ওরা কয়, ‘আগে ফুল ফুটাইতে, এখন ফুটাও হুল!’
আমি কই, ‘যদি হুল না ফুটাই ফুটিবে কি তবে fool?’
বন্ধু, মিথ্যা অপত্য-স্নেহে আপত্তি নাহি করি
ধর্ম লয়েছে অধর্ম নাম, সত্য গিয়াছে মরি!
গাঁয়ের বউঝি জল নিতে যায় মেছুড়ে বুঝিতে নারে,
গাল দেয় রেগে – ইহাদেরই দোষে মাছ বসে নাকো চারে!
ভোগী বলে, ‘বাবা, কেন কাঁদ তুমি, মামা নহে তব চাষা,
ধনীর দুঃখ দেখ নাকো, একী একঘেয়ে ভালোবাসা!’
‘আল্লা বলান’ বলি। ওরা বলে – ‘দালানে তা আসে কেন?
টাকাওয়ালাদের কী করে চিনিলে, তুমি তো আল্লা চেন!’
ওরা বলে, ‘মোরা টাকার পুকুর দুয়ারে খুঁড়িয়া রাখি,
উহারাই তার দু-এক কলশি জল ভরে নেয় নাকি?’
আরও বলে, ‘দিই কলশিতে জল দিই না তো সাথে দড়ি,
আমরা কী জানি, কেন এ পুকুরে ওরা ডুবে যায় মরি?’
ওরা বলে, ‘চাষা খাইতে পায় না– আর জন্মের পাপ,
পাওনা সুদের নালিশ করিলে ওরা কেন দেয় শাপ?’
মোরা যত দিই উত্তর তার ওরা ‘দুত্তোর’ কহে,
বলে ‘জমিদারি স্বত্ব আমার, তোমার মামার নহে।’
মোরা বলি, ‘কত ইম্পিরিয়াল ব্যাংকে তোমার টাকা!’
ওরা বলে, ‘কোনো কাজে তা লাগে না, (বাবা) ফিক্স্ড ডিপোজিটে রাখা!’
মোরা বলি, ‘মোরা যাব না, মোদের প্রাপ্য যা তা না পেলে!’
ওরা বলে, ‘কেন জেলে যাবে, বাবা, ভদ্রলোকের ছেলে!’
আমি বলি, ‘জাগ, দৈত্যরে মার, দা নিয়ে দুয়ার খুল।’
ওরা বলে, ‘বাঘ হলে কেন বন- বাগিচার বুলবুল?’
আমি বলি, ‘কেন অসত্য বল, ভ্রান্ত পথ দেখাও?’
ওরা বলে, ‘আহ্, চুপ করো কবি, ফুল শোঁকো, মধু খাও!’
আমি বলি, ‘চোর ঢুকিয়াছে ঘরে, মারো তারে পায়ে দলে!’
ওরা বলে, ‘বাঁশুরিয়া! বাঁশি কেন বংশদণ্ড হলে!’
ওরা বলে, ‘দাদা, এতদিন তুমি বেশ তো ঘুমায়ে ছিলে!
কখন হইল ‘ইনসমনিয়া’? সারা দেশ জাগাইলে!’
আমি বলি, ‘দেশ জাগে যদি, কেন তোমাদের ডর লাগে?’
ওরা বলে, ‘আসে রাম-দা লইয়া। রামদা বলিত আগে!’
কে যে বলে ঠিক, কে বলে বেঠিক, ঠিকে ভুল হয় কার?
চাষা ও মজুরে ঠকাইয়া খায় দুনিয়ার ঠিকাদার!
‘ওরা তো বলে না, তুমি কেন বল, কেন তব মাথাব্যথা?’
জিজ্ঞাসে সাধু। – আমি বলি, ‘কহে ওদেরই আত্মা কথা!’
হায় রে দুনিয়া দেখি মৌলানা মৌলবিতে একাকার,
আমি একা হেথা কাফের রে দাদা আমি একা গুনাগার!
গুনাগারি দেয় বণিকেরা নাকি, চাষারাই করে লাভ,
ধনী যেন সদা তৃষিত, এবং চাষা সদা কচি ডাব!
শুনেছি সেদিন ধনিক-সভায়– নতুন আইন হবে,
চাষাদের দা, দাঁত আর নখ খেঁটে লাঠি নাহি রবে।
আমি বলি, ‘হয়ে অভাবে স্বভাব নষ্ট, হয়েছে চোর!’
ওরা বলে, ‘তাই বল, তাই চুরি হয় না বাড়িতে তোর!’
আমি বলি, ‘খেয়ো না এ কদন্ন, হালালি অন্ন খাও!’
ওরা বলে, ‘তুমি এদেরই দালালি করে বুঝি টাকা পাও?’
‘যার যত তলা দালান, সে তত আল্লা-তালার প্রিয়–’
ওরা কয়। আমি বলি, ‘বেশ করে সে তালায় তালা দিয়ো!’
আমি ভিক্ষুক কাঙালের দলে – কে বলে ওদের নীচ?
ভোগীরা স্বর্গে যাবে, যদি খায় ওদের পানের পিচ!
ওরা হাসে, ‘এ কি কবিতার ভাষা? বস্তিতে থাক বুঝি?’
আমি কই, ‘আজও পাইনি পুণ্য- বস্তির পথ খুঁজি!
দোওয়া করো, যেন ওই গরিবের কর্দমাক্ত পথে
যেতে পারি, এই ভোগ-বিলাসীর পাপ-নর্দমা হতে!’
(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)