কালিদাসের মেঘদূত:
মিলনের সুখ বা বিরহের দু:খ নয়, আনন্দের বাহক!
ইতিহাসের ছাত্রী এবং সাহিত্য আমাকে খুব টানে বিধায় আজ সাধারণভাবে সংস্কৃত সাহিত্য এবং বিশেষভাবে কালিদাস কতখানি আবেদন-সঞ্চারী তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই কালিদাসের মেঘদূতের কথা মনে হয়। আধুনিক পাঠক উমবার্তো একো পড়েন কিন্তু বাণভট্ট নয়; শেলি-কিটস-ওয়ার্ডসওয়ার্থ আদৃত হলেও কালিদাস থেকে যান অচ্ছুত। আজকের পাঠকের কাছে সংস্কৃত সাহিত্য, রামায়ণ-মহাভারত— এ দুটি মহাকাব্যসমেত, আর ব্কী সব কি পরিত্যাজ্য? কবি হিসেবে কালিদাস কতখানি তা মূল্যায়িত হবার সুযোগটা কেউ রাখেনি বোধ হয়।
তাই এ গ্রুপের জন্য বাংলা শুভ নববর্ষে লিখাটা দিলাম।
বাঙালি মনীষার বিগত দুশো বছরের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, তাহলে এমন কোনও স্বনামধন্যের সাক্ষাৎ পাব না, যিনি উত্তম সংস্কৃত জানতেন না, সংস্কৃতের অসীম ভাণ্ডারের কাছে কোনও না কোনওভাবে ঋণী নন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ… তাঁরা কি যথেষ্ট আধুনিক ছিলেন না?
সংস্কৃতের প্রতি ঋণ আমাদের আজানুলম্বিত! পরশুরাম তাঁর ‘ভূশণ্ডীর মাঠে’ গল্পে মেঘদূতের অনুষঙ্গ নিয়ে আসেন, শকুন্তলাকে বাঙালি পাঠকের উপযোগী করে তোলেন, বিদ্যাসাগর আর অবনীন্দ্রনাথ, শরদিন্দু থেকে সুকুমার সেন সংস্কৃত থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে তাঁদের লেখায় বুনে দেন, কালিদাসের বৌদ্ধবিদ্বেষ বনাম শেকসপিয়রের ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে তুমুল-তর্ক হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলায় ‘দুরাদয়শ্চক্র’ ছাড়াও একাধিক অধ্যায়ারম্ভে কালিদাস-সুভাষিতের ব্যবহার, রঙ্গলাল থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সেলিম আলদীন পর্যন্ত কালিদাসের বিনির্মাণ, এই বিচ্ছিন্ন উদাহরণগুলো আমাদের এই সাহসী সিদ্ধান্তে উপনীত করায়, সংস্কৃত সাহিত্যপাঠ ছাড়া একজন আধুনিক সাহিত্যপাঠকের সাহিত্যপাঠ অসম্পূর্ণ থাকতে বাধ্য।
একশো কুড়ি-বাইশ শ্লোকে মন্দাক্রান্তা ছন্দে মেঘদূত কালিদাসের অন্যান্য যাবতীয় রচনার তুলনায় অধিক জনপ্রিয়। এ-কাব্যের টীকা রচনা করেছেন মল্লিনাথ থেকে শুরু করে আরও অন্তত পঞ্চাশজন। কেবল বাংলাভাষাতেই মেঘদূত অনূদিত হয়েছে শতাধিকবার। অনুবাদকের মধ্যে প্রধানরা হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজশেখর বসু, হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কাব্যটির তিব্বতি ও চিনা অনুবাদের সংবাদও জানা যায় . . .
