই করেনি, পেয়েছি নিবীড় বন্ধন। প্রথম দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটল রাতের আলাপচারিতা ও নৈশভোজে।
এরপর নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্য ১৩ই অগাস্ট ২০২৩ রবিবারের শুভ্র সকালের শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যে দিয়েই। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে মেতে উঠলাম ভাব বিনিময়ে আগরতলা প্রেস ক্লাবের (নন এসি) সভাগৃহে। বেলা তখন ১০টা বেজে ২৫মিনিট, দুই বাংলার জাতীয় সংগীত উচ্চারণের মধ্যে দিয়েই শুরু হল সভার কাজ। বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, সমাজসেবী ও সরকারি মহলের অনেক অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অভ্যর্থনা ও তাঁদের মূল্যবান মতামত প্রদান পর্ব। শুনলাম অমায়িক কবির স্বাগত ভাষণ ও তারি সাথে সাথে আগত কবিদের কবিতা পাঠ ও সম্মাননা প্রদান। অনুষ্ঠান ছিল খুবই প্রানবন্ত। আমি ছিলাম প্রথম পর্বের সঞ্চালনার কাজে। বেলা যখন প্রায় ২টো বেজে ২৫মিনিট তখন বিরতি মধ্যাহ্ন ভোজনের। পরিতিপ্ত ভরে পরিতোষ দাদার পরিসেবায় ধন্য হয়ে দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠান শুরু হয় বৈকাল প্রায় তিনটে বেজে ২০ মিনিটে। নাটকের প্রয়োজনে সঞ্চালনার দ্বায়িত্বে এলেন অন্য চরিত্র কবি বিভূতি দাস। মঞ্চের আসন ও দর্শক আসন পরিপূর্ণই ছিলো আগাগোড়া। তবে মন চাইছিল কবিদের কাছ থেকে বেশকিছু বিষয়ে প্রাবন্ধিক পাঠ অথবা বক্তব্য শোনার। সেটা আর হয়ে ওঠেনি সময় অভাবেই। তবে ত্রিপুরা আর ত্রিপুরার রাজাদের কথা মনে রেখে দৃশ্যের সমাপ্তির কিছু আগে রবি ঠাকুরের লেখা বিসর্জন নাটকের নির্বাচিত অংশের পাঠ করতে ভুলিনি আমি। স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা ও কর্তব্য পরায়নতা দেখে আবারও বিস্মিত হয়েছি! তাঁরা অনেক গুণের অধিকারী সেটা বুঝেছিলাম পরে, নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে। বাংলাদেশ, ভারত ও ত্রিপুরা-বাংলার সকল কবি অনুষ্ঠানের শেষে নিজেদের ধরে রাখি একটাই ফ্রেমে। এখানেই শেষ নয় প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য। শেষটা ছিল রঙীন মৃদু আলো আর লঘু সংগীতের সাথে সমবেত নৈশ্য ভোজের আসর।
এলো ১৪ অগাস্ট ২০২৩ সোমবার : নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য। সেদিন মন চাইছিল মুক্তমনা হয়ে উড়ে চলি এই ত্রিপুরা শহরের রাজপথে। তেমনটাই হলো বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি চরিত্র আমরা সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম নিজেদেরমত করে ত্রিপুরা কালীমন্দির ও নীরমহল। তবে নাটকের অপর প্রান্তের দৃশ্য চাক্ষুষ না হলেও সাথে সাথে খবর মিলেছিল। নব-প্রান্তিক আশ্রমের দেব শিশুদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছিলেন অন্যান্য কবিবর্গ। সেদিন সন্ধ্যা নেমেছিল ৫:৩০মিনিটের পর। আমরা তখন ক্লান্ত শরীরে চলে এলাম শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি মঞ্চ "মুক্তধারায়"। অভাবনীয় সেই সন্ধ্যা আর সান্ধ্যকালীন সংলাপ, সংগীত ও নৃত্যের মাদলে ভেসে গিয়েছিল সকল দর্শক। অনুষ্ঠান দেখলাম, শুনলাম ও বুঝলাম ত্রিপুরার সংস্কৃতি। কিন্তু সবটুকু ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি। তাই অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ দৃশ্যপটে অগণিত দর্শকদের চোখের আড়ালে রুমাল বিনিময়ের সখ্যতা বজায় রাখতে পারিনি। তাই বলে সুগন্ধি যুক্ত রুমাল কখনওই মাংসের গন্ধে পরিণত হয়নি। (এইখানে জনান্তিকে বলে রাখাই ভালো, যাঁদের সত্যই চোখ আছে, তাঁরা দেখেও নিরব ছিলেন, বলতে হল নিজের মুখেই, এখনো কোনো জ্ঞানী রসজ্ঞের সাক্ষাৎ ঘটেনি মন্তব্যের পাতায়! সেই হেতু কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "কেউ কথা রাখেনি" আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "সাধারণ মেয়ে" থেকে রসদ সংগ্রহের উপমা দিলাম)। মঞ্চের আলো নেভার আগেই আমার চরিত্রের প্রস্থান প্রস্তাবিত ছিলো বোধহয়!
