বন্ধুরা কহে, ‘হায় কবি, খেল এ কী নিষ্ঠুর খেলা,
কোন অকারণ অভিমানে আপনারে হান অবহেলা?’
হাসিয়া কহিনু – ‘হয়েছে কী?’ বন্ধুরা কহে – ‘চুলোর ছাই!
আপন সৃষ্টি করিছ নাশ, সেদিকে তোমার দৃষ্টি নাই?’
আমি কহিলাম – ‘জানি না তো সৃষ্টি করেছি কিছু আমি,
আমি শুধু জানি, নদীর প্রায় ছুটিয়া চলেছি দিবাযামী!
সাগরের তৃষা লয়ে নদী কেবল সুমুখে ছুটিয়া যায়,
পথে পথে যেতে ঢেউ তাহার কত কথা বলে, কত কী গায়!’
অকারণ কথাগুলিরে তার যদি কেহ বলে, ‘চমৎকার
মধুচ্ছন্দা কাব্যশ্লোক, বাজে তরঙ্গে সুরবাহার!’
কেউ বলে, ‘পাগলের প্রলাপ, কোনো মানে নাই ওর কথার,
এ নয় গোলাপ, লিশি-কলাপ, এ শুধু প্রকাশ মূর্খতার!’
শোনে না স্তুতি, নিন্দাবাদ-উন্মাদ বেগে প্রবল ঢেউ
আগে ছুটে চলে, কী গান গায় কী কথা কয় সে, বোঝে না কেউ।
জন্ম-শিখর হইতে মোর কোন সে অসীম মহাসাগর
টানিয়া আনিল, দিল সে ডাক, তারই পানে ছুটি ছাড়িয়া ঘর!
বন্ধু গো, সুর-স্রষ্টা নই, কবি নই, আমি সাগরজল,
কভু মেঘ হয়ে ঝরে পড়ি, কভু নদী হয়ে বহি কেবল।
মৌন উদার হিমালয়ে কভু জমে হই হিম-তুষার,
সহসা সে ধ্যান ভাঙে আমার গাঢ় চুম্বনে রাঙা উষার!
কেন সারা রাত জেগে কাঁদি, দিনে কাজ করি, হেসে বেড়াই,
আমিই জানি না! জানি না কী লিখেছি ; কী সুরে কী গান গাই!
পাগলের মতো বকি প্রলাপ, কেন যে ভিক্ষা চাই আমি,
হয়তো জানে পরমোন্মাদ পরম-ভিক্ষু মোর স্বামী।
কেউ বলে, আমি নদীর ঢেউ দু-কূলে ফুটাই ফুল-ফসল,
কেউ বলে, আমি কূল ভাঙি ধ্বংস-বিলাসী বন্যা-জল।
যার যাহা সাধ যায়, আমি মোর পথে তেমনই ধাই,
ওরা কূলে বসে আমারে কয়, ‘কার সাথে কহ কী কথা ছাই?’
বুঝিতে পারি না, কেন আসি, তোমারে কেন যে ভালোবাসি,
মনে হয়, বিনা প্রয়োজনের তব এ কান্না, তব হাসি।
আমি কহি, ‘প্রিয় সাথিরা মোর, ছিনু রংবেজ আশমানে,
যে তুলি আঁকিত রামধনু, বাশিঁ বাজিতে যে-গুলিস্তানে,
সে বাঁশি সে তুলি কোন সে চোর লয়ে গেছে চুরি করিয়া, হায়!
আমার মনের ছন্দিতা আর সে নূপুর পরে না পায়।’
রস-প্রমত্ত অশান্ত চলিতেছিলাম রাজপথে,
সম্মুখে এল ভিখারিনি মৃত ছেলে-কোলে কোথা হতে।
কহিল, ‘বিলাসী! পুত্র মোর, দুধ পায় নাই এক ঝিনুক,
শুকায়ে গিয়াছে অন্নহীন দেখো দেখো এই মায়ের বুক!
মাতৃস্তন্য পায়নি সে, দিয়াছে মৃত্যুস্তন্য তায়,
কাফন কেনার পয়সা নাই, কী পরায়ে গোরে দিব বাছায়?’
