মোসাব আবু তোহা বর্তমানে প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে আলোচিত কবি। তাঁর প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত এক মাত্র কবিতার বই "আমার কানের ভেতর খুঁজলে যেসব শব্দের দেখা পেতে পারো " ২০২২ সালে প্রকাশিত হতেই হৈ চৈ ফেলে দেয়। আমেরিকান বুক এ্যওর্ড, প্যালেস্টাইন বুক এ্যওর্ড, ডেরেক ওয়ালকর্ট পোয়েট্রি প্রাইজ সব কটি পুরস্কারের সম্মান অর্জন করেছে।
ব্যক্তিগত জীবনে চুড়ান্ত সেনা অত্যাচারের শিকার। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন দুবার । গাজায় তার বাড়ি ঘর সব ধ্বংস হয়ে গেছে। উদ্বাস্ত ক্যাম্পে কেটেছে দিনের পর দিন। এসব নিয়েই গড়ে উঠেছে তার কবিতার জগৎ।
(বাংলা রূপান্তর নির্ঝর মুখোপাধ্যায়)
স্থান চ্যুত
আমি আমার মধ্যেও নেই
আমার বাইরেও নেই
কোথাও একটা মাঝামাঝিতে আছি।
কিছু একটার ছায়া হয়ে আছি।
খুব বেশী হলে
কোনো কিছু সত্যি সত্যি না হয়েই আছি।
গাজায় বিরাজমান
এই সময়ের নির্ভার একটা কণা হয়ে আছি।
কিন্তু আমি থাকবো,
যেখানে আছি
সেখানেই আমি থাকবো।
ছায়ার শোক সংবাদ
সীমানা পেরোবার আগে
ওপাশে আমার ছায়াটাকে
একদম একা রেখে এসেছি।
অন্ধকারে লুকিয়ে
শীতে কাঁপছে আমার ছায়া ।
ওর কোনো ভিসা লাগবে না।
বাস্তুহারা ছায়াটা চিরকাল
আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকে
শুধু মাত্র গ্রীষ্মের রোদে স্কুলে যাবার সময়
সে আমার পাশে পাশে হাঁটত।
আমার ছায়া এখনো সকাল বেলা
ছেলেদের সাথে স্কুলে যেতে চায়,
কিন্তু স্কুলের দরজায় আটকে যায় মাথা।
আমার ছায়ার এখন ঠান্ডা লেগেছে খুব
খুব হাঁচি আর কাশি
কেউ তাকে বলার নেই,
ঈশ্বর , তোমার মঙ্গল করুন।
আমার ছায়াটা গাড়ির ধাক্কা লেগে
চুরমার হয়ে গেছে,
বুলেট আর কাঁটার আঘাতে
বক্ষ বিদীর্ণ তার
পক্ষ বিহীন ছায়া আমার
হাওয়ায় লাট খাচ্ছে,
কেউ তাকে দেখার নেই।
আমার ছায়ার স্মৃতি ফেটে
কালো রক্ত উছলে পড়ছে
যেমন এখন, তেমন চিরটা কাল।
কম্বল
ইয়াফা, আমার চার বছরের মেয়েটা
ওর পিঙ্ক রঙের জামাটা পরে শুয়েছিল।
একটা বোমা ফাটার বিকট আওয়াজ শুনেই
সে জামাটার আস্তিন টেনে মুখে চাপা দেয়।
আমার সাড়ে পাঁচ বছরের ছেলে ইয়াজান
নিজের গায়ের ওম লাগা কম্বলটা খুলে
বোনের গায়ে আপাদমস্তক চাপা দিয়ে বলে,
আর ভয় নেই। এবার ঘুমো।
আমি আর মারাম প্রার্থনা করি
এক যাদু কম্বল ঢেকে দিক আমাদের বাড়ি।
( মোসাব আবু তোহার গাজা নোট বুক ২০২১-২০২৩ থেকে নির্বাচিত)
।।১।।
তখন আমি পঞ্চম শ্রেণী
স্কুল লাইব্রেরীর দরজার পাশে দেয়ালে
দেখেছি পোস্টার----
" তুমি যদি বই পড়,
তাহলে একাধিক জীবন পাবে বাঁচার।"
এখন আমি তিরিশ,
আমার চার পাশের বৃদ্ধ, শিশু, যুবক
তাদের মুখের দিকে তাকাই
দেখি সবার কপালে লেখা আছে,
" যদি তুমি গাজায় থাকো,
তাহলে তুমি মরবে অনেক বার "
।।২।।
বোম পড়ার পর
বাড়ির পাথরগুলো সব
আলজাইমারে আক্রান্ত হয়েছে।
কেউ ভুলে গেছে,
সে আসলে বাথরুমের দেয়ালে ছিল।
কেউ কিচেনে, কেউ শোবার ঘরে
কেউ বা টাঙানো ছবির পিছনে
কয়েকটা সরাসরি বোমা খাওয়া যারা
তারা তো এমনকি ভুলে বসে আছে,
তারা একদিন পাথর ছিল !
।।৩।।
সাগরের পার দিয়ে হাঁটতে থাকলে
বালির ওপর পায়ের ছাপ গুলো
স্বপ্ন বুনতে বুনতে যায়।
আর ঢেউ গুলো ?
তারা কি করে ?
।।৪।।
আট জন শিশু ফুটবল খেলে
সমুদ্রের ধারে বালির ওপর।
আট খানা বোমা
মেদিনী কম্পিত করে।
চার জন শেষ
আহত বাকি চার।
ঘড়ি টড়ি না দেখেই
রেফারি বাজিয়ে দেয় বাঁশী।
খেলা আজ চার চার গোলে ড্র।
এ খেলার নিয়ম
জানা আছে রেফারির ভালো।
এখানেই খেলা তবে শেষ।
( যদি অবশ্য আরো যুদ্ধ বিমান,
আরো বোমা ও আরো গোল না হয় )
সমুদ্রের ঢেউ গুলো
এতক্ষণ দর্শক হয়ে
খেলা দেখতে দেখতে খুব লাফাচ্ছিল।
তারা সব চুপ এখন।
একজন এ্যমবুলেন্স কর্মী
একবার বলটার দিকে এক ঝলক দ্যাখে,
বলটাকে ( অক্ষত ) উৎসাহ দিতে
রেফারি আর একবার বাজিয়ে দেয়
খেলা শেষের বাঁশী।
বোমায় ক্ষত বিক্ষত স্কোরবোর্ড
( জিতে গেছে শিশুদের দল। )