‘হর হর হর শংকর হর হর ব্যোম’ –
একী ঘন রণ-রোল ছায়া চরাচর ব্যোম!
হানে ক্ষিপ্ত মহেশ্বর রুদ্র পিনাক,
ঘন প্রণব-নিনাদ হাঁকে ভৈরব-হাঁক
ধু ধু দাউ দাউ জ্বলে কোটি নর-মেধ-যাগ,
হানে কাল-বিষ বিশ্বে রে মহাকাল-নাগ!
আজ ধূর্জটি ব্যোমকেশ নৃত্য-পাগল,
ওই ভাঙল আগল ওরে ভাঙল আগল!
বোলে অম্বুদ-ডম্বুর কম্বু বিষাণ,
নাচে থই-তাতা থই-তাতা পাগলা ঈশান!
দোলে হিন্দোলে ভীম-তালে সৃষ্টি ধাতার,
বুকে বিশ্বপাতার বহে রক্ত-পাথার!
ঘোর মার’ দৈত্য, অসুর,
প্রেত, রক্ত-পিশাচ, রণ-দুর্মদ সুর।
করে ক্রন্দসী-ক্রন্দন অম্বর রোধ –
ত্রাহি ত্রাহি মহেশ হে সম্বরো ক্রোধ!
সুত মৃত্যু-কাতর, হাহা অট্টহাসি
হাসে চণ্ডী চামুণ্ডা মা সর্বনাশী।
কাল- বৈশাখী ঝঞ্ঝারে সঙ্গে করি –
রণ- উন্মাদিনী নাচে রঙ্গে মরি!
উর- হার দোলে নরমুণ্ড-মালা,
করে খড়্গ ভয়াল, আঁখে বহ্নি-জ্বালা!
নিয়া রক্তপানের কী অগস্ত্য-তৃষা
নাচে ছিন্ন সে মস্তা মা, নাইকো দিশা!
‘দে রে রক্ত দে রক্ত দে’ রণে ক্রন্দন,
বুঝি থেমে যায় সৃষ্টির হৃৎ-স্পন্দন!
জ্বলে বৈশ্বানরের ধু ধু লক্ষ শিখা,
আজ বিষ্ণু-ভালে লাল রক্ত-টিকা!
শুধু অগ্নি-শিখা ধু ধু অগ্নি-শিখা,
শোভে করুণার ভালে লাল রক্ত-টিকা!
রণ- শ্রান্ত অসুর-সুর-যোদ্ধৃ-সেনা,
শুধু রক্ত-পাথার, শুধু রক্ত-ফেনা!
একী বিশ্ব-বিধ্বংস নৃশংস খেলা,
কিছু নাই কিছু নাই প্রেত-পিশাচে মেলা।
আজ ঘরে ঘরে জ্বলে ধু ধু শ্মশান মশান –
হোক রোষ অবসান, ত্রাহি ত্রাহি ভগবান!
আজি বন্ধ সবার পূতি-গন্ধে নিশাস,
বিষে বিশ্ব-নিসাড়, বহে জোর নাভিশ্বাস!
দেহো ক্ষান্ত রণে, ফেলো রঙ্গিণী বেশ,
খোলো রক্তাম্বর মাতা সম্বরো কেশ!
এ তো নয় মাতা রক্তোন্মত্তা ভীমা!
আজ জাগৃহি মা, আজ জাগৃহি মা।
তব চরণাবলুণ্ঠিত মহিষ-অসুর,
হল ধ্বংস অসুর, লীন শক্তি পশুর।
তবে সম্বরো রণ, হোক ক্ষান্ত রোদন–
হোক সত্য-বোধন আজ মুক্তি-বোধন!
এসো শুদ্ধা মাতা এই কাল-শ্মশানে
আজ প্রলয়-শেষে এই রণাবসানে!
জাগো জাগো মানব-মাতা দেবী নারী!
আনো হৈম ঝারি, আনো শান্তি-বারি!
এসো কৈলাস হতে মা গো মানস-সরে,
নীল উৎপল-দলে রাঙা আঁচল-ভরে।
এসো কন্যা উমা, এসো গৌরী রূপে,–
বাজো শঙ্খ শুভ, জ্বালো গন্ধ ধূপে!
আজ মুক্ত-বেণি মেয়ে একাকী চলে,
ওই শেফালি-তলে হেরো শেফালি-তলে।
ওড়ে এলোমেলো অঞ্চল আশ্বিন-বায়,
হানে চঞ্চল নীল চাওয়া আকাশের গায়!
ঘোষে হিমালয় তার মহা হর্ষ-বাণী, –
এল হৈমবতী, এল গৌরী রানি।
বাজো মঙ্গল শাঁখ, হোক শুভ-আরতি,
এল লক্ষ্মী-কমলা, এল বাণী-ভারতী।
এল সুন্দর সৈনিক সুর কার্তিক,
এল সিদ্ধি-দাতা, হেরো হাসে চারিদিক!
ভরা ফুল-খুকি ফুল-হাসি শিউলির তল,
আজ চোখে আসে জল, শুধু চোখে আসে জল!
নিয়া মাতৃ-হিয়া নিয়া কল্যাণী-রূপ
এল শক্তি স্বাহা, বাজো শাঁখ, জ্বালো ধূপ!
ভাঁজো মোহিনী সানাই, বাজো আগমনি-সুর,
বড়ো কেঁদে ওঠে আজ হিয়া মাতৃ-বিধুর।
ওঠে কণ্ঠ ছাপি বাণী সত্য পরম –
বন্- দে মাতরম্। বন্দে মাতরম্!
(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)