এলো ১৫ই অগাস্ট ২০২৩ মঙ্গলবারের কিঞ্চিৎ মেঘলা আকাশ। তবুও মনের বাঁধ গেল ভেঙে, বেরিয়ে পড়লাম রক্তিম বন্ধুকে নিয়ে ত্রিপুরার রাজবাড়ী ও মিউজিয়াম দেখার আশায়। শুরু হলো তৃতীয় অঙ্কের শেষ দৃশ্যের সুত্রপাত। সারাদিন রাজবাড়ী পরিদর্শন করতে করতে জেনেছি, বুঝেছি ত্রিপুরার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। দেখেছি ত্রিপুরার অনেক জাতি ও উপজাতির জীবনধারা ও সংস্কৃতি চর্চা। যা আমার কাছে সাহিত্য রূপে ধরা দিলো। বিকাল ৫টায় আমি ও কবি রক্তিম রওনা দিলাম আগরতলা উড়ান স্টেশনের দিকে নিজ নিজ গৃহে ফেরার তাগিদে। তখনও মনের ভিতর বেজে চলেছে ত্রিপুরার ত্রিধারার সারেঙ্গির সুরমূর্চ্ছনা... যবনিকা পড়ার পূর্বে রচিত হল... এক কাব্য
"কবি ও নর্তকী"
হে নর্তকী,
তুমিতো তোমার সবটুকু দিয়েছিলে
তোমার শরীরের প্রতিটি মুদ্রায় আঁকা
গগনবিদারী ধ্বনি আর বক্ষের অঙ্গার
ব্যপ্তির অভিনব অভিনিবেশের কালখন্ড
কবির সন্দিগ্ধ বাতাবরণের উপলব্ধিতে
তোমার পুণ্ডরীক এক স্বর্গভ্রষ্ট পথিক।
কবির মৌনতার মাঝে জ্বেলেছিলে আলো
তোমার পদক্ষেপ, সে তো ছন্দ আমার
তোমার মত্ততা প্রকাশ, সে তো আমার পূর্ণতা
তোমার নির্বাক দৃষ্টি, সে তো আমারি ভাষা
তোমার তন্বী কোমরে কবি খুঁজেছে গঙ্গা-যমুনা
তোমারই অধর কোমল কাঁটায় বিদ্ধ আমি
অথচ মন্থনের সার্থক চুম্বনের ঋজুতা!
মুছে দিয়েছি আজ বিসর্জনের ছবি
কবির নৈরাজ্যময় হৃদয় খোঁজে মৌনতা
একগুচ্ছ স্বপ্ন আর ঝলসানো বাস্তব
পরস্পরের কাছে আত্মসমর্পণের গ্লানি
চিরদিন চিররাত্রি রেখায় পৃথক বারংবার।
.................... X.................
চিত্রগ্রহণ : কবি মহঃ সানারুল মোমিন
স্থান : আগরতলা, কবি সম্মিলন ২০২৩
আয়োজনে : বাংলা কবিতা ডটকমের সদস্যগণ