আজ তোমার জন্ম দিন, জীবনানন্দ, আজ তোমার জন্ম দিন।
ঐ যে সামনে রাখা পোট্রেইট।
নামহীন চিত্রকর সোনালী ডানার ফ্রেমে তোমার ছবি বাঁধিয়েছে।
আজ তোমার জন্ম দিন হবে বলে -
সকালেই পাক-পাকলি আর শালিখেরা কিচির-মিচির শব্দে আর শীষ দিয়ে তোমার জন্মদিনের নিমন্ত্রণ ছড়িয়েছে -
মাঠ-ঘাট-নদী-পথ, প্রান্তর থেকে বনান্তরে,
সবুজ এবং নুয়ে পরা সোনালী ধানের ক্ষেত
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহর থেকে বিম্বিসা নগর অব্দি
সক্কলকে আজ তোমার জন্মদিনের নেমন্তন্ন জানিয়েছে।
সন্ধ্যেবেলা তোমার জন্মদিনের আসর বসছে, ধূসর ধুলায়।

জীবনানন্দ,
তোমার নিবদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে দ্যাখ আমরা সকলেই এসেছি।
বাদল, সুজন, নীহার, বনলতা, সুরঞ্জনা এমন কি কিষানী বৌ -
সে ও এসেছে আজ তোমার জন্ম দিনে।
আসেনি দাদাঠাকুর রবীন্দ্রনাথ - ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
বড়ই অভিজ্ঞান তাঁর।
ছন্দহীন এক্কেবারে গেঁয়ো সাধারণ ভাষা কি না !
প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। খুব একটা ভাল লাগেনি বলে
সাধারণ সদামাঠা ভদ্র সূচক প্রশস্তি লিখেছে -
” তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।”

জীবনানন্দ ,
আজ জন্ম দিনে কাশফুল রঙ্গের ধূতি আর পাঞ্জাবি পরো।
কাঁধের উপর চিরায়ত চাদর ; আজানুলম্বিত বড় ভাল লাগে।
বাবুকরা ধূতিপ্রান্ত পকেটে গুঁজে রেখো।
ক্ষয়ে যাওয়া চটিজোড়া গ্রামের ঐ মুচি বৌকে দিও-
কোমর থেকে আঁচল খুলে যত্ন করে ধুসরতা মুছে দেবে।
ওরা পাগলের মত ভালবাসে তোমায়।
বাদল বৃষ্টিধোঁয়া কথার মালা এনেছে - তোমায় পড়াবে।
প্রতিধ্বনীর ব্যঞ্জনায় সচ্ছতার ধোয়ায় সুজনাদি শোনাবে পান্ডুলিপি – শিশিরের শব্দে।
ঘাসের ’পরে জমে থাকা রূপালী নীহার বিন্দু
কী যত্ন করে তুলে এনেছে সুরঞ্জনা আর কিষানীবৌ।
আর বনলতা - দেড়’শ বছর ধরে জমিয়ে রাখা প্রেম চন্দন কাঁঠাল পাতায় মুড়িয়ে বুকের মধ্যে করে এনেছে।
দীর্ঘশ্বাস দিয়ে মাখিয়ে মাখিয়ে ওষ্ঠ তুলিতে বিন্দু বিন্দু – আলপনা এঁকে দেবে তোমার কপোলে, ললাটে।
তোমাকে কী সুন্দর দেখাবে তাই না !
চন্দন প্রেম দিয়ে চুম্বন তোমার ভাল লাগবে না। ?
দেড়’শ বছর আগে যার সামান্য স্পর্শ,
মুখোমুখি গল্প করার শিহরণ তোমাকে ব্যকুল করেছিল
সেই বনলতা এসেছে আজ তোমার জন্ম দিনে
তোমাকে সাজিয়ে দিতে।
কথা বল জীবনানন্দ- কথা বল। চুপ থেকো না।
চিরটাকাল মুখচোরা রয়ে গেলে।
মুখের কথা মুখে না বলে লিখেছো কাগজে।
আজকাল কাগজে কেউ লেখেনা।
প্রেমের কথা শোনায় ইলেক্ট্রনিক্সে।
তুমি সেকেলেই থেকে গেলে, জীবনানন্দ - সেকেলেই থেকে গেলে।

জলের ’পরে জল, জল খেলা করে।
মেঘের ’পরে মেঘ, সঘন ডমরু বাজে।
আর প্রেমের ’পরে প্রেম, তা কি শিহরিত না করে পারে!
হাজার বছরের অন্বেষণে ক্ষণিকের আনন্দে দিশেহারা হয়েছিলে যে ঘাস ফুল গন্ধে –
অনাক্লেশে তাকে কাছে পেয়েও
’কেমন আছো ?’ - শুধালে না !
’এতদিন পরে কেন এলে?’- বল্লে না!
বিচলতায় কাঁপলেনা, কপালে তার স্বেদ বিন্দু দেখে!
তুমি কী মৃত ? ম’রে গেছ!

জীবনানন্দ,
তুমি না অঙ্গীকার করেছিলে – ’আবার আসিবো ফিরে’
আমরা তো তোমাকে মরতে দিইনি।
তোমার জন্য জীবন গড়েছি-
তোমার জন্য আনন্দ কিনেছি।
তুমি আসবে বলে রক্তের সাগরে নীল পদ্ম ফুটিয়েছি।
হাজার বছরের সূর্য্যকে শ্যামল প্রান্তরে গুম্ফি‌ত করেছি।
তোমার জন্য সর্ষে বাগানে আসন র’চেছি।
যেখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম।
রয়েছে তোমার জন্যও আসন পাতা।
এসো অগ্রজ, গানখানি শোনাই তোমায় -
’বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা’ - বুকের তলে স্বপ্নদেশ।
শ্যামা, দোয়েল , রাঙ্গা যেথায় খুরছে মাটি,
উড়ছে আকাশ বিষন্নতায়,
রক্ত জবা ঝরে পরে বাক্যহীন সংকীর্ণতায়- তোমার জন্ম দিনে।