রাশীদ হুসেন ( প্যালেস্টাইন) এর কবিতা
বাংলা রূপান্তর নির্ঝর মুখোপাধ্যায়
( রাশীদ (১৯৩৬-১৯৭৭) একজন প্রসিদ্ধ প্যালেস্টাইনীয় কবি। তিনি আরবী, হিব্রু ভাষায় নিয়মিত লিখে গেছেন। আরব , ইজরায়েল --- যেখানেই হিংসা আর সন্ত্রাস দেখেছেন, সেখানেই ঝলসে উঠছে তার প্রতিবাদী কলম। পরিণামে তাকে প্যালেস্টাইন ছাড়তে হয়। তিনি পি এল ও র হিব্রু আরবি অনুবাদক হিসেবে সিরিয়া ব্রডকাস্টিঙ এ কাজ নেন। প্যালেস্টাইন বাসীর বাস্তুহারা জীবনের কথা তার কবিতায় খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। ১৯৭৭ সালে নিউ ইয়র্কে একটি অগ্নিকাণ্ডে কবির অকাল মৃত্যু হয়। বর্তমান ইজরায়েল প্যালেস্টাইন যুদ্ধের পটভূমিতে কবিতা গুলো আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।)
উদ্বাস্তু
উদ্বাস্তু শিবিরের মতো মিটমিট করছে
আকাশের তারাগুলো আজ
একটা বিধ্বস্ত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মতোই
একটা হতভাগা চাঁদ
হেঁচড়ে হেঁচড়ে এক বস্তা আটা এক টিন রেপসিড তেল
নিয়ে এসে দিয়ে গেল
আমার দুঃখী মানুষ গুলোর কাছে
আজ রাতে এটুকুই চাঁদের উপহার।
* * *
বিনা পাসপোর্টে
জন্মে গেলাম
বড় হলাম
আর দেখলাম
আমার দেশ
একটা জেলখানা হয়ে গেছে কখন
একেবারে বিনা পাসপোর্টে
তাই এক দেশ গড়লাম আমি
একটা সূর্য
একটা গম খেত
প্রত্যেক বাড়ির আশেপাশে
লাগালাম গাছ।
শিখলাম আমার গাঁয়র লোকের ভালো লাগার কবিতা লেখে কেমন করে
একেবারে বিনা পাসপোর্টে
জানলাম যাদের পায়ের তলার মাটি
চুরি হয়ে গেছে
তাদের আর বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে না
আদৌ তারা ফিরে আসে যদি
তাদের আসতে হবে
একেবারে বিনা পাসপোর্টে
কিন্তু সত্যি আমার মনটাকে নিয়ে
বড় ভারাক্রান্ত আমি
সেটা যেন একটা হোটেল হয়ে গেছে কবে
বিনা পাসপোর্টে
একটা ইচ্ছেরও জায়গা নেই কোনো
কিন্তু আমি তো পাশপোর্ট ছাড়াই
এসেছি তোমার কাছে
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি তোমার
তাই হত্যা করো আমায়
তাহলে হয়তো ভাবতে পারবো
মরে যাচ্ছি
একবারে বিনা পাসপোর্টে
মাকে
একজনও কেউ তোমাকে পড়তে শেখালো না
বরঞ্চ সবাই কি করে নিরক্ষর থাকতে হয়
সেটাই সারা জীবন শিখিয়ে গেল।
আর সেই জন্যেই
আমি সব সময় চেষ্টা করি
খুব সহজ করে লিখতে।
আমি জানি
আমার কবিতার এই সহজ সরল শব্দ গুলো শুনেই
একদিন তুমি রেগে উঠবে
বিশেষ করে যেখানে
আমি আদি রসের কথা লিখেছি।
তুমি বলবে,
" এসব কি লিখেছিস ?
অসভ্য নির্লজ্জ কথা,
জানিস না, আমাদের পূবের দেশে
এসব মানায় না ?"
কিন্তু মাগো,
তোমার পূবের দেশ তো খুন হয়ে গেছে কবে।
* * *
চিঠি একটা মেয়েকে
আমি অপেক্ষা করেছিলাম
কিন্তু তুমি তো তখনো জন্মাওনি ।
অথচ ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দেবে দেবে করছে,
মানুষের থেকে রেলগাড়ি গুলো শিখে গেছে
কি করে অধৈর্য হয়ে
সব ভালোবাসাকে পিষে ছিন্ন ভিন্ন করে
উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে হয়।
ট্রেন ছেড়ে দিল
সরি, আমাকে যেতেই হবে।
আমি স্টেশনের কাফেতে
এই চিঠিটা রেখে গেলাম।
একদিন এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে
বসে এক কাপ কফি খেতে খেতে
ওয়েট্রেসকে জিগ্যেস কোরো,
" সে কি আমার জন্যে কোনো চিঠি রেখে গেছে?"