মেঘদূত কাব্যের মূল সুর বিরহের। বাঙালি পাঠকের অভ্যস্ত পাঠ-পরিমণ্ডলে প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ বা মিলন— এসবের সঙ্গে তার প্রভূত পরিচয় আছে। এ-কাব্যের কাহিনি-অংশ খুবই ছোট। কুবেরের ভৃত্য এক যক্ষ কাজে অবহেলা করেছিল বলে তার একবছরের সাজা হল, স্বর্গ ছেড়ে স্ত্রীবিরহিত হয়ে তাকে থাকতে হবে পৃথিবীর রামগিরি পাহাড়ে। শাপগ্রস্ত যক্ষের নির্বাসনকালের আট মাস কেটে গেল, বাকি আর চার মাস। এ-সময়ে আষাঢ়ের প্রথম দিবসে মেঘের আবির্ভাব দেখে যক্ষের বিরহবোধ তীব্র হয়ে উঠল। স্ত্রীর চিন্তায় ব্যাকুল যক্ষ মেঘকে অলকায় গিয়ে তার কুশলসংবাদ জানাতে বলল। মেঘ রামগিরি থেকে যে যে পথ ধরে অলকায় যাবে, যক্ষ তার পথনির্দেশও দিয়ে দিল। প্রাচীন ভারতের নদনদী পাহাড়পর্বত নগর-জনপদ পশুপাখি মানুষজন ফুলফলের চিত্রমালা এর মাধ্যমে কালিদাস আমাদের উন্মোচন করে দেখান, দেখান লোকাচার, লোকসংস্কার, নগর ও গ্রামের বৈচিত্র্য ও অনন্যতা।
রামায়ণে হনুমানকে রামের দূত করে অশোকবনে সীতার কাছে পাঠানো হয়েছিল। মহাভারতেও দেখি, নল হংসকে দূত পাঠাচ্ছেন দময়ন্তীর কাছে। শ্রীহর্ষ-রচিত নৈষধীয়চরিতম্-এও রয়েছে হংসদূতের বিদগ্ধ ক্রিয়াকলাপ। এমনকি কালিদাসের রঘুবংশম্-এর ১৩শ সর্গে যে রাম-সীতার বিমান ভ্রমণ, লংকা থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত ভারতবর্ষের ভূগোল সুস্পষ্ট যাথার্থ্যতায় উঠে এসেছে,— এও তো একধরনের দূতকাব্যেরই প্রকারভেদ। তবু মেঘদূত রামায়ণ-মহাভারতের কাছে অধমর্ণতা নিয়েও অনন্যতায় সংস্কৃত সাহিত্যে সম্পূর্ণ একক, তুলনারহিত আর অপূর্ব একখণ্ড মহাকাব্য।
দুঃখের অভিঘাত এমনই স্থায়ী ও গাঢ় বোধ, যা তাকে খাঁটি সোনা করে, নিটোল করে, তাকে জাগিয়ে দেয়। অন্যদিকে সুখ মানুষকে ভুলিয়ে রাখে, মানুষের পদবী থেকে তাকে বিচ্যুত করে ক্ষণিক, আত্মস্থ হতে দেয় না তাকে। সুখে তাই আমরা ভেসে যাই, দুঃখে হই আত্মস্থ। সুখ আর দুঃখ মানুষের কাছে পরিযায়ী ভাবে আসে। এর ব্যাখ্যা ঔপনিষদিক ও বৌদ্ধশাস্ত্রেও আছে, বুদ্ধদেব মানবজীবনে দুঃখের কারণ হিসেবে তনহা বা তৃষ্ণাকে দায়ী করেছেন। রূপতৃষ্ণা, অৰ্থতৃষ্ণা, যশের তৃষ্ণা, আরও নানান তৃষ্ণা; আর সেটাই অন্য দর্শনমতে কাম। তৃষ্ণা বা কামের দ্বারা কাম বা তৃষ্ণা শান্ত হয় না, আগুনে ঘি পড়লে যেমন আগুন নেভে না, তেমনি। পৃথিবীতে এমন কোনও দুঃখ নেই বা সুখ নেই, যাতে তৃষ্ণা/কাম, এর ভূমিকা অনুপস্থিত। এখানে মনে রাখতে হবে যে, সুখ আর আনন্দ, কখনওই এক নয়। মেঘদূত কাব্যের মাধ্যমে বুঝানো যায়, দুঃখ সুখের ওপারে গিয়ে যক্ষ যখন দুখের মাঝে থেকে, সুখের প্রত্যাশায় অলকাপুরীর বর্ণনা করেছিলো, প্রকৃত অর্থে তাহাই আনন্দ। বলা যায়, আনন্দ দুঃখ ও সুখের অতীত একটি অবস্থান। দুঃখের সঙ্গী বেদনা, আর সুখের সঙ্গী সম্ভোগ। দুঃখ বা সুখের অভিজ্ঞতা যদি স্বস্তি বা শান্তি আনতে পারে তবে তা আনন্দ/ যক্ষ মেঘকে প্রেয়সীর কাছে পাঠিয়ে আনন্দ পেয়েছিলো, নইলে জীবনভর দুঃখেই অবগাহন করতে হতো, আনন্দ মিলতো না।
