কবি মাসুদুল হক এর "সমুদ্রের চিঠি" কবিতার পাঠ প্রতিক্রিয়া: নিরঞ্জন রায়
-----------------------------
সমুদ্রের চিঠি
মাসুদুল হক

আমার প্রায়‌ই বুড়ো নাবিক সান্টিয়াগোর
কথা মনে পড়ে
বালক ম্যানোলিনকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে
বিশাল একটা মাছ পেয়েছিলেন সমুদ্রে

কিন্তু হাঙরের কাছ থেকে শেষপর্যন্ত
শুধু কঙ্কাল উদ্ধার করে বাড়ি ফিরেছিলেন
তবুও নিরাশ হয়নি বুড়ো!

আর আমি এখনো বুড়িয়ে যাইনি
আস্ত একটা জীবনের অর্ধেক পার করে
জল জমিয়ে ঘরেই আছি
আমার দেখা হয়নি এখনো সমুদ্র

অথচ একটা মাছের স্বপ্ন নিয়ে বসে আছি
সীমিত জল ও লবণে
একদিন বালক ম্যানোলিন আসবেই
সমুদ্রের চিঠি নিয়ে!

---------------------------

আলোচনা: একশত তিন পৃষ্ঠার ছোট্ট একটি উপন্যাস; ---আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে ঘরে তুললেন নোবেল পুরস্কার। জীবনযুদ্ধের কী নিখুঁত চিত্রায়ন!

সমুদ্রকেই ঘর সংসার বানিয়ে বসে আছেন সান্টিয়াগো নামে এক বৃদ্ধ নাবিক। কেন তিনি হাল ছেড়ে দেবেন! তাঁর ভালোবাসা-প্রেম এক সমুদ্র, আর মাছকে ঘিরেই। জীবন যাপনের একমাত্র অবলম্বন--তার ভালোবাসা, প্রেম--তার কর্ম, তাঁর মাছ শিকার।
দীর্ঘ চুরাশি দিন একটা মাছও শিকার করতে পারেননি তিনি; তাতে হয়েছেটা কী! সফলতা ব্যর্থতা তো জীবনের অংশ--শূন্য নৌকো নিয়ে তীরে ফেরা তাঁর কাছে নতুন প্রেরণা--জীবনের শেষ দেখতে চাওয়ার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা, জীবনের চ্যালেন্সকে ভালোবেসে গ্রহণ করা।
ম্যানোলিন বৃদ্ধের নৌকোয় থাকা এক সুবোধ ছেলে, গভীর ভালোবাসা তার সান্টিয়াগোর প্রতি;
কিন্তু ছেলেটির বাবা মা চান না বৃদ্ধকে আর সময় দিক ম্যানোলিন, আমরা হলেও হয়তো তেমনটাই ভাবতাম-- এটা যৌক্তিক বৈকি, কতদিন আর ছেলেটি এভাবে বৃদ্ধের পেছনে সময় নষ্ট করবে, যখন গোটা জীবনটাই তার সামনে পরে আছে।
কিন্তু যাঁর জীবন সমুদ্রের সাথে একাত্ম, যিনি সমুদ্রের গতি প্রকৃতি বোঝেন তাঁর নিজের জীবনের মতোই, তিনি কেন হাল ছেড়ে দেবেন!
জীবনের অভিজ্ঞতা যেন সান্টিয়াগোর সমুদ্রের অভিজ্ঞতা। এবং তাঁর জীবনের একমাত্র প্রেম মাছ শিকার;--- মাছকে সে ভালোবাসে, মাছ শিকার করার অধিকার একমাত্র তিনিই সংরক্ষণ করেন, কারণ মাছের প্রতি তাঁর প্রেম, তাঁর ভালোবাসা একাগ্র।
ম্যানোলিন ছেলে মানুষ; বাবা মায়ের ইচ্ছা সে একজন ভালো মাছ শিকারী হয়ে উঠুক; কিন্তু অপয়া বৃদ্ধের কাছে আর কতদিন! কিন্তু সান্টিয়াগো ছিল ম্যানোলিনের কাছে আস্থার প্রতীক, তাঁর বিশ্বাস, সমুদ্রই যাঁর জীবন, মাছের প্রতি যাঁর এত প্রেম তিনি মাছ নিশ্চয়ই ধরে একদিন তীরে ফিরবেন।
সান্টিয়াগো তার বাবা মায়ের ইচ্ছেমতো ম্যানোলিনকে তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে একাই জীবনযুদ্ধে নেমে গেলেন; এক সময়ে সমুদ্রের এক বিশাল মাছও (মারলিন মাছটির নাম) তাঁর টোপে ধরা দিল। একদিকে হাঙর(এখানে বৈরি প্রকৃতি যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ) আর একদিকে তাঁর গোটা জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তাঁর প্রেম--তীরে নিয়ে এলেন, কিন্তু ততক্ষণে প্রিয় মাছটি আর মাছ নেই, কঙ্কাল হয়ে গেছে। সান্টিয়াগো নিজেও বিপর্যস্ত, কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। এটাই আসলে প্রকৃতির নিয়ম--জীবনে সফলতা অনেক সময় ঢিল দূরত্বে থাকে, ঘরে তোলা যায় না; কিন্তু যেটা কথা--সেটা হলো জীবন সংগ্রাম,--- একাগ্র প্রেম,-- একনিষ্ঠ সাধনা--চ্যালেন্সের মুখোমুখি হওয়া। হেমিংওয়ে যেমনটা বলেছেন তাঁর উপন্যাসে---"But man is not made for defeat. A man can be destroyed but not defeated.”

