[‘শাখ-ই-নবাত’ বুলবুল-ই-শিরাজ কবি হাফিজের মানসীপ্রিয়া ছিলেন।]
শাখ-ই-নবাত শাখ-ই-নবাত! মিষ্টি রসাল ‘ইক্ষু-শাখা’।
বুলবুলিরে গান শেখাল তোমার আঁখি সুরমা-মাখা।
বুলবুল-ই-শিরাজ হল গো হাফিজ গেয়ে তোমার স্তুতি,
আদর করে ‘শাখ-ই-নবাত’ নাম দিল তাই তোমার তুতি।
তার আদরের নাম নিয়ে আজ তুমি নিখিল-গরবিনি,
তোমার কবির চেয়ে তোমায় কবির গানে অধিক চিনি।
মধুর চেয়ে মধুরতর হল তোমার বঁধুর গীতি,
তোমার রস-সুধা পিয়ে, তাহার সে-গান তোমার স্মৃতি।
তোমার কবির – তোমার তুতির ঠোঁট ভিজালে শহদ দিয়ে,
নিখিল হিয়া সরস হল তোমার শিরিন সে রস পিয়ে।
কল্পনারই রঙিন পাখায় ইরান দেশে উড়ে চলি,
অনেক শত বছর পিছের আঁকাবাঁকা অনেক গলি –
তোমার সাথে প্রথম দেখা কবির যেদিন গোধূলিতে,
আঙুর-খেতে গান ধরেছে, কুলায়-ভোলা বুলবুলিতে।
দাঁড়িয়েছিলে একাকিনী ‘রোকনাবাদের নহর’ তীরে,
রঙিন ছিল আকাশ যেন কুসুম-ভরা ডালিম-শাখা
তোমার চোখের কোনায় ছিল আকাশ-ছানা কাজল আঁকা।
সন্ধ্যা ছিল বন্দি তোমার খোঁপায়, বেণির বন্ধনীতে ;
তরুণ হিয়ার শরম ছিল জমাট বেঁধে বুকের ভিতে!
সোনার কিরণ পড়েছিল তোমার দেহের দেউল চূড়ে,
ডাঁসা আঙুর ভেবে এল মউ-পিয়াসি ভ্রমর উড়ে।
তিল হয়ে সে রইল বসে তোমার গালের গুলদানিতে,
লহর বয়ে গেল সুখে রোকনাবাদের নীল পানিতে।
চাঁদ তখনও লুকিয়ে ছিল তোমার চিবুক গালের টোলে,
অস্তরবির লাগল গো রং শূন্য তোমার সিঁথির কোলে।
ওপারেতে একলা তুমি নহর-তীরে লহর তোলো,
এপারেতে বাজল বাঁশি, ‘এসেছি গো নয়ন খোলো!’
… … …
তুললে নয়ন এপার পানে – মেলল কি দল নার্গিস তার?
দুটি কালো কাজল আখর – আকাশ ভুবন রঙিন বিথার!
কালো দুটি চোখের তারা, দুটি আখর, নয়কো বেশি ;
হয়তো ‘প্রিয়া’, কিংবা ‘বঁধু’ – তারও অধিক মেশামেশি!
কী জানি কী ছিল লেখা – তরুণ ইরান-কবিই জানে,
সাধা বাঁশি বেসুর বোলে সেদিন প্রথম কবির কানে।
কবির সুখের দিনের রবি অস্ত গেল সেদিন হতে,
ঘিরল চাঁদের স্বপন-মায়া মনের বনের কুঞ্জপথে।
হয়তো তুমি শোননি আর বাঁশুরিয়ার বংশীধ্বনি,
স্বপন-সম বিদায় তাহার স্বপন-সম আগমনি।
রোকনাবাদের নহর নীরের সকল লহর কবির বুকে,
ঢেউ তোলে গো সেদিন হতে রাত্রি দিবা গভীর দুখে।
সেই যে দুটি কাজল হরফ দুটি কালো আঁখির পাতে,
তাই নিয়ে সে গান রচে তার ; সুরের নেশায় বিশ্ব মাতে!