সে হয়তো ঠিক বুঝতে পারবে না।
বলবে, " এখানে তো সবাই সবাইকার জন্য
চিঠি রেখে যায়,
আর সব চিঠিতেই তো একই কথা লেখা থাকে,
ভালোবাসি তোমায়।"
দোহাই তোমার
তুমি কিচেনে গিয়ে কুকের সঙ্গে দেখা কোরো
হয়তো আমার চিঠিটা তার কাছে যেতে পারে,
সে হয়তো বলতে পারে,
" স্যুপের মধ্যে আমি একদিন
এক টুকরো কাগজ দেখেছিলাম বটে।
ওখানে লেখা ছিল
প্রিয়তমা, ওরা আমাকে দেশের জন্য
মরতে পাঠিয়েছে।
তুমি চেষ্টা করো
আমাদের জন্য বেঁচে থাকতে।"
তারপর তুমি কাফের মালিকের কাছে যেও।
লোকটা টাকা পয়সার সঙ্গে
আমার চিঠিটাও হারিয়ে ফেলতে পারে।
লোকটা তোমাকে একটা মেনু দিতে পারে।
সেটাতে লেখা থাকতে পারে,
" এক টাকায় এক কফি পাওয়া যায়
একশ টাকায় এক গ্লাস বিয়ার
এক জন মানুষের মূল্যে কেনা যাবে শুধু তৃষ্ণা।"
এরপর কাফের থেকে বেরিয়ে যেও
আর তোমাকে আমার চিঠির খোঁজ করতে হবে না।
ততক্ষণে নানা জনের কাছ থেকে
চিঠিটির টুকরো টুকরো অংশ
তোমার কাছে পৌঁছে গিয়ে থাকবে।
আমি সত্যি খুব খুশি হবো
তোমার জন্মের পর
আমার চিঠির টুকরো গুলো পৌঁছে গেছে ভেবে।
আমি জানি
তোমার জন্মের আগে
এ চিঠি তোমার হাতে গেলে
তুমি নিশ্চিত এ সময়ে এ দেশে
না জন্মাবারই সিদ্ধান্ত নিতে।
বড় ক্ষতি হয়ে যেত তাতে।
* * *
মাটির সঙ্গে
( জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ১৯৫৯ সালে
কবি প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।)
এই বাসভূমি আমার কাছে এসে
জল চেয়ে খায়।
আমার সুরক্ষার জন্য
আমার কাছে রেখে যায়
এক অনিন্দ্য ফলের বাগান।
এমনকি আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ি
তখনো স্বপ্নের মধ্যে
এই বাসভূমি
আমার কাছে আসে।
এক নির্বাসন থেকে আর এক নির্বাসনে
আমি তার সুগন্ধি ফুল গাছের চোরাচালান করি।
এই মাটি আমার কাছাকাছি আসে যদি তাই,
আমাকে বাঁচাতে, নিজেকে বাঁচাতে
এক টুকরো পাথর , ভালোবাসার পাথর
আমার কাছে ফেলে যদি যায়,
তাই এ ভূমির পাথর আছে যত
তাদেরই গান গেয়ে উঠি আমি।
এই বাসভূমির খবর পেতে
তৃষ্ণায় আমার ধমনী ফেটে রক্ত ছোটে।
একদিন এ মাটির মূল্য দেবো আমি
আহা সেদিন সহস্র সোহাগের আলিঙ্গনে
বাঁধব তাকে আমি,
আহা সেদিন পূজার্চনা করবো হাজার বার।
কপালে ঠেকিয়ে তাকে আমি
সব নির্বাসনের, সব জেলখানার ধ্বংস স্তুপের মাঝে
সুসম্পন্ন করবো পরিণয়।
সে আমার তৃষ্ণা মেটাবে এসে
আমিও তৃষ্ণা মিটিয়ে দেবো তার
সমস্ত হর্ম্য-তোরণ সুসজ্জিত হবে
সংগ্রাম, ভালোবাসা
আগলে রাখবে তাকে
আগলে রাখবে আমায়
আমি তাকিয়ে থাকি
ঐ তো বাসভূমি
একটা সকাল আসবে
ঐ বাসভূমি আসবে বুকের কাছে আমার।