সাত আশমান যেন হঠাৎ দুলিতে লাগিল ঘোর বেগে,
ঝরিতে লাগিল গ্রহ-তারা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে!
কহিলাম – ‘মা গো, আমি কবি, দেশে ফিরি নাকি রস ঢেলে,
সে রসের কিছু পাওনি কি তুমি আর তব মৃত ছেলে?’
কহে ভিখারিনি আঁখিজলে, ‘রস পান? সে তো বিলাসীদের!
তেল মাখ তুমি তেলা মাথায়, হায়, কেহ নাই ভিক্ষুকের!’
মরা খোকা নিয়ে ভিখারিনি চলে গেল কোন পথে সুদূর,
জ্ঞান হলে আমি চেয়ে দেখি,- বুকে জাগে গোর মরা শিশুর! –
ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বিলাসের বেণু, রাঙা গেলাস,
পাঁশের স্তূপের পাশে পড়ে আতরদানি ও গোলাবপাশ!
যেতে যেতে দেখি, মোটরকার ধাক্কা মারিয়া অন্ধে হায়
ছুটে চলে গেল চার চাকায়, চার-পায়া চড়ে অন্ধ যায়!
বন্ধু, বিলাস-সৃষ্টি এই আমার কবিতা, আমার গান
অন্ধেরে আলো দিত যদি, অপঘাতে তার যেত না প্রাণ!
যেতে যেতে হেরি বস্তিতে শুয়ে আছে কারা ভাঙা কাচে?
গুদাম ঘরের বস্তা, এই বস্তির চেয়ে সুখে আছে!
রূপ দেখিয়াছি কল্পনায় এঁকেছি স্বপ্ন-গুলবাহার,
দেখিনি শ্রীহীন এই মানুষ জীর্ণ হাড্ডি-চামড়া সার!
নগ্ন ক্ষুধিত ছেলেমেয়ে কাঁদায় কাঁদিয়া মায়ের প্রাণ,
শুনিলাম আমি এই প্রথম শিশুর কাঁদনে আল-কোরান!
মোর বাণী ছিল রসলোকের আল্লার বাণী শুনিনু এই,
বিলাশের নেশা গেল টুটে, জেগে দেখি আর সে আমি নেই!
গাঁয়ে গাঁয়ে ফিরে দেখিয়াছি পায়ে-দলা কাদামাখা কুসুম,
বক্ষে লইয়া কাঁদিছে মা, চক্ষে পিতার নাহিকো ঘুম!
শিয়রের দীপে তৈল নাই, পীড়িত বালক কাঁদিয়া কয়,
‘দেখিতে পাই না মা তোর মুখ, বাবা কোথা, বড়ো লাগিছে ভয়!’
মাঠের ফসল, কাজলা মেঘ স্বপ্নে দেখিছে ঘুমায়ে বাপ,
মরো মরো পুত্রেরে বাঁচায় মা-র মমতার উষ্ণ তাপ!
জমিদার-মহাজনপাড়ায় মেয়ের বিয়ের বাজে সানাই,
ইহাদের ঘরে বার্লি নাই, ওদের গোয়ালে দুধাল গাই।
আগুন লাগুক রসলোকে, কত দূরে সেথা কারা থাকে?
অভিশাপ দিনু – নামিবে সব এই দুখে শোকে, এই পাঁকে!
প্রায়শ্চিত্ত করি আমি–বন্ধু, আমারে কোরো ক্ষমা!
বহু ভোগ বহু বিলাস পাপ, প্রভুজি জানেন, আছে জমা!
এই ক্ষুধিত ও ভিক্ষুকের আজীবন পদসেবা করি
প্রায়শ্চিত্ত মোর ভোগের পূর্ণ করিয়া যেন মরি!
ওরা যদি আত্মীয় নহে কেন এ আত্মা কাঁদে আমার?
উহাদের তরে কেন এমন বুকে ওঠে রোদনের জোয়ার?
মুক্তি চাহি না, চাহি না যশ, ভিক্ষার ঝুলি চাহি আমি,
এদেরই লাগিয়া মাগিব ভিখ দ্বারে দ্বারে কেঁদে দিবাযামী!
(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)