অরুণ আঁখি তন্বী সাকি পাত্র এবং শারাব ভুলে,
চেয়ে থাকে কবির মুখে করুণ তাহার নয়ন তুলে।
শারাব হাতে সাকির কোলে শিরাজ কবির রঙিন নেশা
যায় গো টুটে ক্ষণে ক্ষণে – মদ মনে হয় অশ্রু মেশা।
অধর-কোণে হাসির ফালি ঈদের পহিল চাঁদের মতো –
উঠেই ডুবে যায় নিমেষে, সুর যেন তার হৃদয়-ক্ষত।
এপার ঘুরে কবির সে গান ফুলের বাসে দখিন হাওয়ায়
কেঁদে ফিরেছিল কি গো তোমার কানন-কুঞ্জ ছায়ায়?
যার তরে সে গান রচিল, তারই শোনা রইল বাকি?
শুনল শুধু নিমেষ-সুখের শারাব-সাথি বে-দিল্ সাকি?
শাখ-ই-নবাত! শাখ-ই-নবাত! পায়নি তুতি তোমার শাখা,
উধাও হল তাইতে গো তার উদাস বাণী হতাশ-মাখা।
অনেক সাকির আঁখির লেখা, অনেক শারাব পাত্র-ভরা,
অনেক লালা নার্গিস গুল বুলবুলিস্তান গোলাব-ঝোরা
ব্যর্থ হল, মিটল না গো শিরাজ কবির বুকের তৃষা,
হয়তো আখের শাখায় ছিল সুধার সাথে বিষও মিশা!
নইলে এ গান গাইত কে আর, বইত না এ সুরধুনী;
তোমার হয়ে আমরা নিখিল বিরহীরা সে গান শুনি।
আঙুর-লতায় গোটা আঙুর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবারি,
শিরাজ-কবির সাকির শারাব রঙিন হল তাই নিঙাড়ি।
তোমায় আড়াল করার ছলে সাকির লাগি যে গান রচে,
তাতেই তোমায় পড়ায় মনে, শুনে সাকি অশ্রু মোছে!
তোমার চেয়ে মোদের অনেক নসিব ভালো, হায় ইরানি!
শুনলে নাকো তোমায় নিয়ে রচা তোমার কবির বাণী।
তোমার কবির রচা গানে মোদের প্রিয়ার মান ভাঙাতে
তোমার কথা পড়ে মনে, অশ্রু ঘনায় নয়ন-পাতে!
ঘুমায় হাফিজ ‘হাফেজিয়া’য়, ঘুমাও তুমি নহর-পারে,
দিওয়ানার সে দিওয়ান-গীতি একলা জাগে কবর-ধারে।
তেমনি আজও আঙুর-খেতে গেয়ে বেড়ায় বুলবুলিরা,
তুতির ঠোঁটে মিষ্টি ঠেকে তেমনি আজও চিনির সিরা।
তেমনি আজও জাগে সাকি পাত্র হাতে পানশালাতে –
তেমনি করে সুরমা-লেখা লেখে ডাগর নয়ন-পাতে।
তেমনি যখন গুলজার হয় শারাব-খানা, ‘মুশায়েরা’,
মনে পড়ে রোকনাবাদের কুটির তোমার পাহাড়-ঘেরা।
গোধূলি সে লগ্ন আসে, সন্ধ্যা আসে ডালিম-ফুলি,
ইরান মুলুক বিরান ঠেকে, নাই সেই গান, সেই বুলবুলি।
হাফেজিয়ায় কাঁদন ওঠে আজও যেন সন্ধ্যা প্রভাত –
‘কোথায় আমার গোপন প্রিয়া কোথায় কোথায় শাখ-ই-নবাত!’
দন্তে কেটে খেজুর-মেতি আপেল-শাখায় অঙ্গ রেখে
হয়তো আজও দাঁড়াও এসে পেশোয়াজে নীল আকাশ মেখে,
শারাব-খানায় গজল শোনো তোমার কবির বন্দনা-গান;
তেমনি করে সূর্য ডোবে, নহর- নীরে বহে তুফান।
অথবা তা শোন না গো, শুনিবে না কোনো কালেই;
জীবনে যে এল না তা কোনো লোকের কোথাও সে নাই!
অসীম যেন জিজ্ঞাসা ওই ইরান-মরুর মরীচিকা,
জ্বালনি কি শিরাজ-কবির লোকে তোমার প্রদীপ-শিখা?
বিদায় সেদিন নিল কবি শূন্য শারাব পাত্র করে,
নিঙ্ড়ে অধর দাওনি সুধা তৃষিত কবির তৃষ্ণা হরে!
পাঁচশো বছর খুঁজেছে গো, তেমনি আজও খুঁজে ফিরে
কবির গীতি তেমনি তোমায় রোকনাবাদের নহর-তীরে!
(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)