কবি ড. মাসুদুল হক গোটা উপন্যাসটাকেই যেভাবে ক'টি পংক্তির মধ্য দিয়ে তুলে আনলেন এটা একটা বিস্ময়------
"আমার প্রায়‌ই বুড়ো নাবিক সান্টিয়াগোর
কথা মনে পড়ে
বালক ম্যানোলিনকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে
বিশাল একটা মাছ পেয়েছিলেন সমুদ্রে

কিন্তু হাঙরের কাছ থেকে শেষপর্যন্ত
শুধু কঙ্কাল উদ্ধার করে বাড়ি ফিরেছিলেন
তবুও নিরাশ হয়নি বুড়ো!"

কবি ও গবেষক ড. মাসুদুল হক এবারে তাঁর কবিতায় ঔপন্যাসিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে'র উপন্যাসের প্রসঙ্গ টেনে এনে সামনে রাখেন---জীবনের মূল জিজ্ঞাসা, এটা আমাদের সবার মনের কথা---------
"আর আমি এখনো বুড়িয়ে যাইনি
আস্ত একটা জীবনের অর্ধেক পার করে
জল জমিয়ে ঘরেই আছি
আমার দেখা হয়নি এখনো সমুদ্র

অথচ একটা মাছের স্বপ্ন নিয়ে বসে আছি
সীমিত জল ও লবণে
একদিন বালক ম্যানোলিন আসবেই
সমুদ্রের চিঠি নিয়ে!"

কবি মাসুদুল হক সান্টিয়াগোকে জীবনের প্রতীক হিসেবে মনে করেন; সান্টিয়াগো পারলে, আমি নয় কেন, আমরা নয় কেন! আমফানে বিধ্বস্ত উপকূলবাসী নয় কেন! পদ্মাপাড়ের লোকজন নয় কেন!
কবি তো এখনও মুটিয়ে যাননি, কেন তিনি জলের ঘটা নিয়েই সেখানে মাছ শিকারের স্বপ্ন দেখেন; আসলে এটা তো জীবন না, জীবনের যে ব্যাপকতা তা উপলব্ধি করতে না পারা। কবি আমাদের সবার প্রতিনিধি হিসেবে মনে করেন, জীবনের গভীরতার আস্বাদন লাভ করতে গেলে সমুদ্রে ডুব দিতে হবে, জীবনের কাছাকাছি যেতে হবে-- সমুদ্রের প্রতিকূল পরিবেশকে মোকাবিলা করেই মাছ শিকার করে ঘরে তুলতে হবে।( এখানে মাছ শিকার প্রতীকী অর্থে জীবনের লক্ষ্য)। সান্টিয়াগো বেঁচে নেই আমরা ধরে নিতে পারি, সান্টিয়াগোকে যে নিবিড়ভাবে চিনত সে ম্যানোলিন, ---ম্যানোলিন বেঁচে থাকবে চিরকাল জীবনের দূত হিসেবে--- সান্টিয়াগোর জীবনের গল্প বলার জন্য উত্তর প্রজন্মের কাছে, আমাদের কাছে। কবি আশা প্রকাশ করছেন, নিশ্চয়ই ম্যানোলিন সমুদ্র-সান্টিয়াগো-মারলিন(মাছটির নাম) এই ত্রয়ীর গল্প শুনাতে বারবার আসবেন,---জীবন চেতনায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে আসবেন।

খুব সুন্দর একটি জীবন দর্শনাশ্রয়ী কবিতা এবং একটি সফল আধুনিক কবিতা। কবি মাসুদুল হক স্যারের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।