জীবনানন্দের কবিতা আমাদের নিতান্তই প্রয়োজন কারণ মানুষের জীবন খুব একটা সুখপ্রদ নয় | জীবন যদি অনন্ত সুখ-প্রসবিনী হত, তাহলে বাংলা ভাষায় তাঁর কবিতার খুব একটা প্রয়োজন থাকতো বলে আমার মনে হয় না | সুখ-নিঃসৃত কবিতা, যথা প্রেমিকা কে লেখা প্রেমিকের কবিতা, প্রকৃতির সৌন্দর্য্যমন্ডিত কবিতা, জীবনের মাহাত্ম বর্ণনার কবিতা, এসবই থাকত | এদের মাঝে "বনলতা সেন" কে আর প্রয়োজন পড়ত না বলেই আমার ধারণা |
প্রথম প্রথম যখন জীবনানন্দের কবিতা পড়তে শুরু করি তখন নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন দানা বেঁধে ওঠে | এই ধরা যাক আমি, আমরা | আপনি, আপনারা | তুমি, তোমরা | এই বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট, শহর ছাড়িয়ে গেলে গ্রামের ধানের ক্ষেত্রে, তারপর ঘন বন, মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশ, ইত্যাদি ইত্যাদি.....এদের সঙ্গে আমাদের কিসের সংযোগ ? সেই সংযোগ কি নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনে নাকি কবিতার মতই আদতে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় হয়েও অপূর্ব?
জীবনানন্দ কে প্রায়শই দুঃখবাদী বা হতাশাগ্রস্ত কবি বলা হয় | আমার তা পুরোপুরি ঠিক বলে মনে হয় না | তবে তাঁর কবিতা যে আমাদের চলতি জীবনের আনন্দ-ফূর্তির পরিপোষক নয় তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে |
যেমন পুরোনো খোলস ছেড়ে সাপ তার নতুন চকচকে ত্বক নিয়ে আলোর ঝলমলানিতে এঁকেবেঁকে চলে যায়, ঠিক তেমনই মানুষ প্রতিদিনের নিঃস্বাসপ্রঃশ্বাস, উদরপূর্তি এবং অর্থোপার্জন ছেড়ে একাকীত্বের শরণাপন্ন হয় | এখন সাপের চামড়াটা খুব নরম | একটা পাথরকুচি গায়ে বিঁধলেও কষ্ট হয় | বেশিরভাগ মানুষই একাকীত্বে খুব কষ্ট পায় | কেউ কেউ কাঁদে | কেউ কেউ শূন্য দৃষ্টিতে পৃথিবীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে | এই একাকীত্ব অবিনশ্বর | এর কোনও মৃত্যু নেই | সম্ভবত কোনও বিকল্পও নেই | মানুষের বোধই মানুষকে এই নির্বাসনে নির্বাসিত করে |
এখন এই নির্বাসন দুই ধরণের হতে পারে | জেলখানার বদ্ধ কুঠুরির নির্বাসন অথবা সমুদ্র পেরিয়ে পাইন গাছের জঙ্গলে ঢাকা নির্জন দ্বীপের স্বেচ্ছায় নির্বাসনে চলে যাওয়া | এই রকমই এক স্বেচ্ছাকৃত নির্বাসন, কুয়াশা রাতের একলা চাঁদের মত, গভীর অরণ্যের নিস্তব্ধতা মত, তটের বালির ওপর ক্রমাগত আছড়ে পড়া উদাসীন সমুদ্রের মতো জীবনানন্দ দাশের কবিতা | সে এক আশ্চর্য্য স্বপ্নলোক | প্রথম প্রথম রীতিমত ভয় হত | তলিয়ে যাওয়ার ভয় | হারিয়ে যাওয়ার ভয় | "রূপসী বাংলা" কাব্যগ্রন্থের ৫৭ নম্বর কবিতায় তিনি বলেন-
"কোনদিন দেখিব না তারে আমি; হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিংড়ায় সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছাসের গান
সারা রাত-তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে-বেণুবনে তাহার সন্ধান
পাব নাকো; পুকুরের পারে সে যে আসিবে না কোনদিন হাদিনের সাথে-"
এইভাবেই হারিয়ে যায় মানুষ | ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় | কোনদিন দেখিব না তারে আমি | পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য্য যেমন ছিল তেমনই থাকবে | হেমন্তে ধান পাকবে | আষাঢ়ে বন বৃষ্টিতে ভিজে উচ্ছাসে গেয়ে উঠবে | কবি অন্ধকারে একাকী ঘুরে বেড়াবে | তবুও তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাবে না |
এই ধরণের এক অতীন্দ্রিয় ভাব, যা চলতি জীবনের পরিবার-পরিজনের মাঝে, বাসে-ট্রামে, অফিস-কাছারিতে প্রকাশ করা বহু ব্যবহৃত হাসি-কান্না-রাগ-দুঃখ-অভিমানের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা | এই ভাব উপলব্ধি করতে প্রয়োজন তীব্র একাকীত্বের | প্রয়োজন আত্মানুসন্ধান | প্রয়োজন নির্জন প্রান্তরে বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব-বোধের মহৎ সাগরে নিমজ্জিত হয়ে থাকা |