মেঘদূত বিরহের কাব্য, মিলন বা বিচ্ছেদের নয়। যা কাঙ্ক্ষিত, তার অনুপস্থিতিই বিরহ; তাই বিরহের শেষে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পাবার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু তা হারালে বিচ্ছেদ ঘটে। বিরহে সন্তাপ, বিচ্ছেদে শোক। কালিদাসের যক্ষ তাই বিরহী। যখন তার নির্বাসনদণ্ড ঘটে রামগিরিতে, তার জীবনে প্রিয়াবিরহিত সন্তাপ যুক্ত হয়। মেঘের যাত্রাপথের যে নির্দেশ যক্ষ দিয়েছে, তাতেই তাকে প্রেমিক হিসেবে চিনিয়ে দেয়। প্রেম তাকে সুন্দর করে বাঁচতে শিখিয়েছে, তাই তার সংলাপ এত লাবণ্যমণ্ডিত, বর্ণময়, কাব্যসম্মত, সংযত এবং ওষধির মতই নিরাময়কারী। অক্ষয় প্রেমিকের দৃষ্টিতে সে জগৎসংসারকে অনুভব করে বলেই অলকাপুরী তার কাছে শুভ্রতার ঝলক নিয়ে আসে।
মধ্যযুগের কাব্যে রামায়ণে হনুমানকে রামের দূত , মহাভারতেও দময়ন্তীর দূত নল হংস যেমন একটি মিলনাত্মক সাহিত্য রচিত হয়েছে, প্রাচীণ যুগে কালীদাসের মেঘদূতে আনন্দ মাঝেই পারিপার্শ্বিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। দু:খ থেকে আনন্দ তারপর মিলনের সুখ বা বিরহের দু:খের পরিনতি পাওয়া যায়না। সুতরাং মেঘদূত এখানে আনন্দের বাহক/মাধ্যম মাত্র ; যা পাঠক বা বাস্তবের জন্য সুখ বা দু:খ বয়ে আনতে পারে।
বাংলা সাহিত্যে প্রাচীণ যুগের ব্যাপ্তি ৬৫০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত ধরা হয় আর এ সাহিত্যের সমস্ত ঋণই সংস্কৃত ভাষায় নিমজ্জিত। মধ্যযুগে ১২০৬ সালে বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সংস্কৃতের প্রচলন বেশী থাকলেও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১২০১ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮০১ থেকে আধুনিক যুগের শুরুতে মাইকেল মধূসুদন দত্ত ইংরেজী সাহিত্যে অবদান রাখার চেস্টা করে বিফল হয়ে ইংল্যান্ডে বসেই সনেটের আদলে বাংলার চতুর্দশপদী কবিতার সূচনা করেন ; যা পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর, অবনীন্দ্রনাথ, শরদেন্দু, সুকুমার সেন, বঙ্কিমচন্দ্র, রঙ্গলাল, রবীন্দ্র নাথ, নজরুল, সত্যাজিৎ, সুনীল, সমরেশ, শীর্শেন্দু সেলিম আলদীন কে ছুয়ে এসে আজকের গুগল, ফেসবুক আর চ্যাট জিপিটির যুগের বাংলা সাহিত্যে পর্যবসিত হচ্ছে। ইতিহাস থেকে আধুনিকতায় এ টার্ণটাতে প্রাক প্রাচীণ যুগের কালীদাসের মেঘদূত হয়তো যান্ত্রিকতায় রুপ নেবে যাতে প্রাণ খুঁজতে গেলে হয়তো আমরাই ব্যাকডেটেড হবো। আহা! কেমন জীবনবোধ.... কী ইতিহাস আর বাংলা সাহিত্যে মেঘদূতের সংগ্রাম; তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখার অবকাশ রাখে।