তবে অন্তরের এই গভীর বোধ মানুষকে প্রায়শই জাগতিক সুখ-সাচ্ছন্দের থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায় | মানুষ বিষাদগ্রস্ত হয়ে পরে | এসব কারণেই সম্ভবত জীবনানন্দ কে অনেকেই দুঃখবাদী কবির তকমা দিয়ে থাকে | হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে তাঁর অধিকাংশ কবিতায় এক সুগভীর দুঃখবোধ চোরাস্রোতের মত বয়ে চলে | তবে অনেক ক্ষেত্রেই দুঃখবোধ শেষ কথা বলে না | আনন্দ থাকে, থাকে গভীর আশার উদয় | যেমন এই "রূপসী বাংলার" ৫৭ নম্বর কবিতারই শেষ দিকে-
"বাদুড় উড়িয়ে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয় রাতের বাতাসে
প্রতিটি নক্ষত্র তাঁর স্থান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধুলির কণা লেগে রবে তুচ্ছ অণুকণাটির স্বাসে
অন্ধকারে-তুমি চলে গেলে দূরে তবু- হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থর শাখা এই দুলিতেছে, আলো আসে, ভোর হয়ে আসে |"
মুক্ত হওয়াতেই মানুষের আনন্দ | যে আনন্দ সদা জাগ্রত, শাশ্বত, যে আনন্দ উপভোগের জন্য মানুষের কোনও জাগতিক আড়ম্বর বা আয়োজনের প্রয়োজন হয় না | প্রতিটি নক্ষত্র তাঁর স্থান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে | তুমি চলে গেছ চিরতরে, তবু আলো আসে, ভোর হয়ে আসে |
এ এক আশ্চর্য্য আশাবাদ | এই আশা কোনও ভিখারির পয়সা পাওয়ার আশা নয় | কোনও বিক্ষুব্ধ, আন্দোলনরত জনগণের ন্যায়বিচারের আশা নয় | এই আশা অস্তিত্বের আশা | এই আনন্দ জীবন কে অনুভব করার আনন্দ, তা সে অনুভূতি যতই যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন | আমাদের প্রতি মুহূর্তের এই অস্তিত্ব, এই বেঁচে থাকা কে এক অপার্থিব মায়াময় কাব্যিক রূপে দেখেছিলেন জীবনানন্দ |
মানুষের সমস্ত ঠুনকো সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান. চাওয়া-পাওয়ার বেড়া ডিঙিয়ে এই পরম শাশ্বত আনন্দের ছোঁয়া পাওয়া যায় তার কবিতায় | তার বিখ্যাত "সুচেতনা" কবিতায় এর স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে-
"মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হলো সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে
দেখেছি যা হল, হবে, মানুষের যা হওয়ার নয়-
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয় |"
আজকের এই আধুনিক যুগে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, জীবনের সমস্ত ভোগ মানুষের হাতের মুঠোয় | অথচ জীবনধারণের মহৎ অপার্থিব আনন্দ বালির মতো মুঠো ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে | চারিদিকে ক্যূৎসিত ও কদর্যতার রাজত্ব | তবুও হাজার বছর ধরে নাবিক একাকী ঘুরে বেড়ায় | কত নগর, সমুদ্র, দ্বীপ পেরিয়ে তারপর হয়তো অন্ধকারে বনলতা সেনের দেখা পায় | পাখির নীড়ের মতো তার চোখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আশ্রয় খুঁজে পায় | জীবনানন্দের কবিতা মানুষকে তার পারিপার্শ্বিক সমস্ত কোলাহল, কোন্দল ও জঞ্জাল থেকে মুক্ত করে পৃথিবী ও মানবজীবনের এক আশ্চর্য্য অপার্থিব এবং সর্বোপরি অকৃত্রিম আনন্দে-বিষাদে ভরিয়ে দে | যারা চলতি ভিড়ে খাপ খাইয়ে, গা ভাসিয়ে চলতে পারে না তাদের আশ্রয় তাঁর কবিতা |
তাই জীবনে আর কিছু করতে পারি বা না পারি, এইটুকু বলতে পারি যে জীবনে জীবনানন্দের কবিতাকে নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্য অনুযায়ী ভালবেসেছি | এক ঝলক হলেও, "বনলতা সেন" কে দেখেছি |